বোকা বাইটস, পিও চা, বাটার ভাই: ফুড কার্টের যত মজার নাম

মানবেন নিশ্চয়ই, দেড় যুগ আগের ঢাকায় ফুড কার্ট বলতে ছিল বাদামের ঠেলাগাড়ি বা আখের রসের ভ্যানগাড়ি। আর ছিল ফুচকা-চটপটির দোকান। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার মতো অল্প কিছু জায়গায় দোসা, লুচি-সবজি, চিকেন ফ্রাই-ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের কার্ট বসত।
সেকালে বাংলা হোটেল ছিল বেশি, লোকে বসে খেতে পছন্দ করত। হোটেলগুলোয় মাছ-ভাত-মাংস-ডাল পাওয়া যেত। সেগুলোর নাম হতো মালিকের অথবা জেলার নামানুসারে, যেমন—মিরপুরের 'রাব্বানী' অথবা সেগুনবাগিচার 'চিটাগাং হোটেল'। কিছু কাব্যিক নামও দেখা যেত, যেমন এলিফ্যান্ট রোডের 'মালঞ্চ', মতিঝিলের 'হীরাঝিল' বা 'ঘরোয়া'।
ফাস্ট ফুডের ভ্রাম্যমাণ রেস্টুরেন্ট ছিল না, 'ইয়াম্মি'-র মতো যে কয়টি ছিল, সেগুলো ছিল স্থায়ী। তবে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল বেশ কিছু। সেগুলোর নাম 'টুংকিং' বা 'চাংপাই' হলেও লেখা হতো ইংরেজি হরফে।
বর্তমানের ঢাকায় খাবারঘর বলতে ফুড কার্টই বেশি দেখা যায়। অনেক অনেক সুবিধা রয়েছে এগুলোর। প্রায় সবগুলোই ভ্রাম্যমাণ। সাধারণত এসএস দিয়ে তৈরি হয়। দৈর্ঘ্যে হয় ৪ থেকে ৬ ফুট, প্রস্থে আড়াই ফুট হলে চলে যায়, তবে উঁচু হওয়া লাগে কিছুটা বেশি — সাত ফুটের মতো।
এগুলোর তিন পাশ মোটা গ্লাস দিয়ে ঢাকা থাকে আর এক পাশে থাকে স্টিলের সাটার। বার্নার, ডিপ ফ্রায়ার, এক্সজস্ট ফ্যান, কড়াই, ফ্রাই প্যান — সবই কার্টের সঙ্গে লাগানো থাকে। কত অল্প জায়গার মধ্যে একটি খাবারের ঘর করে নেওয়া যায়, তার চমৎকার উদাহরণ দেখিয়েছে এসব কার্ট।
সাধারণত এগুলোয় ফাস্ট ফুড পাওয়া যায়, তবে সি-ফুড, কাবাব-পরোটা, পোড়া রুটি-দুধ মালাই, ফ্রায়েড রাইস-নুডলস-পাস্তা, দোসা, মোমোর কার্টও দেখা যায়। ফুটপাতের ওপর একটি কার্ট ঘিরে চার-পাঁচটি টুল বসিয়ে তৈরি হয়ে যায় রেস্তোরাঁ।
পিৎজা, মিট বক্স, বার্গারের জন্য আলাদা আলাদা সুদৃশ্য প্যাকেট পাওয়া যায়। ওয়ানটাইম চামচ, গ্লাস ও প্লেট দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে সময়টা দেড় যুগে এমনভাবে বদলেছে যে ভাবতেই অবাক লাগে।
অনেকেই বিকেলের নাস্তা এখন ফুড কার্টে সারেন — যা সেকালে খুব একটা দেখা যেত না।
ফুড কার্টের ধারাবাহিক অগ্রগতি নিয়ে আরও অনেক কথা বলা যায়। তবে আজকের বিষয় বিচিত্র সব নামকরণ। যেহেতু নতুন প্রজন্মের নারী-পুরুষ কার্টগুলো পরিচালনা করেন, তাই নামেও সময়ের প্রভাব দেখা যায়।
হাজার হাজার ফুড কার্টের মধ্যে আমরা গুটিকয়ের ইতিবৃত্ত জানতে পেরেছি, আর তা দিয়েই এ লেখা সাজানো হয়েছে।
বোকা বাইটস
মিরপুর ২ নম্বরের লাভ রোডে বার্গার, মিটবক্স, পাস্তা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিকেন ফ্রাইয়ের কার্ট 'বোকা বাইটস'। শেফ নাঈম হাসানের নিজেরই দোকান এটি। আগে থেকেই ভেবেছিলেন, চাকরি করবেন না — নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করাবেন।
সেই চিন্তা থেকে ফাস্ট ফুড বানাতে শিখলেন আরেকটি কার্টে সহকারী হয়ে। মাস তিনেক হলো 'বোকা বাইটস' শুরু করেছেন।
প্রথমে ভেবেছিলেন নাম দেবেন 'লাভ বার্ড' (যেহেতু লাভ রোডে দোকান)। পরে ভাবলেন, এর চেয়েও মজার কিছু হওয়া দরকার। তিনি তার খাবারের আইটেমগুলোর তালিকা দিয়ে চ্যাটজিপিটির কাছে একটি মজার নাম চাইলেন।

চ্যাটজিপিটি আরও কয়েকটি নামের সঙ্গে 'বোকা বাইটস'-ও সাজেস্ট করল। নাঈমের এ নামটাই ভালো লেগে গেল। পরে একটি লোগো বানিয়ে দিতে বললেন। চ্যাটজিপিটি তাতেও কার্পণ্য করল না। নাঈম কার্টের বিভিন্ন অংশের মাপে লোগোটি প্রিন্ট করিয়ে এনে লাগিয়ে দিলেন।
নাম কি কাস্টমার টানতে কোনো ভূমিকা রাখে? জানতে চাইলে নাঈম বললেন, "ভালো খাবার কাস্টমার টানার আসল মন্ত্র। তবে নামে চমক থাকলে কিছু সুবিধা হয়, যেমন কাস্টমার নামটি মনে রাখে। অন্যকে বলার সময় সহজে মনে করতে পারে। যারা কার্টের সামনে দিয়ে যান, তাদের দেখি একবার হলেও দোকানের দিকে তাকান। এসবই সুবিধা।"
মুহূর্ত
নাঈমের পাশের দোকানটির নাম 'মুহূর্ত'। এমন নাম এখন সহসা নজরে পড়ে না বলে আকৃষ্ট হলাম। সঙ্গের সংলাপটিও মন্দ নয় — তাতে লেখা, 'আবহাওয়া অনুকূলে হোক কিংবা বৈরি, আমার সাথে এক মুহূর্ত কাটাতে তুমি কি সবসময় তৈরি?'
মিরপুর ১৩ নম্বরের চার বন্ধু মিলে শুরু করেছিলেন ব্যবসা। একজন ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। তার প্রেরণায় বাংলা নাম রাখা স্থির হয়েছিল। 'আপ্যায়ন', 'ভোজন', 'অতিথি' ইত্যাদি নাম ছিল তালিকায়। শেষে সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুটি 'মুহূর্ত' নামের প্রস্তাব করেন, আর সেটিই নির্বাচিত হয়।
মূলত প্রেমিক-প্রেমিকারাই টার্গেট কাস্টমার। তাদের একান্ত সময়টাকে ধরে রাখতে এ নামের বিকল্প নেই।

এখন দোকানটি পরিচালনা করেন মো. ইউশা। তারা পোড়া রুটি আর মালাই চা বিক্রি করেন। পাবনায় এ খাবার খুব জনপ্রিয়।
ইউশা বলছিলেন, "দশ মাস আগে আমরা যখন এই খাবার বিক্রি শুরু করি, তখন মনে হয় না ঢাকার কোথাও এটি বিক্রি হতো। আমাদের দেখাদেখি এখন বেশ কয়েকটি দোকানে পোড়া রুটি আর মালাই চা বিক্রি হয়।"
খাওন দাওন
মিরপুর ১ নম্বরে সনি স্কয়ার পার হয়ে চিড়িয়াখানার দিকে যেতে একটি ছোট্ট কার্ট নজর কাড়ে, কারণ এর নামটি বেমানান। এ নিয়ে চিন্তায় আছেন দোকান মালিক সুজন মাহমুদও। অল্প কিছুদিন হলো তিনি কার্টটি ভাড়া নিয়েছেন। নামটি আগের মালিকের দেওয়া।
নামটি যে ফাস্ট ফুডের জন্য মানানসই নয়, তা সুজন জানেন। বলছিলেন, "'খাওন দাওন' নামটি পিৎজা, পাস্তা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের সঙ্গে যায় না। ফাস্ট ফুডের জন্য চটকদার নাম চাই, ইংরেজিতে হলেই ভালো হয়। তাই পরিবর্তন করার কথা ভাবছি।"
আগে সুজনের দোকান ছিল মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের কাছে। তখন নাম ছিল 'মিঃ ঝাল ক্যাফে'। সেটিই তিনি আবার ফিরিয়ে আনবেন। নামটি আগের কাস্টমারদের চেনা, তাই সব দিক থেকেই এটি গুরুত্বপূর্ণ।

সুজন খাবার তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ইউসেপ-এ। সেটি ছিল একটি ফ্রি কোর্স। চাইনিজ খাবার তৈরি শিখেছিলেন, তবে ফাস্ট ফুড তৈরি করা শিখেছেন নিজে নিজেই।
পিও চা
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাজার কার্টের ভিড়ে একটি নাম দেখে থমকে দাঁড়ালাম — নাম 'পিও চা'। দোকান পরিচালনায় আছেন একজন নারী, নাম রিফাত জান্নাত।
রিফাত নিজে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। 'নাটক কম করো পিও' স্লোগানটিই তাকে এমন নামকরণে অনুপ্রাণিত করেছে। এতে ভালো সাড়াও পেয়েছেন। যেহেতু স্লোগানটি অধিকাংশ লোক জানেন, তাই নাম দেখেও ভিড় করেন কেউ কেউ।

এ দোকানে দুধ চা, মালাই চা, কফি ও প্যাকেট বিস্কুট বিক্রি হয়। রিফাত ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। পড়ার বিষয় ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট।
বিকাল ৩টায় দোকান খুলে, বন্ধ করতে করতে রাত ১০টা বেজে যায়। রিফাত বলছিলেন, "চাকরির বাজারে খুব প্রতিযোগিতা। সব চাকরিতে ভালো বেতনও পাওয়া যায় না। তাই নিজেই ব্যবসা করব মনস্থির করলাম। চায়ের দোকান দিয়ে শুরু করেছি, আগামীতে আরও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখি।"
দোকান থেকে রিফাতের আয় খুব বেশি হয় না। তবে প্রতি সেমিস্টারের টিউশন ফি জোগাড় হয়ে যায়, হাতখরচ ওঠে, ছোট ভাইবোনদের শখ মেটাতে পারেন।
রিফাতকে ঘিরে প্রতি বিকালেই তার বন্ধুরা এসে জড়ো হন। দু-একজন নিয়মিত আসেন এবং দোকান পরিচালনায় সাহায্য করেন।

এবার দুটি ফাস্ট ফুড রেস্তরাঁর কথা বলা যাক। এগুলোর উদ্যোক্তাও নতুনেরা, নামেও তার প্রকাশ ঘটেছে। খাবার বলতে ওই পিৎজা, পাস্তা, বার্গার বা ফ্রায়েড রাইস। এদের একটি 'পিৎজা হেইস্ট', আরেকটি 'পোকেমন'।
পিৎজা হেইস্ট
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত জনপদ, ২০২০ সাল। একই সময়ে সারা বিশ্বের তরুণেরা বুঁদ হয়ে আছে স্প্যানিশ এক টিভি সিরিজ 'মানি হেইস্ট' এ।
দুই স্কুল বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান ও রেদোয়ানুর রহমান মনে সাহস নিয়ে একটি রেস্তরাঁ চালু করে ফেললেন মিরপুর ৬ নম্বরে। তবে করোনাকাল হওয়ায় পুরো ব্যবস্থাই ছিল টেকঅ্যাওয়ে। চেয়ার-টেবিল কিছুই ছিল না, ছিল শুধু ডেলিভারি উইন্ডো আর কিচেন। পাওয়া যেত কেবল পিৎজা।
'মানি হেইস্ট' অনুকরণে রেস্তরাঁর নাম দেওয়া হলো 'পিৎজা হেইস্ট'। 'হেইস্ট' শব্দটি ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পাওয়ায় সুবিধাই হলো — অনেকেই সরাসরি কানেক্ট করতে পারলেন।
হেইস্ট মানে চুরি, কিন্তু কাস্টমাররা ব্যাপারটিকে মজা হিসেবেই নিলেন।

মোস্তাফিজ বলছিলেন, "তখন পিৎজা ছিল একটি ব্যয়বহুল খাবার। আমরা সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে একে আনতে চেয়েছিলাম — বিশেষ করে ছাত্ররা ছিল আমাদের টার্গেট কাস্টমার। আমরা ৬ ইঞ্চি পিজা ১১০ টাকায় দিতে শুরু করি, এটি অনেককেই অবাক করেছিল। এখন অবশ্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দামে পরিবর্তন এসেছে।"
বর্তমানে 'পিৎজা হেইস্ট' ৬ নম্বর কাঁচাবাজারের কাছে ৭০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে একটি মাঝারি আকারের রেস্তরাঁ। পিৎজাপ্রেমীদের কাছে চেনা একটি নাম এখন এটি।
পোকেমন
রবিউল খানের মেয়ে আরিশার বয়স আট। আরেকটু ছোট থাকতে জাপানিজ অ্যানিমে 'পোকেমন'-এর খুব ভক্ত ছিল সে।
রবিউল যখন ভাবলেন নতুন একটি রেস্তরাঁ চালু করবেন, তখন নাম নিয়ে ভাবতে বসলেন। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে মেয়ের পছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে রেস্তরাঁর নাম রাখলেন 'পোকেমন'।
পনেরো জনের বসার সুযোগ রয়েছে রেস্তরাঁয়। 'পোকেমন'-এর বিভিন্ন চরিত্র দিয়ে দেওয়াল ও টেবিল সাজানো।
নামের কারণে রেস্তরাঁটি চিনতে অনেকেরই সুবিধা হয় বলে মনে করেন রবিউল খান।

কিছু ফুড কার্টের নামে আঞ্চলিক শব্দের প্রাধান্য দেখা যায়। চট্টগ্রাম এক্ষেত্রে এগিয়ে — যেমন 'ভুক লাই'।
আরও কিছু নাম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, যেমন 'বাটার ভাই' ও 'ফ্যাট মামা'। কিন্তু এগুলোর পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হয়নি।
তাই আপাতত এটুকু দিয়েই শেষ করতে হচ্ছে। পরে আরও নাম খুঁজে পেলে আরেক কিস্তি লেখা যাবে।