‘অ্যাডপ্ট এ রোড’: যেভাবে নাগরিক মালিকানায় গুলশানের রাস্তা এখন পরিচ্ছন্ন-পথচারীবান্ধব
সকাল হলে ঢাকার রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করে। সেসময় হাওয়ায় ভাসতে থাকে ধুলা-ময়লা ও নাকে এসে লাগে অবহেলায় পড়ে থাকা নালাগুলোর দুর্গন্ধ। তবে গুলশানে এ দৃশ্য কিছুটা ভিন্ন।
এখানকার রাস্তাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচ্ছন্ন, রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় নিয়মিত, আর কোথাও কোথাও সাজানো থাকে গাছপালা ও ফুটপাতগুলোও থাকে রং করা। যানবাহন পুরোপুরি নিয়ম মেনে না চললেও, অন্তত আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলার ব্যাপারে কিছুটা সচেতন।
'নিজেদেরই কিছু করতে হবে। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশের অবস্থা কেমন। যদি শুধু অভিযোগ করি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকি, কিছুই বদলাবে না। আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম, তাই নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছি,' বলছিলেন গুলশানের বাসিন্দা সৈয়দ সাদাত আলমাস কবির। তিনি এলাকার 'অ্যাডপ্ট আ রোড' কর্মসূচির প্রথম দিকের অংশগ্রহণকারীদের একজন।
গুলশান এবং ঢাকার অন্যান্য এলাকার মধ্যে এই স্পষ্ট পার্থক্য এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এটি শুরু হয় ২০১৬ সালে, যখন গুলশান সোসাইটি নগর কর্পোরেশনের অর্ধেক পরিষেবা দেখে হতাশ হয়ে নিজেরা উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেসময় গুলশান সোসাইটির সভাপতি ড. এটিএম শামসুল হুদা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছিলেন, এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে আরও উন্নত করা যায়। গুলশান সোসাইটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শফিকুর রহমান এ বিষয়ে জানান, তাদেরকে নতুন কিছু চেষ্টা করার প্রেরণা দেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি এমন একটি মডেল দাঁড় করাতে চেয়েছেন যেখানে কমিউনিটি নিজেই তাদের রাস্তাগুলোর দেখভাল করবে।
মূল ধারণাটি ছিল—যখন দায়িত্ব সরাসরি বাসিন্দাদের কাছে চলে আসে, তখন তারা তাদের মালিকানার খাতিরেই দায়িত্ববান হবে ও তা যত্ন করবে। যেহেতু গুলশান এমন কিছু এলাকাগুলোর মধ্যে একটি যা এই ধরনের পরীক্ষার যোগ্য ছিল, তাই এখানেই এটি সম্ভব হয়।
এভাবেই জন্ম নেয় 'অ্যাডপ্ট আ রোড' কর্মসূচি। এটি একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ উদ্যোগ। এখানে বাসিন্দা বা কোনো সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি রাস্তা 'অ্যাডপ্ট' করে নেয়। তার পরিচ্ছন্নতা, তদারকি এবং এমনকি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের দায়িত্ব নেয় এবং বিনিময়ে তাদের নিজস্ব এলাকা বাসযোগ্য রাখা সম্ভব হয়।
এটি একটি নাগরিক পরীক্ষা ছিল, তবে ৯ বছর পরও এটি সফলভাবে চলমান রয়েছে।
রাস্তার দায়িত্ব নেওয়া
এই কথাটির স্বভাবেই রয়েছে কিছুটা অভিভাবকসুলভ ভাব। যেমন আমরা একটি শিশু বা পোষা প্রাণীকে গ্রহণ করি, তেমনি গুলশানের ক্ষেত্রে একটি রাস্তার অংশ—এর গর্ত, মিডিয়ান স্ট্রিপ, এবং ঝামেলাপূর্ণ নালাগুলো—'অ্যাডপ্ট' করা হয়।
তবে ধারণাটি সহজ; একজন বাসিন্দা বা একটি সংস্থা একটি রাস্তা এক বছরের জন্য অ্যাডপ্ট করে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত খরচ বহন করে। এটি কেবল পরিচ্ছন্নতাকারীদের বেতন নয়, কমিউনিটি পুলিশের ইউনিফর্ম এবং এর বাইরে সমস্ত খরচও এই চুক্তির মাধ্যমে কাভার করা হয়।
যদি উভয় পক্ষ চায়, এক বছরের চুক্তি বাড়ানো যেতে পারে। যারা পুরো বছরের জন্য দায়ভার নিতে পারছেন না, তাদের জন্য গুলশান সোসাইটি ছোট সময়সীমার বিকল্প নিয়ে এসেছে—যেমন এক মাস বা এমনকি একদিন। যদিও প্রতীকী মনে হতে পারে, এই উদ্যোগটি অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে, এমন মানুষের জন্যও সুযোগ তৈরি করেছে যারা অংশ নিতে চান কিন্তু পুরো দায়ভার নিতে চান না।
প্রোগ্রামের অফিস এক্সিকিউটিভ আল-আমিন হাওলাদার স্কেলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, "গুলশান সোসাইটি এলাকায় মোট ১৪৪টি রাস্তা রয়েছে। এ বছর প্রায় ৭০টি রাস্তা অ্যাডপ্ট করা হয়েছে। সংখ্যাটি পরিবর্তিত হয় বছরে কতজন বাসিন্দা বা সংস্থা চুক্তি করছে তার উপর।"
কিছু রাস্তা ২০১৬ সাল থেকে একই পক্ষ বারবার অ্যাডপ্ট করেছে। আবার কিছু রাস্তার মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে। যে পেরেছ সে নিয়েছে।
এছাড়াও এখানে কিছু নীরব মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব কাজ করে। রাস্তা 'অ্যাডাপ্ট' করার ফলে মালিকানার এমন একটা অনুভূতি তৈরি হয় যা কর এবং শুল্ককে খুব কমই প্রভাবিত করে। বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীরা কেবল একটি ময়লা রাস্তা দেখেন না, তারা দেখে 'তাদের' ময়লা রাস্তাকে দেখেন। ফলস্বরূপ কম আবর্জনা ফেলা হয় এবং রাস্তার প্রতি তারা আরও সতর্ক থাকেন।
এভাবে অবহেলার সম্মিলিত লজ্জাকে সম্মিলিত গৌরবে প্রতিস্থাপন করা যায়। আর গর্ব, অদৃশ্য হওয়া সত্ত্বেও, সরকারের বেশিরভাগ নোটিশের চেয়ে একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে কাজ করে।
অ্যাডপশন বলতে কী বোঝায়
এটি প্রচলিত দান-সহায়তার মতো নয়। এর একটি ম্যানুয়াল আছে। এটিকে আংশিক সংবিধান বলা যেতে পারে। এর মধ্যে রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের বাধ্যবাধকতা লেখা রয়েছে।
একটি রাস্তার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কমিউনিটি কর্মীরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তারা রাস্তার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, অননুমোদিত পার্কিং রোধ করা, সন্দেহজনক কার্যকলাপ রিপোর্ট করা, এবং প্রয়োজনে ট্রাফিকের প্রবাহ সহজ করার কাজ করে থাকেন।
উপস্থিতি নিবন্ধন রাখা হয়, এবং কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম ও উপকরণ—ঝাড়ু, খোঁপা, রেক, ঝুড়ি ইত্যাদি—গুলশান সোসাইটি সরবরাহ করে থাকে।
এর পাশাপাশি তদারকি করা দায়িত্ব গ্রহণকারী ও গুলশান সোসাইটির দায়িত্ব। শুধু অর্থায়ন নয়, তারা কাজের তদারকিও করেন। দায়িত্ব গ্রহণকারীরা পৌর সেবার জন্য মাইক্রোম্যানেজারের ভূমিকা গ্রহণ করেন। কর্মী নিয়োগ, বেতন প্রদানের ও পর্যবেক্ষণের কাজ করে থাকেন।
তাদের প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ, গুলশান সোসাইটি উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব গ্রহণকারীদের সনদ প্রদান করে থাকে। যদিও এটি আনুষ্ঠানিক মনে হতে পারে, এমন ছোট্ট স্বীকৃতি একটি শহরে যেখানে ইতিবাচক স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন, সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
শফিকুর রহমান ব্যাখ্যা করেন, "আমাদের প্রায় ৮০ জন কর্মী আছে যারা ২৪ ঘণ্টা শিফটে রাস্তাগুলো পরিচ্ছন্ন রাখেন, এবং ৬০ জন কমিউনিটি পুলিশ তাদের সঙ্গে কাজ করেন। আমরা আশা করি তারা আন্তরিকভাবে কাজ করবে। যেহেতু তারা আমাদের জন্য কাজ করছে, তাই তাদের যথাযথ বেতনও দিতে হবে। আর 'অ্যাডপ্ট আ রোড' কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা এটি পরিচালনা করি।"
পরিচ্ছন্নতা শুধু প্রক্রিয়ার একটি ধাপ। 'অ্যাডপ্ট আ রোড' কর্মসূচিতে রয়েছে রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন, হ্রদ পরিষ্কার, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কমিউনিটি পুলিশ মোতায়েন। তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথে একসাথে কাজ করে এখানের যান চলাচলকে স্বাভাবিক রাখে। তাই অন্তত গুলশানের গ্রিডে, শহরের অন্যান্য অংশের তুলনায় মাঝে মাঝে ভিন্ন ছন্দ অনুভব করা যায়।
শহরের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে এ এলাকাটিই সবেচেয়ে বেশি সু-শৃঙ্খল। শফিকুর বলেন, "যদি আমরা শুধু এক সপ্তাহের জন্য কাজ বন্ধ করি, পুরো গুলশানের চিত্র বদলে যাবে। যারা এখানে-ওখানে আবর্জনা ফেলে, তারা তখন বুঝবে এই পরিবেশ বজায় রাখতে কতটা পরিশ্রম লাগে।"
মালিকানার নাগরিক সংস্কৃতি
'অ্যাডপ্ট আ রোড' কর্মসূচি এত বিশেষ কেবল কার্যকারিতার জন্য নয়, বরং এর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য। আমরা সাধারণত কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত থাকি এবং চুপচাপ আবর্জনার ওপরে পা ফেলে চলে যাই, কিন্তু গুলশানে মানুষ কঠিন পথ বেছে নিয়েছে, রাস্তাকে তাদের বাড়ির সম্প্রসারণ হিসেবে দেখেন তারা।
তবে এর সব কাজই নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে হয় না।
পরিচ্ছন্ন-নিরাপদ রাস্তাঘাট এবং ভালো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা জীবনের মান এবং সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধি করে। গুলশানের ধনাঢ্য পরিস্থিতিই এই আর্থিক মডেলকে সমর্থন করে। এই ধরনের পরীক্ষা শহরের আর অন্য এলাকায় সম্ভব হবে না। তবে এর গুরুত্ব অনেক। এটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি ঢাকার এমন একটি অংশ যেখানে মালিকানা একটি তাত্ত্বিক নাগরিক বাধ্যবাধকতা থেকে দৈনন্দিন রুটিনে রূপান্তরিত হয়েছে।
বাসিন্দারা স্বীকার করেন, এটি তাদের পরিবেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে। এখন সেই রাস্তাগুলো, যা একসময় পরিচিতিহীন ছিল, তা ব্যক্তিগত, প্রায় পারিবারিক মনে হয়।
এমন একজন বাসিন্দা আশরাফুল হক আসিফ সরলভাবে বলেন, "সত্য কথা বলা যাক। আমাদের দেশে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা তাদের কাজ দায়িত্বপূর্ণভাবে পালন করে না। তারা সরকারের বেতন গ্রহণ করে, কিন্তু আন্তরিক নয়। তাই গুলশানের বাসিন্দারা নিজেদের এলাকায় দায়িত্ব নেওয়া শুরু করেছে। আর গুলশান ঘুরে দেখলেই তার পার্থক্য চোখে পড়ে।"
স্থানীয় সমাধানের সীমাবদ্ধতা
এ কর্মসূচি কিন্তু একটি বড় পার্থক্যের ছবিও আমাদের সামনে তুলে ধরে।
যেমন আশরাফুল বলেন, সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা বেতন পান। এর পাশাপাশি বাসিন্দারাও একই কাজে আরও অর্থ ব্যয় করছেন যাতে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে। বাস্তবে, গুলশানের বাসিন্দারা একটি ছায়াপ্রতিনিধি হয়ে পৌরসভা পরিচালনা করছেন।
ঢাকার জন্য এই দ্বৈত ব্যবস্থা কমিউনিটির স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের ব্যর্থতা দুটোই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। গুলশানে 'মালিকানা মডেল' কার্যকর হচ্ছে কারণ রাষ্ট্র তার পদক্ষেপ থেকে সরে গেছে, এবং একটি ধনী এলাকা নিজেই তার দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য রাখে।
তাই প্রশ্ন থেকে যায়—মোহাম্মদপুর, মিরপুর বা পুরান ঢাকার মতো এলাকায়—এ মডেল সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে কিনা? সেখানকার বাসিন্দারা কি তাদের নিজস্ব রাস্তাগুলোর জন্য অর্থায়ন এবং পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন? নাকি এটি শুধু অভিজাত এলাকার ধনীদের জন্যই প্রযোজ্য এবং বাকি শহর অপ্রতুল সেবার সাথে সংগ্রাম চালাবে?
