ঢাকার রাস্তায় পাহাড়ি খাবারের আড্ডা
বাঙালির সঙ্গে খাবারের যে আত্মিক সম্পর্ক, তা নিয়ে লিখতে বসলে বেলা ফুরিয়ে যাবে। খাবার নিয়ে বই, গান, গল্প, আড্ডা—সবই করি আমরা। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও ভেবে রাখি, সকালে আর দুপুরে কী খাওয়া হবে!
নিজেদের অঞ্চলের খাবার ছাড়াও দেশের নানা এলাকার খাবার আমরা নিয়মিত চেখে দেখি। চট্টগ্রামের মেজবান, রাজশাহীর কালাভুনা, বগুড়ার আলুঘাটি কিংবা সিলেটের সাতকড়া—এসব ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নিতে ভোজনরসিকরা ঘুরে বেড়ান দেশজুড়ে।
এর মধ্যেই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পাহাড়ি অঞ্চলের খাবার। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে সমতলের মানুষের আগ্রহ বরাবরই ছিল। রাজনীতির ঝঞ্ঝাট সরিয়ে যদি শুধু খাবারের দিকে নজর দিই, দেখা যায় পাহাড়ি খাবারে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। এক জাতিগোষ্ঠীর খাবারের সঙ্গে অন্য জাতিগোষ্ঠীর খাবারের যথেষ্ট পার্থক্য পাওয়া যায়।
তবে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যও আছে। যেমন—তারা শাকসবজি, এমনকি মাছ-মাংসও সিদ্ধ করে খান। ঝাল থাকে বেশি, আর শুঁটকি তাদের প্রিয়। ঢাকায়ও অনেকে এসব খাবারের ভক্ত। কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে খাওয়া তো আর সবসময় সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাদের জন্য ঢাকায় আদিবাসীদের পরিচালিত রেস্তোরাঁও আছে—যেমন হেবাং বা জাবা। তবে সবসময় তো আর রেস্তোরাঁতেও যাওয়া হয়ে ওঠে না।
এদিকে ঢাকায় স্ট্রিটফুড দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আগারগাঁওয়ের 'কেকপট্টি' আর সংসদের সামনের রাস্তার ফুডজোন এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত। দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকাবাসী ভিড় জমায় সেখানে নানা পদের খাবারের স্বাদ নিতে। শুধু ঢাকাবাসীই নয়, দূরদূরান্ত থেকেও অনেকে আসেন এই স্বাদের টানে।
ফুচকা, চটপটি, চানাচুর, ঝালমুড়ি, মোমো, চিকেন ফ্রাই, কাবাব, আইসক্রিম, শরবত, কেক—কী নেই এখানে! দেশি-বিদেশি নানা খাবারের আয়োজনেই জমে ওঠে ব্যবসা। বিক্রেতাদের অনেকেই বাসা থেকে রান্না করা খাবার এনে বিক্রি করেন, ফলে ক্রেতারাও খান নিশ্চিন্তে।
এই স্ট্রিটফুডের রাজ্যে নতুন সংযোজন পাহাড়ি খাবার। ঢাকার রাস্তায় এখন অনেক আদিবাসী তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরছেন খাবারের মাধ্যমে। নানা স্বাদের মুংডি ও লাকসু পাওয়া যায় তাদের ফুড কার্টে।
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় কোথায় পাওয়া যায় এসব পাহাড়ি ঐতিহ্যবাহী খাবার? কেমনই বা তার স্বাদ? সেই খোঁজেই একদিন ভরদুপুরে খালিপেটে বেরিয়ে পড়েছিলাম আগারগাঁওয়ের পথে।
আগারগাঁওয়ের টুম্বাস আর ফাদাং তাং
আগারগাঁওয়ের হালের জনপ্রিয় 'কেকপট্টি'তে নানা রকমের স্ট্রিট ফুডের দেখা মেলে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনের রাস্তার দুই পাশ দখল করে বসেছে এসব ফুড কার্ট। আইসিটি রোডের পুরোটা জুড়েই যেন খাবারের উৎসব। সেখান থেকে একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিলেই পরিসংখ্যান রোড, এখানেও জমজমাট আয়োজন।
এই পরিসংখ্যান রোডের একদম শুরুর দিকেই হাতের বাম পাশে চোখে পড়ে আদিবাসী খাবারের দুইটি ফুড কার্ট—একটির নাম 'টুম্বাস', অন্যটির 'ফাদাং তাং'।
'টুম্বাস' চালান রিপেল চাকমা ও ইমেজ চাকমা। রিপেল স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং বিভাগে মাস্টার্স করছেন, আর ইমেজ পেশায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। দিনের ব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যা থেকে তারা একসঙ্গে ফুড কার্ট চালান। প্রায় তিন মাস হলো তারা এখানে বসছেন। আগারগাঁও এলাকায় পাহাড়ি খাবার নিয়ে আসার প্রথম উদ্যোক্তাও তারা। এর আগে ডিএনসিসি উদ্যোক্তা মেলায় ফুড কার্টে পাহাড়ি খাবার বিক্রির অভিজ্ঞতা আছে তাদের।
'টুম্বাস'-এর মেনুতে আছে স্পেশাল মুংডি, কাকড়া ভাজা, পাহাড়ি মাশরুম ভাজা, চাপিলা মাছ ভাজা ও মুরগির লাকসু। দামও সাশ্রয়ী—মুংডি ১২০ টাকা, কাকড়া ভাজা ২০০, মাশরুম ভাজা ১০০, চাপিলা মাছ ভাজা ১০০ এবং মুরগির লাকসু ১০০ টাকা। মুংডি ও লাকসু—দুটি রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী খাবার।
মুংডি একধরনের স্যুপ ও নুডলসের মিশ্রণ। সাধারণ নুডলস নয়—এটি তৈরি হয় রাইস নুডলস দিয়ে, যা সংগ্রহ করা হয় রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে। মুরগির স্বাদের স্যুপে এই রাইস নুডলস, ডিম, শুঁটকি ও নানা মশলার সংমিশ্রণে তৈরি হয় মুংডি।
লাকসু হলো সালাদের মতো একটি খাবার। মশলা দিয়ে মুরগি সেদ্ধ করে হাড় ছাড়িয়ে নেওয়ার পর পেঁয়াজ, মরিচসহ নানা পাহাড়ি মশলা দিয়ে এটি তৈরি করা হয়।
রিপেল বলেন, "আমাদের সবচেয়ে বেশি চলে মুংডি আর লাকসু। আমরা চেয়েছিলাম পাহাড়ি মুরগি দিয়ে লাকসু তৈরি করতে। কিন্তু সমস্যা দুইটা—এক, পাহাড়ি মুরগির দাম অনেক বেশি; দুই, অনেকে সন্দেহ করেন এটা হালালভাবে জবাই করা হয় কি না। তাই আমরা স্থানীয় বাজার থেকেই মুরগি সংগ্রহ করি, যেখানে হালালভাবে জবাই করা হয়।"
'টুম্বাস'-এর কিছুটা সামনে গেলেই দেখা যায় 'ফাদাং তাং'-এর কার্ট। এটি চালান সঞ্চারি চাকমা ও অনিক চাকমা দম্পতি। মুংডি ও লাকসুর পাশাপাশি এখানে পাওয়া যায় মোমো, ব্যাম্বো চিকেন ও লুচি। প্রতি শুক্র ও শনিবার তারা পরিবেশন করেন ব্যাম্বো চিকেন।
আড়াই মাস আগে যাত্রা শুরু করা 'ফাদাং তাং' অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কার্টের পেছনে চেয়ার-টেবিল বসানো হয়েছে, যেখানে বসে খেতে পারেন ক্রেতারা। বিকেলে সেখানে মুংডি ও লাকসু খেতে দেখা গেল এক পরিবারকে।
পাহাড়ি খাবারের স্বাদ কেমন জানতে চাইলে পরিবারের কর্তা বললেন, "পাহাড়ি খাবারের স্বাদ অন্যরকম। আমাদের খাবারের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু খুবই সুস্বাদু। বিকেলে হাঁটতে বের হয়ে এখানে এলাম, মুংডি আর লাকসু খেলাম—দুটোই ভালো। শুঁটকি যারা পছন্দ করেন, মুংডি তাদের দারুণ লাগবে। পরেরবার এসে ব্যাম্বো চিকেন খাওয়ার ইচ্ছে আছে।"
'টুম্বাস' ও 'ফাদাং তাং' প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে।
সংসদ ভবনের সামনে পাহাড়ের স্বাদ
গত বছরের ৫ আগস্ট সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সেখানে আর কোনো অধিবেশন হচ্ছে না। তবে সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায়—অর্থাৎ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ লাগোয়া ফুটপাথে এখন প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত চলতে থাকে স্ট্রিট ফুডের মেলা। ঢাকাবাসীর কাছে বেড়ানোর নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংসদের সামনের এই স্ট্রিট ফুড জোন।
প্রায় সব ধরনের স্ট্রিট ফুডই এখানে পাওয়া যায়। পাশাপাশি বিক্রি হয় নারীদের অলংকার ও প্রসাধনী সামগ্রীও। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। এই জমজমাট মেলায়ও পাহাড়ি খাবারের আলাদা কদর তৈরি হয়েছে। সংসদ ভবনের সামনে এখন বসে পাহাড়ি খাবারের কার্ট—মুংডি ঘর, লাবা তং মুংডি, রো-ওয়া-দো মুংডি ঘর এবং মুংডি হাউজ।
প্রতিটি কার্টেই প্রায় একই ধরনের খাবার—মুংডি, লাকসু ও ব্যাম্বো চিকেন। মুংডি হাউজ-এর স্বত্বাধিকারী জুয়েল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, কয়েকজন বন্ধু মিলে কয়েক মাস আগে শুরু করেছেন এই ব্যবসা। সংসদের সামনে ঘুরতে আসা মানুষের অনেকেই খুঁজে বেড়ান ব্যতিক্রমী স্বাদের খাবার, তাই এখানে তাদের ভালো সাড়া মিলছে।
জুয়েল বলেন, "নির্বাচনের পরে সংসদ অধিবেশন চালু হলে আর এখানে বসতে পারবো না, তখন অন্য জায়গায় যেতে হবে।"
তার কার্টে পাওয়া যায় পাঁচ ধরনের মুংডি—বেসিক, ডিম, চিকেন, ডিম-চিকেন এবং স্পেশাল মুংডি। দাম ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। এছাড়া আছে বিশেষ টক স্বাদের রোজেলা চা, যা পাহাড়ি অঞ্চলের এক ধরনের পাতা দিয়ে তৈরি হয়। ২০ টাকায় এক কাপ চা খাওয়ার জন্যও অনেকেই আসেন।
অগ্রিম অর্ডার দিলে ব্যাম্বো চিকেনও তৈরি করে দেন তারা। বাঁশের ভেতরে মশলা মাখানো মুরগি ভরে হালকা কয়লার আঁচে দীর্ঘ সময় ধরে পোড়ানো হয় এই খাবার। ব্রয়লার মুরগির ব্যাম্বো চিকেন ৫০০ টাকা, আর পাহাড়ি মুরগিরটি ১,০০০ টাকা।
মুংডি হাউজ থেকে একটু সামনেই লাবা তং মুংডি। ফার্মগেটের গারো রেস্তোরাঁ 'জাবা'-এর পরিচালনায় চলে এটি। এখানকার প্রায় সব খাবারই আসে জাবা থেকে, আর অধিকাংশ কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয় বান্দরবান থেকে।
উ অং মারমা ও আমিশা তজু একসঙ্গে এই কার্ট চালান। তাদের কার্টে ব্যতিক্রমী আইটেম হিসেবে পাওয়া যায় আমড়ার শরবত ও বিন্নি চালের পায়েস, দুটির দামই ৫০ টাকা।
রো-ওয়া-দো মুংডি ঘর চালান দুই বান্ধবী মেয়হ্লাপু মারমা ও জ্যোতি চাকমা। সকাল থেকেই শুরু হয় তাদের কাজ। ফ্রিজ না থাকায় প্রতিদিনই বাজার করেন—ভোরে মুরগি কিনে সেদ্ধ করা, স্যুপ ও নুডলস তৈরি করা—সবই দু'জন মিলে করেন। পড়াশোনা শেষ করে এখন এটিই তাদের মূল আয়ের উৎস।
এদিকে, মুংডি হাউজ কার্ট চালান প্রজ্ঞা চাকমা ও মীরা চাকমা। তাদের কার্টে মুরগির লাকসু, মুংডি ও রোজেলা চা পাওয়া যায়।
প্রজ্ঞা বলেন, "আমাদের এখানে বেশিরভাগ ক্রেতাই বাঙালি। আদিবাসীদের কাছে এসব খাবারে নতুনত্ব নেই, কিন্তু সমতলের মানুষ নতুন স্বাদের খোঁজে আসে। আমরা চেষ্টা করি তাদেরকে আমাদের খাবারের আসল স্বাদটা দিতে। আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ ক্রেতাই বাঙালি।"
হাকিম চত্বরে এক টুকরো পাহাড়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর খাওয়া-দাওয়ার জন্য বিখ্যাত। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ছাড়াও বাইরের অনেক মানুষ প্রতিদিন এখানে আসেন ভাজাপোড়া আর হালিম খেতে। সেই চত্বরে এখন দেখা মেলে এক টুকরো পাহাড়ের—ছোট্ট একটি পাহাড়ি খাবারের ফুড কার্ট 'মুংডি খাবা?'
কার্টটি চালান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুরমী চাকমা ও বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াই মং। গত ২৪ সেপ্টেম্বর চালু হয়েছে তাদের এই উদ্যোগ। পূজার ছুটির কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ফের জমে উঠেছে দোকান। স্লোগানও চোখে পড়ে কার্টের সামনে—'ঢাবি ক্যাম্পাসে উপভোগ করুন পাহাড়ি খাবারের স্বাদ।'
এখানে পাওয়া যায় নরমাল মুংডি, ডিম মুংডি, চিকেন মুংডি ও চিকেন লাকসু—দাম যথাক্রমে ৫০, ৭০ ও ১০০ টাকা। প্রতিদিন প্রায় ২০০ জনের খাবার নিয়ে আসেন তারা। বিকেলে দোকান খোলে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়।
নতুন উদ্যোগ হলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছে 'মুংডি খাবা?'। সন্ধ্যার দিকে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মুংডি ও লাকসুর স্বাদ নিতে। ভিড় সামলাতে টোকেন সিস্টেম চালু করতে হয়েছে তাদের।
ওয়াই মং বলেন, "আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন প্রক্রিয়ায় আছি—বৈধভাবে বসতে চাই এখানে। এখনো নতুন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সাড়া অবিশ্বাস্য। বেশিরভাগই বাঙালি, নতুন স্বাদ নিতে আসে। অনেকে দেরি করে এসে খেতে না পেরে মন খারাপ করে।"
মুংডি খেতে আসা গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মাজেদ হোসাইন বলেন, "পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এক বাড়িতে মুংডি খেয়েছিলাম। ঠিক সেই স্বাদের মুংডিই নিজের ক্যাম্পাসে খেতে পারব, ভাবিনি কখনো।"
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন/টিবিএস