কংক্রিটের শহরে অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি!

মোশাররফ সাহেব তার দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন আগারগাঁওয়ের এয়ার ফোর্স বেসক্যাম্পে। উদ্দেশ্য—ছেলেদের গাছে ওঠা শেখানো!
এত কিছু শেখানোর থাকতে গাছে ওঠা কেন শিখতে হবে? জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, "আমার জন্ম আর বড় হওয়া গ্রামে। গাছে উঠে, পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আর কাদায় গড়াগড়ি করে ফুটবল খেলে আমরা বড় হয়েছি। আমার ছেলেরা ঢাকায় বড় হচ্ছে। স্কুল আর কোচিং—এই দুইটাতেই জীবন আটকে গেছে ওদের। তাই ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য এখানে নিয়ে আসলাম।"
মোশাররফ সাহেবের মতো অনেকেই এখন ঢাকা শহরে ভিন্নধরনের বিনোদনের খোঁজে আসছেন আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এয়ার ফোর্স বেসক্যাম্পে।
দেশের বিভিন্ন অ্যামিউজমেন্ট পার্কে নানা রকম রাইড থাকে। কিন্তু বেসক্যাম্পে আছে অনেক ধরনের অ্যাক্টিভিটি। এসব অ্যাক্টিভিটি যেমন বিনোদনমূলক, তেমনি অনেক চ্যালেঞ্জিংও বটে।
ঢাকার প্রথম বেসক্যাম্প নিয়ে আজকের বিস্তারিত আয়োজন।

যেভাবে শুরু
বেসক্যাম্পের ধারণা বেশ পুরনো। পশ্চিমা দেশগুলোয় শহরের মানুষেরা ভিন্ন মাত্রার বিনোদনের জন্য আশির দশকে এই ধারণা নিয়ে আসে। বেসক্যাম্পভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা তখন টেলিভিশনে প্রচারিত হতো। সেখান থেকেই বেসক্যাম্পের ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
বেসক্যাম্পের মূল আকর্ষণ হলো—এখানে নানা ধরনের শারীরিক কসরত করতে হয়। একক, দ্বৈত বা দলগত—যেভাবেই হোক না কেন। তবে দলগতভাবে করলে আনন্দের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ।
দড়ি বেয়ে ওঠা, গাছে ওঠা, জিপ লাইন, ক্লাইম্বিং, মাড ট্রেইল, র্যাপেলিং, জুমারিং, ট্র্যাম্পোলিন—এসবই আগারগাঁও এয়ার ফোর্স বেসক্যাম্পের মূল আকর্ষণ।
আমাদের দেশে প্রথম বেসক্যাম্পের ধারণা নিয়ে আসেন তামজীদ সিদ্দিক স্পন্দন। ২০১৩ সালে দেশের প্রথম বেসক্যাম্প তৈরি করা হয় গাজীপুরে। গাজীপুরের মাধবপুরে নয় একর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয় এ বেসক্যাম্প।
নানারকম অ্যাক্টিভিটিসহ রাতে থাকার ব্যবস্থাও আছে এখানে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলবল নিয়ে মানুষজন আসেন এখানে। কর্পোরেট গ্রুপ, ব্যাংক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিকনিক—ভিন্ন কিছুর খোঁজে মানুষ প্রায়ই এখানে এসে জড়ো হয়।

তামজীদ সিদ্দিক বলেন, "বেসক্যাম্প তৈরির পেছনে আমার প্রধান ফিলোসফি ছিল মানুষকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে তাদের অজানা বা হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা।"
"আমার ছেলের বয়স যখন ছয় বছর, তখন আমি ভাবলাম—ঢাকা শহরে এমন কিছুই নেই যা করে এ শহরের শিশুরা সাহসী হতে পারবে, আত্মবিশ্বাসী হতে পারবে। সেই ধারণা থেকেই মনে হলো এমন একটা বিনোদনের জায়গা গড়ে তুলবো, যেটা আর চারটা জায়গা থেকে আলাদা। এখানে এসে আপনি রিল্যাক্স করতে পারবেন না। বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিস করতে হবে। টিমওয়ার্ক আর লিডারশিপ—এই দুই গুণও আপনি শিখে যাবেন এখানে আসলে," বলেন তিনি।
তামজীদ আরও জানালেন, "আমাদের বেসক্যাম্পের মোটো হলো 'Unleash your Inner Tiger', অর্থাৎ, নিজের ভেতরের বাঘটাকে জাগিয়ে তুলুন! নিজের ভেতরের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা যাবে এখানে আসলে।"

গাজীপুরের বেসক্যাম্পে সফলতা পাওয়ার পরে ২০২৩ সালে আরেকটি বেসক্যাম্প চালু করা হয় চট্টগ্রামের ফয়েস লেকে। ফয়েস লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের সঙ্গে যৌথভাবে এই বেসক্যাম্পের যাত্রা শুরু হয়।
চট্টগ্রামেও বেসক্যাম্প ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মোট তিনটি বেসক্যাম্পের মধ্যে চট্টগ্রামেরটাই সবচেয়ে বড়। এতে অ্যাক্টিভিটিও বেশি। লেক এবং পাহাড়ি এলাকা থাকার কারণে ব্যতিক্রমী অনেক কিছু যোগ করা গিয়েছে এখানে। যেমন—কায়াকিং, পেইন্টবল ইত্যাদি।
আর এ বছর ঢাকা শহরের ভেতরে চালু করা হয় আগারগাঁও এয়ার ফোর্স বেসক্যাম্প। আগারগাঁও মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে এর অবস্থান। বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের সঙ্গে যৌথভাবে শুরু হয় এই বেসক্যাম্প।
তামজীদ সিদ্দিক বলেন, "গাজীপুরের বেসক্যাম্পে যেতে ঢাকা থেকে একটু সময় লাগে। বড় গ্রুপ না হলে গাজীপুরেরটায় গিয়ে মজা পাওয়া যায় না। ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে যেন মুহূর্তেই আসা যায়—তাই আগারগাঁওয়ে বেসক্যাম্প নিয়ে আসলাম।"

যা যা করা যায়
দেশের তিনটি বেসক্যাম্পের অ্যাক্টিভিটি ভিন্ন ভিন্ন। বেশ কিছু জিনিস তিন জায়গাতে একরকম হলেও, বেশিরভাগই আলাদা।
গাজীপুরেরটায় বেশি মানুষ নিয়ে করা যায় এমন অ্যাক্টিভিটি বেশি। রাতে থাকার মতো আয়োজনও আছে গাজীপুরে। রিসোর্ট, সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট—গাজীপুরে অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি ঘুরাঘুরি বা রাত কাটানোর ভালো ব্যবস্থা আছে।
চট্টগ্রামের ফয়েস লেকের বেসক্যাম্প বড় জায়গা নিয়ে হওয়ায় এতেও অ্যাক্টিভিটি বেশি। লেক আর পাহাড়ের সমন্বয়ে এই বেসক্যাম্পই সবচেয়ে বেশি সুন্দর বলে জানান তামজীদ সিদ্দিক।
আর ঢাকায় অবস্থিত এয়ারফোর্স বেসক্যাম্পটি নতুন হলেও এখানে দর্শনার্থীর আনাগোনা বেশি হচ্ছে। ঢাকার একদম মাঝখানে এবং মেট্রোরেলের সুবিধা থাকার কারণে প্রতিদিনই ভিড় লেগে থাকে এয়ারফোর্স বেসক্যাম্পে।

এখানে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ আছে। প্যাকেজ অনুযায়ী ভাগ করা আছে অ্যাক্টিভিটি। দিনব্যাপী প্যাকেজের সঙ্গে আবার খাবারও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
সকাল, দুপুর বা রাতে খাওয়ার জন্য আছে একটি রেস্টুরেন্ট। আর আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখলে রাতে তাবুতে থাকারও সুযোগ আছে। তবে তামজীদ সিদ্দিক জানান—গ্রীষ্মকাল আর বর্ষাকালে তাবুতে না থাকাই উত্তম। শীতকাল তাবুতে থাকার জন্য আদর্শ সময়।
প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকেই শুরু হয়ে যায় বেসক্যাম্পের কার্যক্রম। ভোরবেলার জন্য আছে প্যাকেজ।
ওয়াল ক্লাইম্বিং, ছয় ধরনের ট্রি টপ অ্যাক্টিভিটি আর নয় ধরনের অন-গ্রাউন্ড অ্যাক্টিভিটি নিয়ে গঠিত এই প্যাকেজে খরচ পড়ে জনপ্রতি ৬৫০ টাকা।
সকাল, দুপুর, বিকাল, সারাদিন বা সারা রাতের জন্যও আছে প্যাকেজ। এগুলোর খরচ পড়বে জনপ্রতি— সকালে ১৬৫০ টাকা, দুপুরে ১৪৯০ টাকা, বিকালে: ১০৫০ টাকা, সারাদিনের জন্য ৩১০০ টাকা এবং সারা রাতের জন্য ৫৫০০ টাকা।
এছাড়াও এখানে আছে ফ্যামিলি প্যাকেজ আর ফ্রেন্ডস হ্যাংআউট প্যাকেজ।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফ্যামিলি প্যাকেজের খরচ জনপ্রতি ৯৯০ টাকা। এখানে ছোট বাচ্চাদের জন্য আছে ক্লে স্টেশন—যেখানে মাটি দিয়ে বিভিন্ন খেলনা তৈরি করা যায়।

আরও আছে লেগো জোন, ট্রি হাউজ, আরসি ট্র্যাক ও দড়ির ব্রিজ পার হওয়ার খেলা।
স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড দেখিয়ে নিতে পারবে ফ্রেন্ডস হ্যাংআউট প্যাকেজ। এর খরচও পড়বে ৯৯০ টাকা। এ প্যাকেজেও বেশ কিছু অ্যাক্টিভিটি থাকে।
সবগুলো প্যাকেজেই আছে নানারকম অ্যাক্টিভিটি— জিপ লাইন, মাড ট্রেইল, র্যাপেলিং, আর্চারি, ক্যাম্প ফায়ার, ওয়াল ক্লাইম্বিং, ট্র্যাম্পোলিন, ট্রি টপ আর অন-গ্রাউন্ড অ্যাক্টিভিটি—সবকিছুই বেশ জনপ্রিয়।
সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ওয়াল ক্লাইম্বিং আর র্যাপেলিং। এটি গাজীপুর বা ফয়েস লেকের বেসক্যাম্পে নেই—আছে শুধু ঢাকার এয়ারফোর্স বেসক্যাম্পে।
প্রায় চার তলা বিল্ডিং উচ্চতার একটি ওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠা আর সেখান থেকে দড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া (র্যাপেলিং)—আগারগাঁও এয়ারফোর্স বেসক্যাম্পের অন্যতম আকর্ষণ।
আগারগাঁও এয়ারফোর্স বেসক্যাম্পে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।
আত্মরক্ষা শিক্ষা, পারফর্মিং আর্টস, আর্ট ক্লাস, গিটার ক্লাস, ইয়োগা সেশন, ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণ—এসবই আছে এয়ারফোর্স বেসক্যাম্পে।

নেই কোনো ঝুঁকি
এত চ্যালেঞ্জিং কাজকর্ম, দৌড়ঝাঁপ, রাতে তাবুতে থাকা—সব মিলিয়ে বেসক্যাম্পে থাকা মোটামুটি ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতা।
চার তলা বিল্ডিং উচ্চতায় বেয়ে ওঠা কিংবা এক গাছ থেকে আরেক গাছে দড়ি দিয়ে তৈরি সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়া—প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলে এগুলো যে কারো জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে বেসক্যাম্পের ১৩ বছরের ইতিহাসে কখনোই কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে নিশ্চিত করেন তামজীদ সিদ্দিক।
তিনি বলেন, "আমাদের তিনটি বেসক্যাম্পের প্রতিটি অ্যাক্টিভিটির জন্য দুই থেকে তিনজন প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ থাকেন। আরও থাকেন পেশাদার ট্রেইনার। অ্যাক্টিভিটি শুরু করার আগে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে একটি ট্রেনিং সেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। করতে হয় ওয়ার্ম আপ—যাতে হঠাৎ করে শরীরের কোথাও টান বা ব্যথা না লাগে।"
"এছাড়াও কেউ যদি কোনো অ্যাক্টিভিটির জন্য আনফিট হন, যেমন—প্রেশার বেশি থাকে বা উচ্চতাভীতি থাকে, তাকে আমরা সেই অ্যাক্টিভিটিতে অংশ নিতে দেই না," যোগ করেন তিনি।
প্রতিদিন সকালে বেসক্যাম্পের প্রতিটি যন্ত্রপাতিতে নিরাপত্তা পরীক্ষার (সিকিউরিটি অডিট) কাজ করা হয়। কোথাও নাট-বল্টু ঢিলা আছে কি না, দড়ি দুর্বল হয়ে গেছে কি না, কাঠ বা বাঁশে ফাটল ধরেছে কি না—সবকিছুই প্রতিদিন ভোরে প্যাকেজ শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষা করা হয়।
জিপলাইন বা র্যাপেলিং-এর জন্য শরীরে যে সিকিউরিটি হার্নেস বা রশি লাগানো হয়, তার সবই ফ্রান্স থেকে আনা। এই রশিগুলো একবারে দুই হাজার কেজি ওজন বহনে সক্ষম। তাই স্বাস্থ্যবান কেউ চাইলেই জিপলাইন বা র্যাপেলিং করতে পারবেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
"আজ থেকে দশ বছর পর নিজের প্রতিষ্ঠান বেসক্যাম্পকে কোথায় দেখেন?"—এই প্রশ্নের জবাবে তামজীদ সিদ্দিক বলেন, "বেসক্যাম্প শহুরে মানুষদের জন্য। শহরের বাইরে নিলে এটি চলবে না আর।
"দুটি কারণ এর পেছনে। প্রথমত, মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলের মানুষ স্বভাবতই এসব অ্যাক্টিভিটি করে থাকেন। দ্বিতীয়ত, বেসক্যাম্পের খরচ। এটি শহুরে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য সহজলভ্য। আমরা দেশের প্রধান শহরগুলোতে বেসক্যাম্প নিয়ে যাব।"
তিনি আরও বলেন, "আমার দেশের ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। বাংলাদেশে ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের যথাযথ ইচ্ছার অভাবে দেশের ট্যুরিজম সামনে এগোতে পারছে না।"
"দেশের ট্যুরিজম যেন বিশ্বমানের হয়—সে লক্ষ্যে আমাদের কিছু প্রজেক্ট আছে। যেমন, বান্দরবানের মুনলাই গ্রামে হোম-স্টে এক্সপেরিয়েন্স অফার করছি আমরা। এমন আরও কিছু প্রজেক্ট সামনে আসবে আমাদের," যোগ করেন তিনি।
ঢাকার বুকে এয়ারফোর্স বেসক্যাম্প এনেছে অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি।
কংক্রিটের শহরে নয়টা-পাঁচটার একঘেয়ে অফিস করে হাঁপিয়ে ওঠে আমাদের মন ও শরীর। ভিন্ন ধাঁচের বিনোদনে বন্ধু-বান্ধব বা পরিবার নিয়ে মেতে উঠতে চাইলে—এয়ারফোর্স বেসক্যাম্প হতে পারে আদর্শ গন্তব্য।
ছবি কৃতজ্ঞতা: এয়ারফোর্স বেসক্যাম্প