শতবর্ষের শঙ্খধ্বনি: বাংলাদেশের বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা
শরতের কাশফুল আর নীলাকাশ, বাতাসে শিউলির মিষ্টি গন্ধ জানান দেয় দেবীর আগমনী বার্তা। মা আসছেন বাপের বাড়ি। তা বাপের বাড়ির মানুষেরও তো আকুলতা কম নয়। তাই দেবী দুর্গার আগমনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। এই সময়ে বাংলাদেশের বনেদি বাড়িগুলোতে শুরু হয় সাজ সাজ রব। ঢাকের বাদ্যি, ধুপ-ধুনোর গন্ধ আর পরিবারের সদস্যদের প্রাণোচ্ছলতায় দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক দারুণ মিলনমেলা।
বাংলাদেশের বেশ কিছু বনেদি বাড়িতে আজও একই সমারোহ আর জাঁকজমকের সাথে পূজিত হন দেবী দুর্গা। রোশনাই থেকে প্যান্ডেল, পূজার প্রসাদ থেকে ধুনুচি নাচ- বছরের এই সময়টা এসব বাড়ির সেই অশীতিপর রূপখানা যেন বোঝাই যায় না। সে সেজে ওঠে নবযৌবনার মতন করে। সারা বছর কর্মব্যস্ততায় কাটানো পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফেরেন মায়ের টানে। বাড়ির আঙিনায় ফের শোনা যায় শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে ভরে ওঠে ঠাকুর দালান। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের মেলবন্ধন আর ভক্তি বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজার এ সমারোহকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। আজ লিখব এমনই কিছু বনেদি বাড়ির পূজার কথা।
নর্থব্রুক জমিদারবাড়ির দুর্গাপূজা: প্রথমে বনেদি, পরে বারোয়ারি
পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোড। রাস্তার মাথায় নর্থব্রুক হল বা লালকুঠির জন্যই এ এলাকার নাম নর্থব্রুক হল রোড। এলাকার সবাই এক নামে চেনে: জমিদারবাড়ি। আমাদের কাছে তথ্য ছিল এখানে প্রতি বছর বিরাট আয়োজন করে দুর্গাপূজা হয়।
জমিদারবাড়ি খুঁজে পেতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হলো। এলাকাবাসীকে জিজ্ঞাসা করে করে আর গুগল ম্যাপের সহায়তায় অবশেষে পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত সেই জমিদারবাড়ি। এ বাড়ির কথা শুনে ধারণা হয়েছিল যে পেল্লাই আকারের কোনো বাড়ি দেখা যাবে। কিন্তু পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপ আর আগাছা জড়ানো ইটের শ্যাওলা ধরা দেয়াল। দোতলার বারান্দায় ঝুলে থাকা মাকড়সায় জড়িয়ে আছে নিদারুণ নস্টালজিয়া। আর এই ভবনই এখন পুলিশ ফাঁড়ি।
কয়েক ঘর মুসলমান পরিবারও বাস করে জমিদারবাড়ির উঠোনের প্রান্তে। উঠোনের শেষ মাথায় বেশ বড় একখানা পূজামণ্ডপ। সেখানে সারা বছরই প্রতিমা বানানো হয়। কিন্তু দুর্গাপূজার সময় ব্যস্ততা থাকে সবচেয়ে বেশি। এখানে তিন পুরুষ ধরে প্রতিমা তৈরি করেন কার্তিক চন্দ্র পাল। এ ঠাকুরদালানের সাথে তাই তার রুটি-রোজগারের বাইরেও রয়েছে এক আত্মিক সম্পর্ক।
এ জমিদারবাড়ির জমিদারি বা জমিদার- কিছুই এখন আর নেই। নেই কোনো উত্তরপুরুষও। বাংলাবাজার এলাকার জমিদার ছিলেন সুধীর চন্দ্র দাস। পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডসহ আশেপাশের এলাকায় ছিল তার অঢেল সম্পত্তি। এ সম্পত্তি রেখে ১৯৭০ সালে মারা যান তিনি। সুধীর চন্দ্র দাসের স্ত্রী ত্রিনয়নী দাস মারা যান পরের বছরই। সময়টা তখন মুক্তিযুদ্ধের বছর।
নিঃসন্তান এই দম্পতির আত্মীয়-স্বজন থাকত ভারতের বহরমপুরে। দেশ স্বাধীনের পর সেখান থেকে কয়েকজন এসে তাদের সম্পত্তির দেখভাল শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের দিকে স্থানীয় কেয়ারটেকারকে দায়িত্ব দিয়ে আবার ভারতে ফিরে যান তারা। এখন এটি দেবোত্তর সম্পত্তি। অর্থাৎ, ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত।
জমিদার সুধীরবাবু বেঁচে থাকা অবস্থায় এ বাড়িতে ধুমধাম করে পূজার আয়োজন করা হতো। পরে সে আয়োজনে অনেকখানিই ভাটা পড়ে। স্বাধীনতার সাত বছর পর ১৯৭৭ সালে এখানে প্রথম স্বরস্বতী পূজার আয়োজন করে নর্থব্রুক হল সার্বজনীন পূজা কমিটি। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হয় দূর্গাপূজা। তখন থেকে এটি জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। জমিদার থাকা অবস্থায় এখানে পারিবারিকভাবে বনেদি বাড়ির আদলে পূজা হলেও, ১৯৭৮ সাল থেকে এখানে অনুষ্ঠিত হতে থাকে বারোয়ারি পূজা। এলাকাবাসীরাই আয়োজন করে এ পূজার। সে বারোয়ারি পূজার বয়েস এখন ৪৭ বছর।
বণিকবাড়ির দুর্গাপূজা, অষ্টধাতুর দেবী প্রতিমা
একখানা সুরম্য দোতলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে ধামরাইয়ের রথখোলায়, ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। সাদা রঙের বাড়িতে রেলিংজুড়ে টেরাকোটার কাজ, উঠোনজুড়ে নরম ঘাস। স্বপ্নময় বাড়িখানার বয়েস ১২০ বছর, দোতলা নিচতলা মিলিয়ে ঘরের সংখ্যা ২৭। নিচতলাতেই ঠাকুরঘর। আর এখানেই বন্দনা হয় দেবী দুর্গার।
বণিকবাড়ির কর্তা সুকান্ত বণিক। কাঁসা-পিতল শিল্পের ব্যবসা তাদের ২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। ৫ পুরুষ ধরে তাদের কাঁসার সঙ্গে বসবাস। এ ব্যবসার দরুন বণিক পরিবারের আর্থিক অভাব অনটন কখনোই ছিল না, বরং ঈশ্বরের কৃপা-ই ছিল বলা চলে। সুকান্ত বণিকের ভাষ্যে, তার ঠাকুরদা সর্ব্ব মোহন বণিক সর্বপ্রথম পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। তখন মাটি দিয়ে দেবী প্রতিমা বানানো হতো প্রতি বছর। আবার দশমীর দিন বিসর্জন।
সর্ব্ব মোহন বণিকের হাত ধরে শুরু হওয়া দুর্গাপূজার বয়স এখন ১০০ বছরের বেশি। এই বনেদি বাড়ির পূজা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেখেছে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। এই পরিবারের বাংলা পঞ্জিকাতে দিনক্ষণ দেখা শুরু হয় পহেলা বৈশাখ থেকেই। উমা (দুর্গা) আসবার দিন গোনা চলতে থাকে।
প্রথমে অবশ্য বণিকবাড়ির এই দুর্গাপূজা বাড়ির ধারের রাস্তায় হতো। তখন বিশাল কলেবরে চলত পূজার আনুষ্ঠানিকতা। যাত্রাপালা, পালাগান চলতো পূজার দিনগুলোতে। তখন আগ্রহেরও কমতি ছিল না আর খাটবার মানুষেরও। একান্নবর্তী পরিবারের সবাই মিলে হাত লাগাতো পূজার কাজে। সে সময়ে পূজার দায়িত্ব বছরান্তে বিভিন্ন শরিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত। এ বছর এক কর্তা, পরের বছর আরেকজন- এভাবেই চলছিল। পরবর্তীতে পূজার হাল ধরেন সুকান্ত বণিকের বাবা ফণিভূষণ বণিক। সুকান্তদের বনেদি বাড়িখানা তৈরির পর পূজা আস্তে আস্তে বাড়ির ঠাকুরদালানে সরিয়ে আনা হয়।
ধামরাই মেটাল ক্রাফটসের স্বত্বাধিকারী সুকান্তের হাতের কাজ দেবী সরস্বতীর কৃপা তো বটেই। কাঁসা-পিতলের নানা প্রতিমা তৈরির কাজ সুকান্ত শিখেছেন বাবার হাত থেকে। সেই থেকেই তার মাথায় আসে পারিবারিক দূর্গা বানানোর চিন্তা। ২০১৭ সালের দিকে সুকান্ত ও তার সাথে কাজ করা বিভিন্ন কারিগরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় অষ্টধাতুর দেবী দূর্গা। অষ্টধাতুর এই প্রতিমায় তামা, কাসা, পিতল, সীসা, দস্তা, সোনা, রুপা ও পারদের সংমিশ্রণে রয়েছে, যা অষ্টগ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
৫২০ কেজি ওজনের প্রায় সাড়ে ৮ ফুট উচ্চতার প্রতিমাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অষ্টধাতুর দুর্গা- এমনটাই দাবি করলেন এই শিল্পী। এরপর থেকে এই অষ্টধাতুর প্রতিমা-ই পূজিত হয় বণিকবাড়িতে।
পারিবারিক পূজার জন্যে নিজস্ব প্রতিমার সাধ ছিল তাদের অনেকদিনের। কিন্তু শেষ অব্দি তা যে সম্পন্ন করতে পারবেন, এমনটা ভাবেননি। পঞ্চমীর দিন দেবীকে তাদের বণিকবাড়ির মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। আবার দশমীতে দেবীর প্রাণ বিসর্জনের পর দেবী মূর্তি তুলে রাখা হয়। বণিকবাড়ির পূজার সময়টাতে এই বনেদি বাড়ি জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বছরের অন্য সময় এ সুযোগ থাকে না।
বনেদি বণিকবাড়ির পূজার সাথে জড়িয়ে আছে দেশভাগের ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি, পাঁচ পুরুষের ব্যবসার গৌরব আর বণিক বংশের অলিখিত প্রতিশ্রুতিনামা, যে প্রতিশ্রুতির জেরে উমা আজও আসেন তাদের বাড়িতে, মেয়ে হয়ে, মা হয়ে। তিনি আসেন পরিবারের সব সদস্যের মুখের হাসি হয়ে, সারা বছরের জমে থাকা দুঃখ ভুলবার টনিক হয়ে।
দুর্গাবাড়ির পূজা, ২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো
পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারে দুর্গাবাড়ির দুর্গাপূজার বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। এই বনেদি বাড়ির পুজার সূচনা হয়েছিল সমাপিকা ধরের শ্বশুরের বাবা উমেশ চন্দ্র ধরের হাত ধরে।
ছেলেবেলায় সমাপিকা বউ হয়ে এসেছিলেন ধর বাড়িতে। সেই তখন থেকেই দেখে আসছেন এ পারিবারিক পূজা। তখন তার বয়স ১২/১৩ এর বেশি হবে না। শাশুড়ি নিজ হাতে পূজার সব কাজ সামলাতেন। সমাপিকা চুপ করে বসে থাকতেন শাশুড়ির কাছে। কখনো উমার জন্য শিউলি ফুলের মালা গাঁথতেন, কাকডাকা ভোরে তুলে আনতেন পুষ্পাঞ্জলির জন্য নানারকম ফুল, বেলপাতা। সবাই মিলে মা দুর্গাকে আটপৌরে করে শাড়ি পরানো, গয়নায় সজ্জিত করা, বাড়ির সদর দরজা থেকে সব দুয়ারে আল্পনা দেওয়া উৎসবের দিনগুলো ছিল যতটা খুশির, ততটা ব্যস্ততারও।
দুর্গাবাড়ির পূজার সময়জুড়ে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজনে ভরে থাকত ঘর। কচি-কাঁচাদের হৈ-হুল্লোড় জমত বাড়ির দাওয়ায়, মেয়ে বউদের গল্পের আসর বসত রান্নাঘরে। শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর পর ধর বাড়ির পূজার দায়িত্ব নেন সমাপিকা দেবীর স্বামী সুরেশ্বর ধর। শাঁখার ব্যবসা ছিল সুরেশ্বর বাবুর। সারা বছর ব্যবসা নিয়ে নানা ব্যস্ততা, ছোটাছুটির মাঝেও সুরেশ্বর দুর্গাপূজার দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকতেন৷ ভাই-বোনের সাথে খুনসুটি, পূজার নানা আনুষ্ঠানিকতা, কলাপাতা করে প্রসাদ বিতরণ- সে এক বিরাট যজ্ঞ।
সমাপিকার বয়স এখন ৭০ ছুঁই ছুঁই। স্বামী হারিয়েছেন ৩৫ বছর আগে। দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে মানুষ করেছেন একমাত্র কন্যাকে। এখন তার নাতনিরও ছেলেপুলে হয়েছে। সমাপিকা কিন্তু আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্বশুরবাড়ির বনেদি পূজাকে। তার বর্তমানে তিনি মেয়ের হাতে ছেড়ে দিতে চান এই পূজার দায়িত্ব।
দুর্গাবাড়ি নামখানা চালু হয় এ বাড়ির প্রথম দুর্গাপূজার সময় থেকে। উমেশচন্দ্র ধর নতুন বাড়ির ভিত তুলেই ঠিক করেন এ বাড়ির নাম হবে মা দুর্গার নামে। তখন শাঁখারিবাজারে পারিবারিক পূজা ছিল এখানাই। বাকিগুলো ছিল বারোয়ারি পূজা। সাধারণত মণ্ডপগুলোতে ষষ্ঠীতে ঘট স্থাপন করে দুর্গা বন্দনা শুরু হয়। কিন্তু দুর্গাবাড়িতে মহালয়ার দিন থেকেই পূজা শুরু হয়ে যায়। প্রতিপদ তিথি থেকে নবরাত্রি পূজার মাধ্যমে মায়ের আগমনী সুর বাজতে শুরু করে। এই পূজার মাধ্যমে দেবী দুর্গা নয়টি রূপে পূজিত হন। এছাড়া এ বাড়ির পূজায় প্রতিদিন চণ্ডী পাঠ হয়ে থাকে।
দুর্গাবাড়ির পূজায় সেদিন ছিল তৃতীয়া। সমাপিকা দেবীর দুই নাতনি মন্দিরা এবং পিয়া ঠাকুরের প্রসাদ প্রস্তুত করছেন তখন। সমাপিকা দেবী বসে বসে নানা নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন। তার মুখেই শুনলাম পুরোনো দিনের কত কথা, কত স্মৃতি- কিছু বেদনাবিধুর, কিছু মধুর। বারেবারেই সুরেশ্বর বাবুর কথা স্মরণ করছিলেন এই বৃদ্ধা। দুর্গাবাড়ির পূজায় সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত চালকুমড়া বলির রীতি আছে। এত ব্যস্ততা আর কাজের ঝক্কিতে বিন্দুমাত্র বিরক্তি দেখা গেল না সমাপিকা দেবীর মুখে।
তিনি জানালেন, মেয়ে যেমন বাপের বাড়িতে এলে আনন্দ পাই, তেমনি আনন্দ বোধ হয় উমা এলে। ভগবান আমাকে দিয়ে সবই করিয়ে নেন, তাই এই বয়সেও পারি। এই বনেদি বাড়ির পূজাখানার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এক কাঠামোর প্রতিমা, একই কাঠামোর মধ্যে মা দুর্গা এবং তার ছেলে-মেয়েরা।
সিলেটের লালব্রাদার্স বাড়ির পূজা, এসেছিলেন কবি নজরুল
সিলেটের লালব্রাদার্স বংশের শেকড় ছিল কাশ্মীরে। তারা ছিলেন কাশ্মীরের বণিক সম্প্রদায়ের। লালব্রাদার্সদের পূর্বপুরুষ বলরাম দাস বাবু কাশ্মীর থেকে মুর্শিদাবাদ চলে এসেছিলেন। নবাব সিরাজদোউল্লার আমলে বুনচাঁদ বাবু চুনাপাথরের ব্যবসার সন্ধানে মুর্শিদাবাদ থেকে চলে আসেন সিলেটে। সিলেটে আসার পর তাদের নতুন বাড়ি তৈরির পর শুরু হয় প্রথম দুর্গাপূজা। সেটাও আজ থেকে ২১৮ বছর আগেকার কথা। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে এই বনেদি পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন দেবীর বন্দনা শুরু করার। বুনচাঁদ বাবু যে দেবীবন্দনা শুরু করেন, তা তার বংশধর বাঞ্চারামবাবু, ব্রজগোবিন্দবাবু, বঙ্কুবাবু পর্যায়ক্রমে চালিয়ে গেছেন।
একসময় সিলেট শহর প্রসঙ্গে এমন এক প্রবাদ প্রচলিত ছিল- 'সিলেট মানেই আলী আমজাদের ঘড়ি, বঙ্কু বাবুর দাড়ি, জিতু মিয়ার বাড়ি আর চাঁদনিঘাটের সিঁড়ি'। সেই জমিদার বঙ্কুবাবুর সময়ে এই বনেদি পূজার জাঁকজমক আরও বেড়েছিল। সে সময়ে এই পরিবারের দুর্গাপূজার জৌলুশ ছিল সিলেটজুড়ে। পৌরহিত্যের জন্যে উড়িষ্যা থেকে ৮ থেকে ১০ জন পুরোহিত আনা হতো। জমিদারবাড়ির জলসা ঘরে আয়োজন করা হতো নাচগানের। সে আয়োজনে ভারতের লক্ষণগাঁও থেকে আনা হতো বাইজি। জমিদার পরিবারের পাশাপাশি প্রজারাও পূজা উপলক্ষে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। এমনটাই জানাচ্ছিলেন সে পরিবারের কন্যা প্রজ্ঞা প্রিয়া।
বঙ্কুবাবুর আমলে দুর্গাপূজায় ষষ্ঠীর দিন থেকে দশমী পর্যন্ত বাড়ির সমস্ত নারী শাড়ি ও পুরুষ ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন। ষষ্ঠীর দিন থেকে প্রজাদের প্রসাদ বিলানো শুরু হতো, যা চলত দশমী পর্যন্ত। মণ্ডপের বাইরে প্রসাদ নেওয়ার জন্যে লম্বা লাইন থাকত দিনভর। শুধু তাই নয়, এই পরিবারের অনেকে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় জওহরলাল নেহেরু, কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকে আসতেন লাল ব্রাদার্স হাউজের পূজায়।
লাল ব্রাদার্স হাউজে কিন্তু দেবী একাই পূজিত হন। প্রথমদিকে দেবী দুর্গা সপরিবার এই বাড়িতে আসতেন। কিন্তু একবার দুর্ঘটনাবশত এই পরিবারের কোনো সদস্যের পায়ে লেগে ভেঙে যায় গণেশ ঠাকুরের প্রতিমা। পরে এ নিয়ে এই পরিবারের এক কর্তা স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকেই উমা আসেন একা, মহিষাসুরমর্দিনীরূপে। এ বাড়ির পূজাখানি শুধু যে পুরোনো তা কিন্তু নয়। লালব্রাদার্স হাউজের পূজার সাথে জড়িয়ে আছে এমন অনেক মানুষের নাম, যারা ছিলেন প্রজাহিতকর। এই পূজা আজও ধরে রেখেছেন সে বাড়ির সুযোগ্য বংশধরেরা। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলেছে। বদলেছে লোক-লৌকিকতা, কিন্তু সেই বনেদিয়ানা রয়ে গেছে আজও।
'বলদে চরিয়া শিবে শিঙ্গায় দিল হাঁক—
শিঙ্গার সুরে মর্ত্যে বাজল ঢাক।
শিবের সনে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী,
আশ্বিন মাসে বাপের বাড়ি আসেন ভগবতী।'
প্রতি বছর আশ্বিন এলেই মা ভগবতী (দুর্গা) আসেন তার বাপের বাড়িতে। সাথে আসেন তার ছেলে-মেয়ে। অন্যান্য নারী শক্তির মতো দেবী দুর্গাও পূজিত হতেন একা। কিন্তু কালের বিবর্তনে, লোকমুখে নানা কথার প্রচলনে আর মৃৎশিল্পীদের কল্পনায় দেবী আর্বিভূত হলেন জগজ্জননী মা রূপে। জমিদার এবং বনেদী বাড়িগুলো দেবীর এই সপরিবার রূপ সৃজনে একখানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বটে। এভাবে শাস্ত্রের সাথে কিংবদন্তী মিলিয়ে দেবী হলেন মাময়ী, যিনি মর্ত্যে আসেন বছরে একবারই এই আশ্বিন মাসে। পঞ্চমীতে দেবীর আগমন আর দশমীর দিন দেবী ফেরেন শিবঠাকুরের কাছে কৈলাশে। তারপর আবারো একটা বছরের অপেক্ষা..।
প্রথম বনেদি বাড়ির পূজা
অনেকেই মনে করেন, দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ে প্রথম দুর্গাপূজা করেন কংস নারায়ণ রায়। রাজশাহীর তাহিরপুর রাজবংশের রাজা ছিলেন কংস নারায়ণ রায়। এটিকেই বাংলার ইতিহাসের প্রথম বনেদি দুর্গাপূজা বলা হয়ে থাকে। ৮৮৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের মহাষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার মাটির প্রতিমা গড়ে ঘট স্থাপন করা হয়েছিল। এই দুর্গাপূজা হয়েছিল রাজবাড়ির প্রধান ফটকের পাশের একটি বেদিতে। ১৪৮০ সালে সেখানের রামরামা গ্রামে এ পূজার আয়োজন করা হয়। সে পূজার চাকচিক্যময় আয়োজন নিয়ে আজও নানা কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে।
আরেকটি মত এই যে, বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হয় রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সময়কালে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পরে রাজা নবকৃষ্ণ শোভাবাজার রাজবাড়িতে এই দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। কথিত আছে, ইংরেজদের সন্তুষ্ট করতে এই পূজায় রাজা ধুমধাম করেছিলেন অনেকখানি।
ঢাকায় যেমন ছিল দুর্গাপূজা
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও লেখক ভবতোষ দত্ত (১৯১১-১৯৯৭) তার আত্মজীবনী সাত দশক গ্রন্থে ঢাকার দুর্গাপূজা সম্পর্কে লিখেছেন, 'পূজা দেখতে যেতাম সূত্রাপুরের (মৈসুণ্ডি) বাবু নন্দলালের বাড়িতে, যেখানে দোতলাসমান বড় প্রতিমা হতো। সবচেয়ে বেশি যেতাম টিকাটুলি ছাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজায়। আমরা সবাই মিলে কাজ করতাম। ভিড় সামলানো থেকে দর্শনার্থীদের জুতার খবরদারি করা পর্যন্ত।সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন, আমরাও তাতে যোগ দিতাম।' প্রসঙ্গত, নন্দলাল বাবু তখন ছিলেন সূত্রাপুরের বড় ব্যবসায়ী। ভবতোষ দত্তের লেখা থেকে বোঝা যায় তখনো ঢাকায় দুর্গাপূজা সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। বরং বেশির ভাগই ছিল বনেদি বাড়ির পূজা। বারোয়ারি পূজার চল তখন কলকাতার আশপাশের জায়গাগুলোতে আস্তে আস্তে হচ্ছিল বটে। কিন্তু ঢাকা তখনও বৈষ্ণবদের ঘাঁটি। তখন ঝুলন উৎসব এবং জন্মাষ্টমী সম্পর্কে যতখানি জাঁকজমক পুরান ঢাকায় ছিল, ততখানি দেখা যেত না দুর্গাপূজায়। দুর্গাপূজা ছিল অভিজাতদের নিজস্ব আয়োজনে চেনা গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকা এক উৎসব, যেখানে দরিদ্রের প্রবেশাধিকার ছিল না একেবারেই।
বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এ যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এই পূজার প্রতিটি শঙ্খধ্বনিতে মিশে আছে শতাব্দীর ইতিহাস আর পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ। প্রতিটি বাড়িতে মা দুর্গা যতখানি দেবী হিসেবে আসেন, তার থেকে অনেকখানি আসেন আদরের দুলালী হিসেবে। তাই দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতায় থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া আর ভালোবাসার বন্ধন। এভাবেই বেঁচে থাকুক বনেদি বাড়ির ঐতিহ্যবাহী পূজাগুলো। একান্নবর্তী পরিবারের সংখ্যা কমছে। তবু পূজার চারটে দিন সব মান-অভিমান ভুলে পরিবারের সবাই বসুক পাশাপাশি।
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন
