বোয়িং-এর জ্বালানি সুইচ নিয়ে ৭ বছর আগেই সতর্ক করেছিল এফএএ, আমলে নেয়নি এয়ার ইন্ডিয়া

ভারতের এয়ার ইন্ডিয়ার গত মাসের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের দুইটি ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ হঠাৎ করেই 'কাট-অফ' [বন্ধ] অবস্থানে চলে যায়। এতে ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ শক্তি হারায় বিমানটি।
ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারে একজন পাইলটকে অপরজনকে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়—'তুমি কেন ফুয়েল কাট-অফ করেছো?' জবাবে আরেকজন বলেন, 'আমি করিনি।'
কাট-অফ অবস্থান থেকে সুইচ দুটো স্বাভাবিক ইন-ফ্লাইট অবস্থানে ফিরিয়ে আনার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইঞ্জিন পুনরায় চালু হয়। তবে বিধ্বস্ত হওয়ার সময়, একটি ইঞ্জিন ধীরে ধীরে পুনরায় কার্যকর হচ্ছিল, অন্যটি চালু হলেও পুরোপুরি শক্তি ফিরে পায়নি। সাধারণত অবতরণের পরই কেবল এই কাট-অফ সুইচ ব্যবহার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সুইচগুলোর অবস্থান ও আচরণ—বিশেষ করে এগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কি না—তা এখন নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। কারণ, উড্ডয়নের পরপরই দুটি ইঞ্জিনের ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ এক সেকেন্ডের ব্যবধানে 'কাট-অফ' অবস্থায় চলে যাওয়াকে স্বাভাবিক মনে করছেন না কেউ।
এর আগে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বোয়িং-এর ৭৩৭ মডেলের ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচের 'লকিং ফিচার' অকার্যকর থাকা নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছিল।
ওই নির্দেশনায় বোয়িং ৭৮৭ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, কিন্তু তদন্তে উঠে এসেছে—দুর্ঘটনাকবলিত ৭৮৭ বিমানেও একই ধরনের ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ ছিল।
ওই সময় ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচের লকিং ব্যবস্থার ত্রুটি তুলে ধরলেও, সেটিকে তখন অতি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেনি এফএএ। ফলে সংস্থাটি কোনো এয়ারওয়ার্থিনেস ডিরেকটিভ (এডি) জারি করেনি—যা বাধ্যতামূলকভাবে কোনো ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ সংশোধনের নির্দেশ দেয়।
এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এফএএ-এর সতর্কতা নির্দেশনা 'বাধ্যতামূলক' না হওয়ায় তারাও ওই সুইচের আর পরবর্তীতে নিরীক্ষা করেনি।
তদন্তকারীরা আরও জানিয়েছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির থ্রটল কন্ট্রোল মডিউল ২০১৯ ও ২০২৩ সালে দু'বার পরিবর্তন করা হয়েছিল। তবে সুইচে ত্রুটির কোনো রেকর্ড বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের পর থেকে এ সংক্রান্ত কোনো ত্রুটি রিপোর্ট হয়নি।
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী শন প্রুচনিকি বলেন, 'যদি লকিং ফিচার না থাকে, তাহলে একটাই স্পর্শে সুইচ অফ হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।'
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষক জন ন্যান্সের ভাষায়, 'কোনো সচেতন পাইলট উড়ন্ত অবস্থায় ইঞ্জিন বন্ধ করার মতো ভুল করবে না।'
তদন্তকারীরা এখনো নিশ্চিত হননি যে, কেবল ফুয়েল সুইচের কারণেই এয়ার ইন্ডিয়ার ইঞ্জিন বন্ধ হয়েছিল কি না। তবে এই ঘটনা বিমান ককপিটের নকশা, রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি এবং 'অ-আবশ্যিক' নিরাপত্তা নির্দেশনার গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচের লিভার-লক ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি, যাতে দুর্ঘটনাবশত এই সুইচ চালু না হয়ে যায়।

১৯৫০-এর দশক থেকে চালু এই সুরক্ষা প্রযুক্তিতে সুইচ টানার আগে তা 'আনলক' করতে ওপরের দিকে তুলতে হয়। অত্যন্ত নির্ভুলভাবে তৈরি হওয়ায় এগুলো সাধারণত খুবই নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি, অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিতে সুইচগুলোর চারপাশে গার্ড ব্র্যাকেটও থাকে, যাতে আচমকা ধাক্কায় এগুলো নড়ে না যায়।
'এক হাতে একসঙ্গে দুটো সুইচ টানা প্রায় অসম্ভব। তাই এগুলো দুর্ঘটনাবশত সক্রিয় হয়ে গেছে বলা বেশ কঠিন,' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কানাডাভিত্তিক বিমান দুর্ঘটনা বিশ্লেষক বিবিসিকে বলেন।
শন প্রুচনিকি বিবিসিকে বলেন, যদি পাইলটদের কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ফুয়েল সুইচ বন্ধ করে থাকেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—'কেনই-বা কেউ ইঞ্জিনের ফুয়েল সুইচ বন্ধ করবেন?'
তিনি আরও বলেন, 'এটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল, না কি কোনো ধরণের বিভ্রান্তির ফল? যদিও ব্যাপারটি বেশ অস্বাভাবিক শোনায়, কারণ পাইলটরা কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা জানাননি।
'অনেক সময় ককপিটে জরুরি অবস্থায় ভুল বোতাম চাপা বা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়—কিন্তু এখানে সে রকম কিছু ঘটেছে বলে কোনো ইঙ্গিত নেই, এমনকি কথোপকথনেও মনে হয়নি ফুয়েল সুইচ ভুলবশত চাপা হয়েছে। সাধারণত এই ধরনের ভুল তখনই ঘটে, যখন ককপিটে স্পষ্ট কোনো সমস্যা বা গোলযোগ থাকে', যোগ করেন তিনি।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে এখনও নিশ্চিত নন যে এটিই দুর্ঘটনার মূল কারণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ডের (এনটিএসবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিটার গোয়েলজ বিবিসিকে বলেন, 'আমি এ নিয়ে আগে কিছু শুনিনি। এটি সম্ভবত একটি কম পরিচিত এফএএ নির্দেশনা। এমনকি পাইলটদের কাছ থেকেও এ ধরনের কোনো অভিযোগ শুনিনি। যদিও এটি উল্লেখযোগ্য, তবুও এটি মূল সমস্যা থেকে নজর সরিয়ে নিতে পারে।'