রংপুর গলি: রাতের গুলশানের এক ভিন্ন রূপ
গুলশান—ব্যস্ত নগরী ঢাকার অন্যতম আলিশান ও বিলাসবহুল এলাকা। সুউচ্চ আধুনিক ভবন, দামি হোটেল-রেস্টুরেন্ট আর বড় বড় কর্পোরেট অফিসে ভরা এই অঞ্চল। তবে গুলশানের এই বিলাসী রূপের বাইরেও আছে আরেকটি চেহারা, যা প্রকাশ পায় রাত গভীর হলে।
প্রায় এক বছর আগে থেকে গুলশান ২-এর 'রংপুর গলি' নামের জায়গাটি রাতের খাবারের আড্ডাস্থল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণ গলির মতো নয় এটি। গুলশান ও আশপাশ ছাড়াও পুরো ঢাকা শহর থেকেই মানুষজন ছুটে আসে এখানে। বিশেষত্ব হলো—রাত যত গভীর হয়, এই গলিতে ভিড় তত বাড়ে। কারণ সবার টান একটাই—স্ট্রিট ফুড।
পুরান ঢাকার মতো গভীর রাতে আড্ডা দিয়ে খাওয়ার জায়গা রাজধানীতে আরও আছে। দীর্ঘদিন ধরে পূর্বাচলের নীলা মার্কেট রাতের খাবারের জন্য জনপ্রিয়। সে তুলনায় গুলশানের রংপুর গলি অনেকটা নতুন হলেও দ্রুতই জায়গা করে নিয়েছে ঢাকাবাসীর মনে।
এখানে ফুচকা, চটপটি, কাবাব, চাপ, সি-ফুড, তেহারি, বার্গার, পিজ্জা, নুডলস, সিঙ্গারা, সমুচা, মোমো, সালাদসহ নানা রকম খাবার পাওয়া যায়। ডেজার্টে আছে জুস, কেক, ডাবের পুডিং, আইসক্রিমসহ আরও অনেক কিছু।
গুগল ম্যাপে রংপুর গলি:
তবে এই জায়গার নাম আগে 'রংপুর গলি' ছিল না। কেন নাম পরিবর্তন হলো? কারাই বা এখানে এসে খাবার বিক্রি শুরু করল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমরা হাজির হয়েছিলাম গলিটিতে—ঠিক রাত ১২টার একটু পরেই।
রংপুর চা স্টল থেকে রংপুর গলি
গুলশান ২-এর এই গলির আগে কোনো নাম ছিল না। প্রায় ১৫ বছর আগে এখানে চালু হয় 'রংপুর চা স্টল'। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি আর শুধু চায়ের দোকানে সীমাবদ্ধ নেই। এখন 'রংপুর কনফেকশনারী' নামে পূর্ণাঙ্গ দোকান হয়ে উঠেছে।
এখানে প্রায় ৩০ ধরনের চা পাওয়া যায়। ২০ টাকার দুধ চা থেকে শুরু করে ২০০ টাকার জাফরান চা পর্যন্ত। মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফলের জুসও মেলে এখানে।
রংপুর চা স্টলের স্বত্বাধিকারী আবু সাইদ সেলিম। তার বাড়ি গাইবান্ধায় হলেও দোকানের নাম রেখেছিলেন 'রংপুর চা স্টল'। কারণ গাইবান্ধা জেলা রংপুর বিভাগে পড়ায় বিভাগ ঘোষণার আনন্দে তিনি এই নাম দেন।
প্রথমদিকে গুলশানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চা স্টলটি। অফিসের ফাঁকে কিংবা কাজ শেষে অনেকে আড্ডা দিতে আসতেন এখানে। সেই আড্ডার জায়গা থেকেই মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে যায় 'রংপুর চা স্টল'-এর নাম।
রংপুর কনফেকশনারীর সামনে চা খেতে খেতে একজন নিয়মিত ক্রেতা বললেন, "আমরা ক্লাস শেষে বন্ধুরা মিলে এখানে আসতাম। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম—রংপুরের সামনে আছি। সেখান থেকেই হয়তো গলির নাম হয়ে যায় রংপুর গলি। এখনো প্রায় প্রতিদিনই আসি। অফিস শেষে কলিগ আর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিই।"
শুরুর পর থেকেই রংপুর চা স্টল গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকত। রাতের ঢাকায় চায়ের আড্ডার জায়গা হিসেবে গুলশানবাসীর পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে এটি। তবে রাতের বেলা যারা ঘুরে বেড়াতেন বা আড্ডা দিতেন, তাদের জন্য শুধু চা যথেষ্ট ছিল না। গভীর রাতের ক্ষুধা মেটাতে সবাই দামি রেস্টুরেন্টে যেতে পারতেন না। সেই চাহিদা থেকেই এই গলিতে শুরু হয় 'রাতের কাবাব'।
রাতের কাবাব বদলে দিল গলির স্বভাব
রংপুর গলিতে ক্ষুধার্ত রাতজাগা মানুষের জন্য চালু হয়েছিল 'রাতের কাবাব' নামের একটি ছোট রেস্তরাঁ। উদ্যোক্তা মাসুদ রানা ও তার মহাজন মোহাম্মদ নূর ইসলাম আগে থেকেই গ্রিল-চাপ ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। গলিতে এসে তারা বুঝলেন—রাতভর জমজমাট ব্যবসার সুযোগ রয়েছে।
২০২৩ সালে তারা দু'জন মিলে শুরু করেন 'রাতের কাবাব'। টিনশেডের ঘরে সাদামাটা আয়োজন—প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল, স্বল্প আলো। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে অজপাড়াগাঁর টঙ ঘরে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু এই সাধারণ পরিবেশের মধ্যেও মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল।
রেস্তরাঁর সামনে মাসুদ রানা লম্বা কয়লার চুলায় মশলা মাখানো মাছ ও মুরগি সাজাচ্ছিলেন। এখানে পাওয়া যায় মাছ ও মুরগির কাবাব, গ্রিল আর চাপ। তেলাপিয়া, কোরাল, রূপচাঁদাসহ সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউ সবচেয়ে জনপ্রিয়। পাশাপাশি আছে মুরগির হারিয়ালি কাবাব, রেশমি কাবাব, টিক্কা, শিক কাবাব, চাপ, গ্রিল। কাবাবের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় বিভিন্ন ধরনের পরোটা, ঘরোয়া সস আর সালাদ।
গ্রাহক টানতে রাতের কাবাবের কৌশলও অভিনব। কয়লার চুলার ওপরে রাখা দুটি স্পিড ফ্যান চারপাশে ছড়িয়ে দেয় ধোঁয়া। মাছ-মাংসের ঝলসানো ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে, আর সেই গন্ধেই ভিড় জমে রেস্তরাঁর সামনে।
মাসুদ রানা বললেন, "এখন যে এখানে মেলার মতো এত দোকান দেখেন—আগে কিছুই ছিল না। আমরা কয়েক বছর আগে রাতের কাবাব চালু করি। সারারাত কাস্টমার আসতে থাকত। ধীরে ধীরে এই এলাকা জমতে শুরু করে। রংপুরে চা খাওয়ার পর অনেকে আমাদের এখানে আসত কাবাব খেতে। এরপর ভাইরাল ফুচকা মামার দোকান চালু হয়। তখন আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিকেলের পর থেকে চুলা জ্বলে, চলে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত।"
রাতের কাবাবের পাশেই 'গুলশান নেহারি ঘর'। এখানে পাওয়া যায় দেশি খাবারের সম্ভার—গরু ও খাসির পায়া-নেহারি, হালিম, খিচুড়ি, তেহারি, ভাত, হাঁস, মুরগি, গরুর মাংস। স্বত্বাধিকারী রুবেল মিয়া বললেন, "আমি দেশি খাবার রাখি দোকানে। রাতের বেলা কেউ ডাল-ভাত খেতে চাইলে তার ব্যবস্থাও আছে। তবে নেহারিটাই সবচেয়ে বেশি চলে।"
গুলশান নেহারির সামনেই 'ভাইরাল ফুচকা মামার' দোকান। এটি রংপুর গলির সবচেয়ে জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুডের জায়গা। ফুচকা, দই ফুচকা, রাজ কাচোরি আর ভেলপুরি পাওয়া যায় এখানে। তাদের দই ফুচকাটাই সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন। ছুটির দিনে এক প্লেট ফুচকা খাওয়ার জন্য ৩০-৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। দোকানের সামনে সবসময়ই থাকে লম্বা ভিড়।
'ফুচকা মামা' নুরুল হক জানালেন, "ছুটির দিনে প্রতি রাতে প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকার ফুচকা-চটপটি বিক্রি হয়। বিশেষ করে দই ফুচকা বানিয়ে শেষ করা যায় না। অনেক ক্রেতা দূর-দূরান্ত থেকে এসে ফুচকা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।"
চার চাকায় রেস্তোরা
রাজন ও তার স্ত্রী রাত্রী দু'জনই চাকরি করেন—রাজন একটি বায়িং হাউজে, আর রাত্রী একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। সারাদিন অফিস শেষে রাতে তারা চলে আসেন গুলশানের রংপুর গলিতে। তবে খেতে নয়, খাবার বিক্রি করতে।
গাড়িতে করেই খাবার বিক্রি করেন তারা। তাদের গাড়ির ট্রাংকই হলো রেস্তোরাঁ। নাম দিয়েছেন 'কারখানা' (Car Khana)। ট্রাংক ভরা থাকে চিপসের প্যাকেট, মুরগি, সালাদ, সস, ক্যাপসিকাম ও মরিচে। এগুলো মিশিয়ে বানানো হয় বিশেষ আইটেম—চিপস মাখা। চাইলে ক্রেতারা নিজেদের পছন্দের চিপসের প্যাকেট নিয়েও আসতে পারেন। বিদেশে ঘুরতে গিয়ে দেখা 'BYOB' বা Bring Your Own Bag ধারণাই রাত্রীর মাথায় এই আইডিয়াটা ঢোকায়।
রাজন জানান, "শখের বশে আমাদের 'কারখানা'র যাত্রা। অফিস শেষে সপ্তাহে কয়েকদিন এখানে আসি। সব খাবার বাসায় তৈরি করি। নতুন স্বাদের জন্য অনেক মানুষ আসে। এখন মাসে লাখ টাকার মতো আয় হয়।"
গুলশানের এই রংপুর গলিতে শুধুই রাজন-রাত্রীর 'কারখানা' নয়। উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের তাহসিন জাহানও রাতের বেলা নিজের গাড়ি নিয়ে আসেন এখানে। দুপুর থেকেই বাসায় তৈরি করেন তেহারি আর জালি কাবাব। রাত ৯টা থেকে ভোর ২টা পর্যন্ত গাড়ি আর খাবার নিয়ে থাকেন রংপুর গলিতে। দিনের বেলা আবার উত্তরার নিজ এলাকাতেও খাবার বিক্রি করেন তিনি।
কেউ অর্ডার দিলে সে অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করেন তাহসিন। ক্যাটারিং সার্ভিসও চালান তিনি। ফেসবুকে 'তাসু'স' নামে একটি পেজ রয়েছে, যেখানে দৈনিক খাবারের আপডেট দেন এবং ক্যাটারিংয়ের অর্ডার নেন।
তাহসিন জানান, "আগে চাকরি করতাম। রান্নার প্রতি আগ্রহ থাকায় এখন এই কাজ করছি। বাসার কাছে বিইউএফটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গাড়ি নিয়ে খাবার বিক্রি শুরু করি। পরে কাজিনরা জানায় গুলশানের রংপুর গলিতে অনেকেই গাড়ি নিয়ে আসে। কোরবানির ঈদের পর থেকে আমিও আসছি। ক্রেতাদের ভালো সাড়া পাচ্ছি।"
পশ্চিমা দেশগুলোয় ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বা ফুড ট্রাক জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে এই ধারা। গুলশানের রংপুর গলিতে রাজন-রাত্রী, তাহসিনসহ অনেকেই গাড়ি নিয়ে আসেন খাবার বিক্রি করতে। আবার কেউ কেউ বাসায় তৈরি খাবার এনে টেবিল বসিয়ে বিক্রি করেন। ঘরে তৈরি এসব খাবারের চাহিদাও অনেক। চিপস মাখা ছাড়াও তেহারি, কাবাব, পিঠা, পায়েশ, কেক, ডাবের পুডিং, জুস—সবই মেলে এই রাতের আসরে।
রাস্তায় রাতভর এমন খাবারের আয়োজন নিয়ে কোনো বাধা এসেছে কি না—এমন প্রশ্নে রাজন বলেন, "কোনো রাজনৈতিক দল থেকে এখন পর্যন্ত ঝামেলা হয়নি, চাঁদাও চাওয়া হয়নি। আগে একবার পুলিশ এসে আমাদের উঠিয়ে দিয়েছিল। তবে গুলশান থানার নতুন ওসি নিয়ম করেছেন, রাত ২টার পরে আর বসা যাবে না। এ শর্ত মানলে তিনি সব সহযোগিতা করবেন বলেছেন। এমনকি নিজের ফোন নাম্বারও দিয়েছেন, যাতে কেউ সমস্যা করলে সরাসরি জানাতে পারি। আমরা সবাই ওসি স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।"