কাজাখস্তানের ওপর ট্রাম্পের ২৫% শুল্কারোপের হুমকি: নেপথ্যে কি চীন ঘনিষ্ঠতা?

এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন ট্যারিফ ঘোষণা করলে, সেই তালিকায় কাজাখস্তানের নাম দেখে সেখানকার সরকারি কর্মকর্তারা বিস্মিত হন।
রাশিয়া ও চীনের প্রতিবেশী, খনিজসম্পদে ভরপুর এই মধ্য এশিয়ার দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত সীমিত। উপরন্তু, ট্রাম্পের ঘোষিত নতুন নীতিমালার ব্যাখ্যায় কাজাখ কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, দেশটির যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর হবে না। তা সত্ত্বেও তারা জানায়, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে তারা আলোচনায় আগ্রহী।
কিন্তু চলতি সপ্তাহেই ট্রাম্প প্রশাসন কাজাখস্তানসহ প্রায় দুই ডজন দেশের কাছে একই ধরনের কড়া ভাষার এক চিঠি পাঠায়। চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে ১ আগস্টের মধ্যে, নইলে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় সেখানে।
এ রকম আগ্রাসী পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একপ্রকার নীতির মোড় ঘোরানোর মতো। কারণ, গত এক দশকজুড়েই ওয়াশিংটন কাজাখস্তানকে অর্থায়ন ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অর্থনীতি, বিশেষত খনি খাত উন্মুক্ত করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল।
ঐতিহাসিকভাবে কাজাখস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বেশিরভাগই তেল ও গ্যাস খাতে হয়ে আসছে। দেশটিতে মার্কিন বিনিয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় ২০২২ সালে, এরপর থেকে তা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।
সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের খনি কোম্পানিগুলো কাজাখস্তানের খনিজ সম্পদ আহরণের পথ খুঁজছে। ২০২৪ সালে, দেশটির সরকার আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি খনি অনুসন্ধান করার লাইসেন্স ইস্যু করেছে।
কারণ, কাজাখস্তান সম্ভাব্যভাবে এমন এক অঞ্চল যেখানে রয়েছে বৈদ্যুতিক যান ও আধুনিক প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও রেয়ার আর্থ মেটালের বিশাল ভাণ্ডার। এই উপাদানের বৈশ্বিক জোগান মূলত চীনা কোম্পানিগুলোর দখলে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কাজাখ বিনিয়োগ ব্যাংক টেনিজ ক্যাপিটাল তাদের এক নোটে ক্লায়েন্টদের জানায়, এ অঞ্চলের অনেকেই চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তির প্রভাব সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ভারসাম্যকর শক্তি হিসেবে দেখছিল। এখন, ওয়াশিংটনের কড়াকড়ির কারণে সে আশার বাতি নিভে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংকটির মতে, মার্কিন এই শুল্কের প্রভাব পড়বে কাজাখস্তানের ১০০ মিলিয়ন ডলারের কম, অর্থাৎ মোট রপ্তানির প্রায় ৫ শতাংশ পণ্যের ওপর।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে কাজাখস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে তৈরি করা কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন সেসব প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে এবং আলোচনার জন্য সময় নির্ধারণ করবে।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে কিছু খাত শুল্ক থেকে অব্যাহতি পেলেও ভবিষ্যতে সেগুলোও শুল্কের আওতায় আসতে পারে।
কাজাখস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে, যেখানে আমদানি দ্বিগুণ হলেও রপ্তানি ছিল কম। পুরো মধ্য এশিয়ার মধ্যে কাজাখস্তানই একমাত্র দেশ, যাকে অতিরিক্ত শুল্কের হুমকি দেওয়া হয়েছে। অন্ন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এই শুল্ক 'অন্যায্য বাণিজ্য ভারসাম্য' দূর করতে জরুরি।
যদিও কাজাখস্তান জানায়, তাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য যেমন, ইউরেনিয়াম, ফেরোঅ্যালয়, রূপা ও খনি তেল এই নতুন শুল্কনীতির আওতায় পড়ছে না। তবে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে আরও কিছু ঝুঁকির মুখে রয়েছে তারা।
মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করবে কপার বা তামার আমদানির ওপর। এটি কাজাখস্তানে প্রচুর পরিমাণে উত্তোলন করা হয় এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি খনিজ।
এছাড়া, কাজাখস্তান এখন ব্রিকস জোটের অংশ, যা চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারতসহ উদীয়মান অর্থনীতির একটি প্লাটফর্ম। ট্রাম্প এই জোটকে 'যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নীতির' উদ্যেগ বলে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে জানান, ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরেই কাজাখস্তান ইউরেনিয়াম, সোনা এবং অন্যান্য ধাতুর বিশাল মজুদের জন্য পরিচিত। এ বছর দেশটির সরকার জানিয়েছে, তারা একটি বড় রেয়ার আর্থ মিনারেলের খনি আবিষ্কার করেছে। এর সত্যতা মিললে কাজাখস্তান বিশ্বের অন্যতম বড় রেয়ার আর্থ রিজার্ভের দেশ হয়ে উঠবে। উল্লেখ্য, এই খাতে বর্তমানে চীনের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য।
চীন ও রাশিয়ার ভৌগোলিক ঘনিষ্ঠতা কাজাখস্তানকে এক জটিল কৌশলগত ভারসাম্যে রাখে। দেশটি চায় না যে তাদের কোনও এক প্রতিবেশীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হতে হোক। সে কারণেই তারা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। একই সঙ্গে, তারা মস্কো বা বেইজিংকে বিরক্ত করতেও চায় না।
ইতোমধ্যেই কাজাখস্তান তার পূর্ব প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করছে। গত মাসে দুই দেশ জ্বালানি, মহাকাশ প্রযুক্তি, কৃষি ও ই-কমার্সসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতায় একমত হয়েছে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে কাজাখস্তানের বাণিজ্যিক লেনদেন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দশ গুণ বেশি।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর কাজাখ প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট টোকায়েভ ঘোষণা দেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন 'সোনালী যুগে' প্রবেশ করেছে এবং চীন কোনও রাজনৈতিক শর্ত ছাড়াই সহযোগিতা করছে।
পূর্বে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা কাজাখ খনি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাতেন না। তবে ২০১৮ সালে নতুন বিনিয়োগবান্ধব মানদণ্ড এবং এর পরবর্তী শাসন পরিবর্তনের ফলে বিদেশি আগ্রহ বাড়তে শুরু করে।