ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি: বাংলাদেশের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে মার্কিন ‘উদ্বেগ’ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সম্প্রতি শেষ হওয়া যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিতীয় দফা শুল্ক আলোচনায় একটি প্রাথমিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে তারা নিরাপত্তা উদ্বেগসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।
আজ (১৩ জুলাই) গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন দেশে ফিরে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উদ্বেগের পেছনে চীন একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বিশেষজ্ঞরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ যেন তার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) পক্ষে থাকে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিস্তৃত কৌশল, যার লক্ষ্য হচ্ছে পুরো অঞ্চলজুড়ে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা।
শুল্ক আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে চীনের বাড়তে থাকা বিনিয়োগ এবং দেশীয় কোম্পানিগুলোর মালিকানা ক্রমশ চীনা প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত শুক্রবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই আলোচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল রুলস অব অরিজিন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি চীনা কাঁচামালের ওপর বাংলাদেশ কতটা নির্ভরশীল তা নিয়ে ওয়াশিংটনের যে উদ্বেগ আছে, সেখান থেকে এসেছে এবং তারা এটি কমাতে চায়। এটা তাদের চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলার বৃহত্তর কৌশলের অংশ।'
'বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে বেশি না ঝুঁকে, সেটা নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র'

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) বর্তমান সভাপতি এম হুমায়ুন কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ুক।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'উপদেষ্টা [ফাওজুল কবির] বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাচ্ছে, যার মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুও থাকবে। এর মানে দাঁড়ায়, তারা শুধু বাণিজ্য নয়, বৃহত্তর কৌশলগত ক্ষেত্রেও আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় এবং চায় যেন আমরা চীনের দিকে অতিরিক্ত না ঝুঁকি। পাশাপাশি তারা আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে বলছে।'
তিনি আরও বলেন, 'উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আলোচনা শুধু বাণিজ্য নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তারা আমাদের সঙ্গে একটি বিস্তৃত কৌশলগত সম্পর্কে যেতে চায়।'
তবে এসব আলোচনায় বাংলাদেশের উচিত নিজের প্রয়োজন ও অবস্থান আগে থেকেই পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা—এমনটাই মনে করেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক শক্তি, তাদের চাওয়ার অনেক কিছুই থাকবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রয়োজন ও সক্ষমতা বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবকিছু মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।'
অর্থনৈতিক বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'চীন আমাদের অন্যতম বড় বাণিজ্য অংশীদার। আমরা তাদের কাছ থেকে কাঁচামাল এনে মূল্য সংযোজন করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করি। এই সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হলে আমাদের জন্য বিপদ তৈরি হবে। তাই আমাদের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেখানে পারি সহযোগিতা করা, তবে সীমাবদ্ধতাগুলোও স্পষ্ট করে জানানো এবং আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা।'
তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে হবে, চীনকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলার সক্ষমতা আমাদের নেই। ধরুন, যুক্তরাষ্ট্র চায় আমরা চীনের সঙ্গে গভীর সামরিক সহযোগিতায় না যাই—এটি মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্ভব নয়।'
এ প্রেক্ষাপটে জাতীয়ভাবে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। 'যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে, আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রভাব কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত ও স্বার্থভিত্তিক জাতীয় কৌশল। এজন্য ব্যাপক পর্যালোচনার ভিত্তিতে একটি সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া দরকার।'
যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে নিরাপত্তা বিধান চায়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রস্তুতি দুর্বল

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত কাঠামোগত চুক্তিতে ঠিক কী কী নিরাপত্তা উপাদান অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তা সরকার স্পষ্টভাবে না জানালে নিরাপত্তা বিধানের প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় জোট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্বেগ কি এখানে এড্রেস করা হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'না, বিষয়টি এর চেয়েও গভীর। তবে আমি এই মুহূর্তে অনুমান নির্ভর কিছু বলতে চাই না।'
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর নিরাপত্তা উদ্বেগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে এখন তাদের প্রাথমিক ইস্যু হলো চীন। তাদের বৃহত্তর কৌশলগত উদ্বেগগুলো সবই চীন-সম্পর্কিত। বাংলাদেশের বিষয়ে নির্দিষ্ট উদ্বেগের কথা বলতে গেলে, আমি মনে করি এটি হবে সমুদ্র নিরাপত্তা। সেখানেই তারা কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আসতে চাইতে পারে।'
বাংলাদেশের মার্কিন নিরাপত্তা দাবি প্রত্যাখ্যানের পরিণতি সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'যদি বাংলাদেশ নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া প্রত্যাখ্যান করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো শুল্ক ছাড় দিতে রাজি হবে না।'
মুনিরুজ্জামান আলোচনার পদ্ধতি নিয়েও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'যে ধরনের আলোচনা দল পাঠানো উচিত ছিল, তা পাঠানো হয়নি। বেসরকারি খাতকে সম্পূর্ণরূপে এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত ছিল, কারণ তারা এই বিষয়গুলো বোঝে। ভিয়েতনামের দিকে তাকান, তারা শক্তিশালী ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করেছিল যারা আলোচনার সম্পূর্ণ পথ সম্পর্কে খুব ভালো ধারনা রাখে। আমরা সেরকম কিছুই করিনি।'
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, 'আলোচনার প্রথম দফা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঠিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আলোচনা করছিলেন এবং তিনি বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার জন্য সঠিক ব্যক্তি নন। আমরা ধারাবাহিক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছি এবং এখন শেষ মুহূর্তে আমাদের হাত বাঁধা পড়ে গেছে।'
যুক্তরাষ্ট্র যদি স্পষ্টভাবে দাবি করে, তাহলে বাংলাদেশ চীনকে এড়িয়ে চলতে পারবে কিনা, জানতে চাইলে এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এটা খুব কঠিন হবে, প্রায় অসম্ভব। চীন আমাদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং আমাদের প্রতিরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। এই ক্ষেত্রগুলোতে অনেক আগে থেকেই ব্যাপক গবেষণা করা উচিত ছিল।'
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামগ্রিক আলোচনার অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আলোচনাগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। তাই এখন আমরা দুর্বল অবস্থান থেকে আলোচনা করছি, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শর্ত আরোপ করা সহজ করে তুলেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ভিয়েতনাম ইতিমধ্যেই দেড় থেকে দুই মাস আগে তাদের আলোচনা চূড়ান্ত করেছে। তারা ২০ শতাংশ শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেছে। ভিয়েতনাম তৈরি পোশাকে আমাদের সরাসরি প্রতিযোগী। যদি তারা ২০ শতাংশের সুবিধা পায় এবং আমরা এর সমপরিমাণ বা এর চেয়ে বেশি পাই, তবে (যুক্তরাষ্ট্রে) আমরা বাজার হারাবো।'
তিনি যোগ করেন, 'ভারতও সম্ভবত ২০ শতাংশ বা তার চেয়ে কম শুল্ক নিয়ে আলোচনা করবে। যদি তাই হয়, তবে আমাদের প্রধান প্রতিযোগীরা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো শুল্ক হারে আলোচনা করবে।'