শিগগিরই ঐকমত্য কমিশনে ‘অমীমাংসিত’ ৪ ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বিএনপি

- কিছুটা ছাড় দিয়ে সমঝোতায় পৌছাঁতে রাজি
- চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কমানো নিয়ে আলোচনা
- সর্তকতার সঙ্গে কর্মসূচি নির্ধারণ না করলে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে সুযোগ পাবে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের 'অমীমাংসিত' চার ইস্যু নিয়ে বিএনপিতে আবারও আলোচনা হয়েছে। এই চারটি বিষয় হলো– সংসদে উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, নারী আসনে নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে পারেনি দলটি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এসব ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দুই-একদিনের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জানিয়ে দেবে বিএনপি। কিছুটা ছাড় দিয়ে সমঝোতায় পৌছাঁতে চায় দলটি।
গত বুধবার রাতে দলটির সর্বোচ্চ নীতি-নিধারণী ফোরাম—স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সে আলোচনা শেষ না হওয়ায়, আজ বৃহস্পতিবার রাতে আবারো বৈঠক এই ইস্যু নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির ৩১ দফায় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদের উচ্চকক্ষের প্রবর্তনের কথা বলা আছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া সব দলই নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ অথাৎ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে।
এদিকে সংসদে উচ্চকক্ষের বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করলেও – জট লেগেছে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। বিএনপি চায় নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বন্টন। তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ইসলামী আন্দোলনসহ ২০টির বেশি দল পিআর পদ্ধতিতে (ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে আসন বন্টন) উচ্চকক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাবে অনড় রয়েছে। এই বিষয়ে আগামী সপ্তাহের ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে উচ্চকক্ষ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সূত্র জানায়, বিএনপি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাবে অনড় থাকবে। যেহেতু উচ্চকক্ষ প্রবর্তনের প্রস্তাবটি বিএনপির ৩১ দফায় আছে, ফলে এই বিষয়ে দলটি প্রকাশ্য কোনো বিরোধে জড়াবে না।বরং কিছুটা হলেও ছাড় দিতে পারে বিএনপি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান দ্বন্দ্ব ও বিভেদ কিভাবে দূর করা যায়— তার উপায় নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। তখন বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বলেন, এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে সামনে আরও দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকবে। তখন তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। ফলে এই দ্বন্দ্ব কমিয়ে সব দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে।
বৈঠকে গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে আওয়ামী লীগের হামলা, এবং চারজন নিহতের ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেন বৈঠক অংশ নেওয়া সদস্যরা। তারা মনে করেন, পতিত ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সমর্থকেরা পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য আক্রমনের ঘটনা ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ না করলে—গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে সুযোগ করে দেওয়া হবে।
তবে বৈঠক সূত্রে জানা যায়, এনসিপির বিভিন্ন কার্যক্রমে বিরক্ত দলটি। রাজনীতির থেকে অপরাজনীতি বেশি করছে বলে মনে করছে তারা। এমনকি এই দলটির মধ্যে জামায়াতের প্রতিচ্ছবিও দেখতে পাচ্ছে। তবে গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেয়া দলটি সুষ্ঠু ধারায় রাজনীতির প্রত্যাশা করে বিএনপি। গতকাল গোপালগঞ্জ দলটির শীর্ষ নেতাদের উপর হামলা পর নিজেরদের ভুল শুধরে ইতিবাচক রাজনীতি ফিরবে, এমনটায় আশা করছে বিএনপি।
গোপালগঞ্জে হামলার পর জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের আচারণগত পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছে বিএনপি। আপাতত দলটির দেশব্যাপী চলমান পদযাত্রা ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নজর রাখবে। কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্তে নিবে দলটি।
এদিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে যুবদলের এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "আমরা প্রত্যাশা করি নাই পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির উপর হামলা করার সাহস পাবে৷ কিন্তু কেনো হামলা হলো? এই কেনোর জবাব হলো- যারা নতুন রাজনৈতিক দল সংগঠিত করেছে, যাদের এখনো নিবন্ধন নাই, তারা অনেক আবেগতাড়িত হয়ে অপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে। সেইসব রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে আজ দেশের মানুষ অবলোকন করলো গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির উপর ফ্যাসিস্ট শক্তি হামলে পড়লো। সুতরাং রাজনৈতিক ময়দানে আরো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য আমরা পরামর্শ সব সময় দিয়েছি, আজও দিচ্ছি। আমরা তোমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভবিষ্যতে তোমরা অনেক অবদান রাখবে।"
বুধবারে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা অভিযোগ করেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে বিঘ্নিত করার জন্য এবং আগামী ফেব্রয়ারি মাসে প্রতিশ্রুতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। মবোক্রেসি, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অযোগ্যতা এবং নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বিএনপি সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বলা হয়, সম্প্রতি মিডফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডে বিএনপিকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জড়িয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শিষ্টাচার বিবর্জিত বক্তব্য গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। বিশেষ কর্ স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম), বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বিবর্জিত যেসব অশ্লীল বক্তব্য ও স্লোগান দেওয়া হয়— তা গোটা জাতিকে বিক্ষুব্ধ করেছে। সভায় এইসব কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানানো হয়।
বিএনপি মনে করে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবেশকেই বিনষ্ট করবে না, একইসঙ্গে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি পারস্পরিক মর্যাদা ও সৌহার্দ্যের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এই ধরনের অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
বুধবার রাত ৮ টা ৪০ মিনিটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শুরু হয়। শেষ রাত ১১ টা ২০ মিনিটে। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে আর উপস্থিতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।