মানব বাবুর বাড়ি: হারিয়ে যাওয়া জমিদারি প্রথার চিহ্ন বয়ে বেড়ানো শেষ জীবিত জমিদার
বিকেলের শেষ আলোয় নীরব হয়ে আছে কিশোরগঞ্জের গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ির বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। চারপাশে শুধু পাতার মর্মর ধ্বনি, পুকুরপাড়ে ভেসে বেড়ানো পাখির ডাক। এই নিস্তব্ধতার কেন্দ্রে বসে আছেন এক বৃদ্ধ মানুষ। সাদাসিধে গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরনে, চেয়ারটি অস্তগামী সূর্যের দিকে হেলে আছে।
অতিথিরা আসেন দ্বিধা নিয়ে। বুঝে উঠতে পারেন না, এখানে প্রবেশ মানে ইতিহাসে ঢোকা, নাকি কেবল এক বৃদ্ধের বাড়িতে আসা। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ান, মুখে মায়াভরা হাসি, হাত নেড়ে স্বাগত জানান সবাইকে। তিনি মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, সবার কাছে যিনি শুধু 'মানব বাবু'। সরকারি নথিতে এ বাড়ির নাম গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি হলেও, আশপাশের মানুষ এটিকে ডাকেন 'মানব বাবুর বাড়ি'।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জমিদারবাড়ি আজ ধ্বংসস্তূপ—কোথাও ভাঙা দেয়াল, কোথাও আগাছায় ঢাকা খিলান। যে সঙ্গীত ও হাসির রেশ একদিন ভেসে বেড়াত, তা এখন কেবল স্মৃতি। কিন্তু গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি ভিন্ন। এখানে এখনও এক জমিদার বাস করেন, নিজের গল্প শোনান, অপেক্ষায় থাকেন অচেনা অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য।
সময়কে ধারণ করে যে বাড়ি
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নে দাঁড়িয়ে আছে গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি। আঠারো শতকে নির্মিত এই প্রাসাদ উত্তরবঙ্গের বিশাল জমিদারবাড়িগুলোর মতো না হলেও, এর গ্রিক ধাঁচের স্তম্ভ আর দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার একসঙ্গে ক্ষমতা ও শৈল্পিকতার ছাপ বহন করে।
জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দিননাথ চক্রবর্তী। ব্রিটিশ আমলে তিনি এখানে বসতি গড়েন। তার ছেলে অতুল চন্দ্র চক্রবর্তী আঠারোবাড়ির জমিদারের কাছ থেকে জমি কিনে জমিদারি সম্প্রসারণ করেন। বাড়ির প্রধান ফটক, যা আজও অটুট, অতুলের ছেলে শ্রীধরের নামে 'শ্রীধর ভবন' নাম পায়।
পরে উত্তরাধিকার যায় ভূপতি চক্রবর্তীর হাতে, যিনি ছিলেন শেষ স্বীকৃত জমিদার। বর্তমানে তার ছেলে মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী এ বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।
আয়তনে ছোট হলেও এ জমিদারবাড়ি বিস্তৃত ছিল প্রায় ১০ একর জুড়ে। ছিল কাচারিঘর (রাজস্ব অফিস), নহবতখানা (সঙ্গীত মঞ্চ), অতিথিশালা, মন্দির ও পাথরের সিঁড়ি ঘেরা প্রশস্ত পুকুর। ভেতরে আজও দেখা যায় খোদাই করা খাট ও কাঠের আসবাব, যা ফিসফিস করে বলে যায় সেই দিনের গল্প—যখন কর্মকর্তা, সংগীতজ্ঞ ও অতিথিদের পদচারণায় মুখর ছিল আঙিনা। ফটকের ওপর এখনো খোদাই আছে সংস্কৃত ভাষায় 'স্বাগতম'। মূল প্রবেশপথের খিলানেও শ্রীধরের নাম লেখা, সময়ের প্রতিধ্বনির মতো আজও বেঁচে আছে।
যে যুদ্ধ সবকিছু পাল্টে দিয়েছিল
গাঙ্গাটিয়ার জমিদারবাড়ির দেয়াল ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাড়ি হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠা এই স্থাপনা শত্রুর চোখ এড়ায়নি। স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ চালায় বাড়িটিতে।
সেই রাতেই মানব বাবুর বাবা ভূপতি চক্রবর্তীসহ পরিবারের কয়েকজন নিহত হন। তাদের লাশ ফেলে রাখা হয় সতর্কবার্তার মতো—এই মাটির প্রতি আনুগত্য দেখাতে কত বড় মূল্য দিতে হয়, তা যেন সবার চোখে পড়ে। পরিবারের বাকিরা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। কিন্তু তরুণ মানব বাবু দেশ ছাড়েননি।
'আমার বাবা-পুর্বপুরুষরা এখান থেকেই জমিদারি চালিয়েছেন,' স্মৃতিচারণে বলেন তিনি। কণ্ঠ ছিল স্থির, কিন্তু কথায় চাপা যন্ত্রণা। তিনি বলেন, 'আজ জমিদারি নেই, আত্মীয়রাও নেই। তবু আমি এই মাটি ছাড়ব না। এখানেই মরব।'
বাড়ির ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে সরল স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৭১ সালে নিহতদের স্মরণে সেখানে কেউ নীরবে, কেউবা প্রার্থনায় মাথা নত করেন। বোঝা যায়—মুক্তিযুদ্ধ শুধু বইয়ের গল্প নয়, গাঙ্গাটিয়ার প্রতিটি ইট-পাথরে তা লেখা আছে।
গাঙ্গাটিয়ার শেষ জমিদার
জমিদারি প্রথা অনেক আগেই উঠে গেছে। তবে গাঙ্গাটিয়ায় আজও তার আবহ টিকে আছে। স্থানীয়রা মানব বাবুকে ডাকেন 'জমিদার সাহেব'। অথচ নেই ধন-সম্পদ বা চাকর-চাকরানি। বয়স ৯২ বছর। ধীরে হাঁটেন, কিন্তু ভঙ্গিতে ভর করে আছে শিকড়ের গাম্ভীর্য।
যুদ্ধের পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেননি। ১৯৭৪ সালে গ্রামের মানুষ অনুরোধ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে। মানব বাবু তখন বলেছিলেন, 'আমি কখনো রাজনীতি করি নাই। মানুষ নিজেরাই আমার কাছে এসে বলেছে তাদের হয়ে দাঁড়াতে। আমি শুধু তাদের জন্যই দাঁড়াই।' সেই নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। বহু বছর ছিলেন সহজ-সরল, ন্যায়পরায়ণ জনপ্রিয় নেতা।
গাঙ্গাটিয়ার জমিদারবাড়ি আজও খোলা। তবে এটি কোনো জাদুঘর নয়, বরং জীবন্ত সংস্কৃতির আসর। সন্ধ্যায় আঙিনায় বসে বৈঠকি গান। হারমোনিয়াম, তবলা আর বাঁশির সুর ভেসে যায় পুকুরপাড়ে। জমিদারি যুগের পৃষ্ঠপোষকতার ঐতিহ্য যেন আবার ফিরে আসে।
কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, এমনকি সিলেট থেকেও সংগীতশিল্পীরা আসেন। মাঝে মাঝে মানব বাবু নিজেও গান ধরেন। দুর্বল শরীরের ভেতর থেকে ভেসে ওঠে আশ্চর্য শক্তির এক কন্ঠ।
হেসে তিনি বলেন, 'এই সব আসর আমি ভীষণ উপভোগ করি। মনে হয় যেন পুরোনো দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে।'
জীবিত কিংবদন্তি
গাঙ্গাটিয়ার প্রাঙ্গণে হাঁটলেই চোখে পড়ে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য। কোথাও দেয়ালে ফাটল, কোথাও ভাঙা কার্নিশ, আবার অনেক জায়গায় সংস্কার। সামনের স্তম্ভগুলো আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। সূর্যের আলোয় ঝলমল করে পুকুর। প্রতিদিন ভোরে বেজে ওঠে মন্দিরের ঘণ্টা।
ইতিহাস ছাড়াও জমিদারবাড়ি নতুনভাবে বেঁচে আছে। বাড়ির পাশে মাছের খামার থেকে বাজারে যায় টাটকা মাছ, এমনকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও সরবরাহ করা হয়। এই উদ্যোগেই টিকে আছে পরিবারের জীবনধারা, কর্মচাঞ্চল্যে ভরা জমিদারবাড়ির জমি।
'মানব বাবুর বাড়ি' কোনোদিন ফাঁকা থাকে না। ভ্রমণপিপাসু, শিক্ষার্থী, পর্যটক ও আশপাশের মানুষ নিয়মিত আসেন—একজন জীবন্ত জমিদারের সাক্ষাৎ পেতে।
মেহেরপুর থেকে আসা সন্তোষ কুমার বলেন, 'গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ির গল্প বহুদিন ধরে শুনে আসছি। আজ সরাসরি এখানে দাঁড়িয়ে জমিদারের সঙ্গে দেখা হলো। মনে হচ্ছে ইতিহাসের ভেতর প্রবেশ করেছি।'
আশুলিয়া থেকে আসা আনিস মিয়া জানান, 'এখানকার পরিবেশ শান্ত। সবুজ গাছপালা, বাতাস আর নিরবতা মানুষকে টেনে আনে।' প্রতিবেশী ভারত থেকেও দর্শনার্থীরা আসেন। স্মৃতি ও ঐতিহ্যের টানে গড়ে ওঠে সীমান্ত পেরোনো সংযোগ।
জমিদারদের দীর্ঘ ছায়া
জমিদারবাড়ি এক বৃহত্তর কাহিনির অংশ। মোগল আমলের জাগিরদারি থেকে শুরু করে ১৭৯৩ সালের 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' পর্যন্ত, যখন লর্ড কর্নওয়ালিস জমিদারি ব্যবস্থা চালু করেন, এই বাড়িগুলো ধীরে ধীরে ক্ষমতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
এগুলো ছিল আদালত, কোষাগার, সংগীতসভা ও পারিবারিক আবাস। গ্রাম গড়ত, শিক্ষা উৎসাহ দিত, শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা করত—তবু একই সঙ্গে কৃষকদের ওপর আরোপ করত ভাড়া ও কর, যা তাদের কঠোরভাবে বেঁধে রাখত।
স্বাধীনতা ও ভূমি সংস্কারের সময় এসে গেলে অধিকাংশ জমিদার, বিশেষত হিন্দু পরিবারগুলো, ভারতে চলে যান। জমিদারি ভেঙে পড়ে, অট্টালিকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, উত্তরাধিকার ছড়িয়ে যায়। কেবল অল্প কয়েকটি, যেমন গাঙ্গাটিয়া, সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকে।
তবে সেই টিকে থাকা আজ প্রায় দুর্বল। দেয়ালের ভেতরে লুকিয়ে আছে গল্প, কিন্তু মানব বাবুর উপস্থিতিই গাঙ্গাটিয়ার ঐতিহ্যকে আরও জীবন্ত ও স্থায়ী করে রেখেছে।
