২.৩ লাখ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদনে অর্থনৈতিক পরিষদের সভা আজ, সর্বোচ্চ বরাদ্দ ভবন নির্মাণে

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদনের লক্ষ্যে আজ (১৮ মে) বৈঠকে বসছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। প্রস্তাবিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সরকারি আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন নির্মাণে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক কোড অনুযায়ী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপিতে তালিকাভুক্ত ১,১১১টি প্রকল্প বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভবন নির্মাণে সর্বোচ্চ, অর্থাৎ ৪৩ হাজার ৯৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে—যা মোট এডিপির ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এর আগে গত ৬ মে প্রস্তাবিত এডিপি অনুমোদন দেয় পরিকল্পনা কমিশন, যা চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম।
আজকের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে এডিপির খসড়া পর্যালোচনা করবেন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সদস্যরা।
বৈঠকে উপস্থাপনযোগ্য খসড়া এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০টি ইকনোমিক কোড বা খাতের তালিকা ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে অনাবাসিক ভবন নির্মাণে।
প্রস্তাবিত এডিপিতে অনাবাসিক ভবন নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৮ হাজার ১৮ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ১১.৭৪ শতাংশ। অনাবাসিক ভবনের মধ্যে সরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন অন্তর্ভুক্ত থাকে।
এছাড়াও সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত কোডগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণও রয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ১৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৩.৭৮ শতাংশ।

অনাবাসিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণের পরেই সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে অন্যান্য ভবন ও স্থাপনায়। এর আওতায় রেলস্টেশন ভবন, মেট্রোরেল স্টেশন, টার্মিনাল ভবন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৯১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ২.৯ শতাংশ।
এডিপির প্রস্তাবিত বরাদ্দ অনুযায়ী, ইকনোমিক কোডভিত্তিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৭ হাজার ৩৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৭.২৮ শতাংশ।
তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ে। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৬ হাজার ৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৬.৭৪ শতাংশ।
চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ বা ক্রয়ের জন্য। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ হাজার ৮২৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬.৬৩ শতাংশ।
পঞ্চম সর্বোচ্চ বরাদ্দ রয়েছে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে। উন্নয়ন প্রকল্পে গবেষণা কার্যক্রমে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৬২৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৩.৮২ শতাংশ।
গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ১১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৩.৭৮ শতাংশ।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রয়েছে সেতু ও বাঁধ নির্মাণে। সেতু নির্মাণে বরাদ্দ ৬ হাজার ৫০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা (২.৭৩%) এবং বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা (২.৭১%)।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগেও দেখা গেছে—সরকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভবন বা হাসপাতাল ক্লিনিক ভবন নির্মাণ করেছে, কিন্তু সেগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক, চিকিৎসক বা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়নি। এবার যেখানে মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, সেখানে বরং ভবন নির্মাণে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে—এটি বোধগম্য নয়।"
তিনি বলেন, "কোন ধরনের ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভবনগুলোর জন্য কি আগেই প্রতিশ্রুতি ছিল? এগুলো এখন কতটা জরুরি, তা মূল্যায়ন করতে হবে।"
ড. ফাহমিদা বলেন, "অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই হবে না, সেগুলোর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র বরাদ্দ দিয়ে ভবন নির্মাণ করলেই এডিপির লক্ষ্য পূরণ হয় না। ভবনের সঙ্গে সেবা নিশ্চিত করাও জরুরি। ভবন যেন প্রকৃত অর্থে জনসেবায় ব্যবহৃত হয়, সেটি সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।"
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ–এর চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, "যে ১০টি ইকনোমিক কোডে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গ্রামীণ সড়ক, মহাসড়ক—এগুলো প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। তবে মানবসম্পদ উন্নয়নকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে গ্যাস সংকটে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কিন্তু গ্যাস খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কর্মসংস্থান বাড়ায়—এমন খাতগুলোকেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল।"
এম মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, "সরকারি উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে ভবন নির্মাণ প্রয়োজন, তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত এমন খাতগুলো—যেগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে পারে।"
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, আগের বছরের মতো এবারও প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মোট ১৫টি খাতের মধ্যে ৫টি খাতে সর্বোচ্চ প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। খাত পাঁচ হলো—পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা এবং স্বাস্থ্য।