গত অর্থবছরের তুলনায় এবারের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমছে ১১.৮৩%

পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) ২,১৬,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দ গত অর্থবছরের সংশাধিত এডিপি বরাদ্দের তুলনায় ২৯,০০০ কোটি টাকা বা ১১.৮৩ শতাংশ কম।
বোরবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় নির্বাহী কমিটির (এনইসি) সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে সংশোধিত এডিপি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আগামী ৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য এনইসি সভায় তা উপস্থাপন করা হবে।
সাধারণত প্রতি অর্থবছর, তার আগের অর্থবছরের চেয়ে আরএডিপি বরাদ্দ বাড়লেও এবার তা কমেছে। গত অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২,৪৫,০০০ কোটি টাকা। যদিও গত অর্থবছরে সরকার আরএডিপি বরাদ্দের ১,৯৬,১১১ কোটি টাকা ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছে– যা মোট বরাদ্দের ৮০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়ন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমনিতে আরএডিপিতে বরাদ্দে কমেছে, তার ওপরে বর্তমান বাস্তবতায় বরাদ্দের অর্থে ব্যয় নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর অর্থ ব্যয়ে সক্ষমতার অভাবে এডিপির মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগ আরও কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থাসহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত টিবিএসকে বলেন, "এমনিতে আমাদের দেশে এডিপি বরাদ্দ ব্যয়ে সক্ষমতার অভাব রয়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর। তার মধ্যে এ অর্থবছরের যে বাস্তবতা, তাতে অর্থ ব্যয় আরও কমবে। এর প্রভাবে বেকারত্ব, দারিদ্র্য বাড়বে। তবে যেহেতু এটা কাঠামোগত সমস্যা না, পরিস্থিতির বাস্তবতায় সরকারি ব্যয় কমছে, সেক্ষেত্রে এটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।"
তিনি আরও বলেন, "দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়, এমন কিছু প্রকল্প দ্রুত সময়ের মধ্যে নেওয়া হলেও সরকারি বিনিয়োগ বাড়বে, প্রবৃদ্ধিরও বাড়বে।"
অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, "চলতি অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, চলতি অর্থবছরে খুব বেশি সরকারি বিনিয়োগ বাড়ার সুযোগ নেই। সরকারি ক্রয়ে বড় অংশ হয় এডিপির বরদ্দ থেকে। আরএডিপিতে বরাদ্দ ও ব্যয় কমে গেলে সরকারের ক্রয়ও কমবে। এছাড়া, উন্নয়ন ব্যয় কমবে; বিশেষ করে গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যয় কমে যাবে।"
তিনি আরও বলেন, "উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে যে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়, সেটাও কমে যাবে। গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। এছাড়া, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরকারের উল্লখযোগ্য একটা রাজস্ব আসে, সেটিও কমে যাবে।"
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরি টিবিএসকে বলেন, "জুলাই পরবর্তী সময়ে সবক্ষেত্রে অস্থিরতা বিজার করছে। পরিস্থতি স্বাভাবিক না। এ কারণে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। আবার পরিস্থিতি কবে স্থির হবে তাও বলা যাচ্ছে না। ফলে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে খুব বেশি সময় পাওয়া যাবে না।"
"আবার সরকার রাজস্ব আহরহণ করে এডিপির বরাদ্দের যোগান দেয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার বাইরে এবার মহার্ঘ ভাতাও দেওয়া ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকার এডিপিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে পারছে না। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের জন্য সরকারি তহবিল থেকে একটি অংশ ব্যয় করতে হয়। এ কারণে বৈদেশিক অর্থায়নও আসছে না। উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ও কমে গেছে। তবে বরাদ্দ কমলেও এখনও ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দও ব্যয় করা যাবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছর আরএডিপি প্রণয়নের আগে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছ থেকে বরাদ্দের চাহিদা দিতে বলা হয়। সাধারণত দেখা যায়, অন্যান্য বছরে চাহিদা অনেক বেশি থাকে। যে কারণে বরাদ্দ বণ্টন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু এ অর্থবছরের নির্বাচনের বছর হওয়ার চাহিদার চাপ কিছুটা কম ছিল। আর চলতি অর্থবছরে এই চাহিদা অনেক বেশি কমে গেছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছ থেকে চাহিদা এসেছে মাত্র ১,৯১,১১৩ কোটি টাকার। এ কারণে থোক বরাদ্দ দিয়ে আরএডিপির আকার বাড়ানো হয়েছে।
কিছু নতুন প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন দিয়ে যাতে দ্রুত কিছু ব্যয় বাড়ানো যায় তার জন্য ২৬,০০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সাধারণত প্রতি বছরে সংশোধিত এডিপিতে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হতো।
চাহিদার কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে অনেক প্রকল্পে ঠিকাদার চলে গেছেন। অনেক প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হচ্ছে।
আবার অনেক প্রকল্পের পরিচালকও চলে গেছেন। বেশকিছু প্রকল্পে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা এখনও বাস্তবায়ন কাজে গতি আনতে পারেননি। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, অনেক নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণেও বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর এসব কারণে অর্থ ব্যয় না হওয়ার শঙ্কায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদা কমেছে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে মোট বরাদ্দের ২০.৭৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
এডিপির তুলনায় আরএডিতে বরাদ্দ কমেছে ৪৯,০০০ কোটি টাকা
এদিকে, মূল এডিপির তুলনায় চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে বরাদ্দ ৪৯,০০০ কোটি টাকা বা ১৮.৪৯ শতাংশ কমছে। এরমধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ কমছে ৩০,০০০ কোটি টাকা বা ১৮ শতাংশ আর বৈদেশিক তহবিলের বরাদ্দ কমেছে ১৯,০০০ কোটি টাকা বা ১৯ শতাংশ।
ফলে সংশোধিত আরএডিপিতে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ কমে হচ্ছে ১,৩৫,০০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক তহবিলের বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ৮১,০০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ২,৬৫,০০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ রয়েছে ১,৬৫,০০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ রয়েছে ১,০০,০০০ কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি তুলনায় সংশোধিত এডিপির আকার কমেছিল ১৮,০০০ কোটি টাকা বা ৬.৮৪ শতাংশ। এডিপির তুলনায় সংশোধিত এডিপিতে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ কমেছে ৭,৫০০ বা ৪.৪৪ শতাংশ এবং বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ কমেছে ১০,৫০০ বা ১১.১৭ শতাংশ।
বরাদ্দ কমেছে পরিবহন, বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে; বেড়েছে শিক্ষায়
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে সর্বোচ্চ ৪৮,২৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত– যা এডিপি বরাদ্দে ২২.৩৪ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরে আরএডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেলেও গত অর্থবছরের আরএডিপির তুলনায় এ খাতে এবার বরাদ্দ কমেছে। এ অর্থবছরের আরএডিপিতে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮.৮৭ শতাংশ।
গত অর্থবছরের আরএডিপিতে সর্বোচ্চ ৩৪.২৪ শতাংশ বরাদ্দ পাওয়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪.৭৭ শতাংশ।
গত অর্থবছরের আরএডিপির তুলনায় চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে পরিবহন ও যোযোযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। অন্যদিকে, শিক্ষা গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলী, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে গত আরএডিপির তুলনায় এবার বরাদ্দ বেড়েছে।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯.৪২ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে শিক্ষাখাত। গত আরএডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩.৯০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতে এবার মোট আরডিপির ৩.৯২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরের আরএডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৪.১৮ শতাংশ।
এছাড়া, চলতি অর্থবছরে চতুর্থ সর্বোচ্চ ৯.১০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলী খাতে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭.৮৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ৪.৪৬ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ২.০৬ শতাংশ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২ শতাংশ।