কলম্বো সাহিব কা মকবারা–ফিরছে তার আদিরূপে

কলম্বো সাহিব দুই শ বছর ধরে রহস্য হয়ে আছেন। সেই বিশপ হেবারের ঢাকা ভ্রমণের সময় থেকে। ১৮২৪ সালে ঢাকায় এসেছিলেন হেবার। দেখেছিলেন নারিন্দা কবরস্থানটি জঙ্গলাকীর্ণ। তবে তার মধ্যে একটি সমাধিসৌধ তার নজর কেড়েছিল। সৌধটি এতটাই জমকালো যে সহসা নজর ফেরানো যায় না। এর নিচের তলা ইসলামি স্থাপত্যরীতির, দ্বিতীয় তলাটি গথিক আর গম্বুজটি বারোক রীতিতে তৈরি। সাধারণ চোখে একে মুসলিম সুফি সাধকের মাজার বলে মনে হয়। হেবার কবরস্থানের বৃদ্ধ দারোয়ানের কাছে জানতে চাইলেন, কবরটি কার? দারোয়ান জবাব দিলেন, ইয়ে কলম্বো সাহিব কা মকবারা, কোম্পানি কা নওকর (এটা কলম্বো সাহিবের কবর, যিনি কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন)। সেটাই সূত্র একমাত্র। তবে নামটি শুনে ব্রিটিশ মনে হয়নি হেবারের, এই নামে কোনো সমাধিলিপিও খুঁজে পেলেন না। সেই থেকে রহস্যের শুরু।
কে ছিলেন কলম্বো সাহিব
রহস্য উদ্ঘাটনে দেশের ও বিদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, শিল্পবেত্তারা উত্তর খুঁজতে লেগে যান। কোন কোম্পানির নওকর ছিলেন কলম্বো সাহিব? ব্রিটিশ না ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির? কবেইবা তৈরি হয়েছিল স্থাপনাটি? বাংলায় পর্তুগিজ, ডাচ্, ফরাসি, ইংরেজসহ আরও নানা জাতির বসতি ও ব্যবসা ছিল। কিন্তু তাদের কারুর নামের সঙ্গেই কলম্বো শব্দটি যায় না। শুধু পর্তুগিজ ভাষায় কলম্বাস শব্দটি কলম্বো বলে উচ্চারিত হয়। এই পদবিধারী কিছু লোক এখনো আমেরিকা ও কানাডায় বসবাস করে। এ দিয়ে একটি সহজ উপসংহারে পৌঁছানো যায় বটে; কিন্তু গবেষককে সন্তুষ্ট করা যায় না।
টিম স্টিল নামের একজন প্রত্নতাত্ত্বিক, যিনি ঢাকায় বসবাস করেছেন কিছুকাল, বলেছেন, 'কলম্বো সাহিব শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে ঢাকায় বাণিজ্য করতে এসেছিলেন, প্রচুর ধন সম্পদেরও মালিক হয়েছিলেন। কলম্বো থেকে এসেছিলেন বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন কলম্বো সাহিব নামে।'
আবার ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ড. রোজি লুএলেন-জোন্স বলছেন, 'কলম্বো সাহিব সম্ভবত ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম দেখভালের জন্য।' ড. জোন্স মোগল আমলের বিখ্যাত বন্দর সুরাটের প্রসঙ্গ হাজির করেছেন উদাহরণ হিসেবে। বলেছেন, 'সুরাটের পুরোনো ডাচ্-আর্মেনীয়-ইংলিশ কবরস্থানগুলোয় যে সমাধিসৌধ দেখা যায়, সেগুলোর নির্মাণশৈলীতে ইসলামি রীতি সুস্পষ্ট। তখন ইউরোপীয়রা মোগলদের অনুকরণ করত; কারণ, সেটাই ছিল আভিজাত্য প্রদর্শন ও সম্মান প্রাপ্তির উপায়।'

সম্প্রতি ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সিমেট্রিজ ইন সাউথ এশিয়া বা বাকসা তাদের চৌকিদার নামের সাময়িকীতে দাবি করেছে, 'ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি চিফ ক্লেয়ারেম বল্ট হলেন কলম্বো সাহিব। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ক্লেয়ারেম বল্ট শব্দটিই লোকমুখে কলম্বো হয়ে গেছে। তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৭৫৫ সালে। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। কারণ, সৌধটিতে পাওয়া বেশ কয়েকটি শিলালিপির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হলো ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি চিফ উইলিয়াম কেরকমানের, যিনি মারা গিয়েছিলেন ১৭৭৩ সালে। এই ডাচ্ম্যানের স্ত্রীর নাম ছিল করোম্বো।'
তবে একটি বিষয়ে প্রায় সবাই একমত যে সৌধটি নির্মিত হয়েছে বাংলায় মোগল শাসনের শেষ ও ঔপনিবেশিক আমল শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে। সে হিসাবে সৌধটির বয়স সাড়ে তিন শ বছর হয়ে যাবে। এর বড় প্রমাণ ১৭৮৭ সালে শিল্পী জোহান জোফানির আঁকা নাগাপন ঘাট নামে একটি চিত্রকর্ম। তাতে সৌধটিকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আমাদের জলবায়ুতে সাড়ে তিন শ বছর ধরে কোনো স্থাপনার অটুট থাকতে ভীষণ বেগ পেতে হয়। কলম্বো সাহিবের সৌধেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কালের ছোবলে অনেক অংশই ক্ষয়ে গেছে, বটগাছসহ আরও আগাছা গজিয়েছে। তাই সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছিল।
সংস্কারের আমন্ত্রণ
ঔপনিবেশক আমলের স্থাপনা নিয়ে গবেষণা করেন ওয়াকার এ খান। তার সংগৃহীত তথ্য ও বিশ্লেষণ থেকে উপকৃত হন বিদেশি গবেষকেরাও। দীর্ঘ আট বছর তিনি নিরলসভাবে কলম্বো সাহিব রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করে গেছেন। তিনি বাকসার এদেশীয় প্রতিনিধি ছিলেন। বাকসা এমন এক সংগঠন, যার সদস্যরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে তাদের পূর্বপুরুষদের কবর খুঁজে বের করে এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য তহবিল সরবরাহ করে। ২০১২ সালে প্রফেসর ড. আবু সাঈদ এম আহমেদকে সৌধটি সংস্কারের জন্য আমন্ত্রণ জানান ওয়াকার খান
সাঈদ আহমেদ একজন কনজারভেশন আর্কিটেক্ট। বুয়েট থেকে স্থাপত্যবিদ্যার পাঠগ্রহণ শেষে গেল শতকের নব্বই দশকের গোড়ায় জার্মানি গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ড. এনামুল হকের লেখা 'ইসলামিক হেরিটেজ অব বাংলাদেশ' বইটি।
তখন ইউরোপের লোকেরা বাংলাদেশকে জানত গরিবের বা দুর্ভিক্ষের দেশ, নিরন্ন মানুষের দেশ হিসেবে। বইটি দেখার পর অনেকেই অবাক হয়েছিল। নিরন্ন মানুষের দেশে তেরো বা চৌদ্দ শতকের মসজিদ দেখে তারা বিস্মিত। স্কটিশ এক ছেলে বলেই বসল, 'এডিনবার্গের ১৬ শতকের এক প্রাচীন দেয়াল নিয়েই আমাদের কত আহ্লাদ! অথচ তোমাদের দেখছি কয়েক গুণ বেশি আছে।' তখন সাঈদ আহমেদ ভাবলেন, কালে কালে তো এগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, যখন থাকবে না, তখন কী হবে!

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নব্বইয়ের দশকে বাংলার স্থাপত্যের ইতিহাস ও তার সংরক্ষণপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু পড়ানো হতো না। মিসর, মেসোপটেমিয়া, ইউরোপের বারোক, গথিক, রেনেসাঁশৈলী ঘটা করে পড়ানো হলেও বাংলার ইতিহাস ছিল উপেক্ষিত। সাঈদ সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলার স্থাপত্যের ইতিহাস ও কনজারভেশন আর্কিটেকচারই হবে তার অধ্যয়নের বিষয়। পিএইচডির মূল গবেষণা ছিল বাংলার প্রাচীন মসজিদ স্থাপত্য।
বড় সরদারবাড়িতে বড় অভিজ্ঞতা
পিএইচডি শেষে ফিরে এলেন দেশে। ১৯৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে স্থাপত্য বিভাগে যোগদান করেন এবং শিক্ষকতা শুরু করলেন। প্রথম সুযোগ আসতে অবশ্য বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হয়। রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তির অংশ হিসেবে নিমতলী দেউড়ি সংস্কার ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার আমন্ত্রণ পেলেন সাঈদ আহমেদ। অধীত বিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগের সুযোগ সেটাই প্রথম। যদিও নানা কারণে হুবহু আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি; তবে অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।
সোনারগাঁওয়ে বড় সরদারবাড়ি করতে গিয়ে ওই অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছিল। বড় সরদারবাড়ি ছিল একটি বৃহৎ প্রকল্প। দক্ষিণ কোরীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশন তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এতে অর্থ জোগান দেয়। সাঈদ আহমেদ বলছিলেন, 'সাধারণত ভবন সংস্কার প্রকল্পে অর্থায়ন করতে দেশি-বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে খুব একটা দেখা যায় না। ইয়াংওয়ান কর্তৃপক্ষ নিজে থেকেই এসে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। আমিও সানন্দে রাজি হই। সেদিক থেকে ইয়ংওয়ানের উদ্যোগটি উল্লেখের দাবি রাখে, যা এই দেশে হেরিটেজ কনজারভেশনের একটি মডেল।'
বড় সরদারবাড়ি প্রকল্পে প্রায় ১০০ জন দক্ষ কারিগর বা মিস্ত্রি নিয়ে তিন বছর কাজ করতে হয়েছিল। সংস্কারকাজের প্রক্রিয়া কী কী, জানতে চেয়েছিলাম সাঈদ আহমেদের কাছে। তিনি বললেন, 'শুরুতেই আমরা একটি সার্ভে বা জরিপ করি। জরিপের প্রথম ধাপ হলো ড্রয়িং যা স্থাপনাটির প্ল্যান, উচ্চতা বা এলিভেশন এবং ডাইমেনশন প্রপোরশন বুঝতে সাহায্য করে। তারপর করি ফটোমেট্রি (ফটোগ্রাফ+জিওমেট্রি)। এতে সম্মুখভাগের ছোট ছোট অনেকগুলো ছবি তুলে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়। ফলে সূক্ষ্মভাবে অলংকরণ, নকশা বোঝার সুযোগ হয়। এরপর ভিডিওগ্রাফি করি। তারপর করি আর্কাইভাল সার্ভে। এর মাধ্যমে স্থাপনার ইতিহাস, সময়কাল, সমসাময়িক স্থাপত্যরীতি জানতে চেষ্টা করি। সবশেষে আবার একটি ড্রয়িং করি যাকে বলা হয় কনজারভেশন ড্রয়িং। কোন কোন জায়গায় কতটা সংস্কার আমরা করব, তা বুঝতে এটি কাজে লাগে। সার্ভে করার পর বাজেট তৈরি করি এবং তহবিলদাতার কাছে প্রেরণ করি।'

কলম্বো সাহিবের সমাধি সংস্কারকাজেও ওই সবগুলো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করা হয়েছিল। যেহেতু সাঈদ আহমেদ অনেক দিন ধরেই ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফ্যাকাল্টি, তাই ছাত্রদের অনেকে তার সঙ্গে কাজ করে থাকেন। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তিনি জরিপ শেষ করেন। তারপর বাজেট তৈরি করে ওয়াকার খানের মাধ্যমে তা প্রেরণ করেন বাকসার কাছে ১৯১২ সালে। বাকসা মোট বাজেটের আড়াই ভাগের এক ভাগ অনুমোদন দিল। কিন্তু তহবিল সংগ্রহে সময় লেগে গেল আরও বারো বছর।
মিস্ত্রিদের মনে শিল্পীর বাস
শেষে ১৯২৪ সালে তা পাঠানোর পর গত সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু হলো। প্রথম কাজ ছিল জঙ্গল সাফ করা। বটগাছটিই বেশি চিন্তিত করেছিল। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, শিকড় ছাড়াতে গেলেই ঝুরঝুর করে পড়ে যাবে। তবে সৌভাগ্য বলতে হয়, শিকড় খুব বেশি ভেতর পর্যন্ত যায়নি। তাই ছাড়ানো তুলনামূলক সহজ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর তিনি ছয়জন ম্যাসন নিয়ে এলেন নাটোর ও পাহাড়পুর থেকে। এ প্রসঙ্গে জনাব আহমেদ বলছিলেন, 'আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ আছে, যেমন পাহাড়পুরের লোক ইটের ওপর ফুল তুলতে পারেন ভালো, নাটোরের লোক অর্নামেন্টেশন বা অলংকরণে ভালো, চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোক ইটের গাঁথুনি দিতে পারদর্শী। পুরান ঢাকার কিছু লোক আবার চিনিটিকরির (চীনামাটির পাত্রের টুকরা) কাজ জানে ভালো। কাজ করতে গিয়ে দক্ষ লোকগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেছে। আমরা এখন একটা পরিবারের মতো।'
তিনি আরও যোগ করলেন, 'সাধারণ মিস্ত্রিদের কাতারে ম্যাসনদের ফেললে ভুল হবে। তাদের মধ্যে শিল্পী মন লুক্কায়িত থাকে। একটি উদাহরণ দিলে আপনার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে, একবার একটি স্থাপনায় চিনিটিকরির কাজ করবার প্রয়োজন দেখা দিল; ভাবলাম, পুরাতন সিরামিকের নকশা নিয়ে যেকোনো সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে প্লেট বানিয়ে আনব। পুরান ঢাকায় খবর নিলামÑকারা চিনিটিকরি জুড়তে পারে। যে কয়েকজনকে পাওয়া গেল, তারা বলল আপনাদের প্লেট বানিয়ে আনতে হবে না, আমরাই জোগাড় করে দিব। গুলিস্তানে পীর ইয়ামেনী মাজারে আমাদের নিয়ে গেল। আগে মাজারটির বহির্গাত্র পুরোটাই চিনিটিকরির কারুকাজে মোড়ানো ছিল, একসময় মাজার কমিটি সেগুলো খুলে আধুনিক টাইলস বসিয়ে দিয়েছে। মিস্ত্রিরা কিন্তু চীনামাটির পাত্রের টুকরাগুলো ফেলে দেয়নি বরং বস্তায় ভরে কাছেই এক জায়গায় মাটির নিচে পুঁতে রেখেছে। সেখান থেকে একটি বস্তা নিয়ে আমাদের দিল। কমিটির কাছে হয়তো এগুলোর কোনো মূল্যই ছিল না; কিন্তু শিল্পীর কাছে যে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। আরও দেখেছি ম্যাসনরা সাপ পেলে মারে না, তারা বড়জোর দূরে ছুড়ে ফেলে। তাদের কখনো সাপে কেটেছে বলেও শুনিনি। নানান কিছু শেখার আছে তাদের কাছে। দুঃখের ব্যাপার হলো তাদের টিকে থাকার উপায় থাকছে না।'

১৮৭৫ সালের একটি ফটোগ্রাফ
আদি নির্মাণকৌশল সম্পর্কে সচেতন ছয়জন কারিগরের সঙ্গে 'কলম্বো সাহিব প্রকল্পে' কাজ করেছেন আরও ১২ জন দক্ষ মিস্ত্রি। সংস্কারকাজে সাঈদ আহমেদ খুব সতর্ক থাকেন, যেন ভুল কিছু না করে বসেন। স্থাপনাটি আগের নকশায় ফিরিয়ে নেওয়া তার কাজ, নতুন কিছু সংযোজন তার কাজ নয়। সুস্পষ্ট নমুনা হাতে রেখে তিনি কাজে নামেন। এ ক্ষেত্রে ওয়াকার খানের গবেষণা তার সহায় হলো। তিনি জোগাড় করে দিলেন কলকাতার জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান স্টুডিওর তোলা ১৮৭৫ সালের একটি ছবি। পাওয়া গেল ১৮৫০ সালে তোলা একটি ছবিও। এগুলো ছিল সংস্কারকাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট নমুনা।
অবশেষে টিকে থাকা অংশ এবং আলোকচিত্র ও জোফানির চিত্রকর্ম দিয়ে অনেকটাই দৃশ্যমান হয়ে গিয়েছিল কলম্বো সাহিবের সমাধিসৌধ।
সাঈদ আহমেদ ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা স্থাপনা সংস্কারের কাজ করেন মনের আনন্দে; ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার তাগিদ থেকে। আর্থিক প্রাপ্তি এখানে মুখ্য নয়। তবে চুন-সুড়কির কারিগরদের বেতন বা মজুরি এবং উপকরণ কেনার টাকা তো লাগে। বাকসার দেওয়া তহবিল থেকে কাজ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। বাকি তহবিল প্রদানের জন্য কমনওয়েলথ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের নিকট আবেদন জানানো হয়েছিল।
মধ্যবর্তী সময়ে যেন কাজ থেমে না যায়, তার জন্য ঢাকার কাকরাইল চার্চের ফাদার আলবার্ট ও সাঈদ আহমেদ ধার হিসেবে কিছু তহবিল জোগান দেন। কমনওয়েলথ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের তহবিল অল্প দিন হলো এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যেই অবশ্য ৭৫ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। বাকি পঁচিশ ভাগ কাজের মধ্যে আছে ভেতরের কবরগুলো চিহ্নায়ন ও সংরক্ষণ এবং সৌধের চারধারে রাস্তা, প্লাজা বা প্লাটফর্ম তৈরি করা। সাঈদ আহমেদ আশা করছেন দুই মাসের মধ্যেই সব কাজ শেষ হবে।
এ পর্যায়ে সাঈদ আহমেদের কাছে জানতে চাইলাম, সৌধটি সংস্কার করতে গিয়ে কী কী নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করেছেন? তিনি বললেন, 'বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই যেহেতু এর নির্মাণকাল মোগল আমলের শেষে হওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন, তাই আমরা ইটের গুঁড়া আর চুন ব্যবহার করেছি। মোগলদের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল দিল্লি। ভারতে লাল বেলেপাথর সুলভ। কিন্তু আমাদের এখানে তা দুর্লভ। অথচ ঢাকার সুবেদাররা চাইতেন দিল্লি বা আগ্রার মতো দেখতে স্থাপনা নির্মাণ করতে। তখন তারা চুন-সুড়কির রসায়ন আবিষ্কার করে। এতে ভবনের রং আপনা থেকেই লাল হয়ে যায়। চুনের অনুপাতের ওপর নির্ভর করে এটি গাঢ় লাল হবে নাকি হালকা লাল। আর উপকরণগুলো জমাট বাঁধানোর (বন্ডিং) জন্য কলাইয়ের ডাল, গুড়, সুপারির কষ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।'
সংস্কারের সঙ্গে প্রয়োজন পুনর্ব্যবহার
২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জনাব আহমেদ ১৪টি স্থাপনা সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করেছেন। কোনো কোনো সময় অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকায়ও দেখা গেছে তাকে। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন বা দেশ-বিদেশের সেমিনারে বাংলাদেশের হেরিটেজ আর্কিটেকচার ও তার কনজারভেশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশের ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বাংলার স্থাপত্য ইতিহাস ও তার সংরক্ষণ নিয়ে পড়ানো ও গবেষণা হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই থেকে তিনজন ছাত্র প্রতিবছরে ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিয়ে থিসিস করছে। সে হিসেবে বিষয়টি আর নতুন নেই এবং আগ্রহী লোকের সংখ্যাও বাড়ছে।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় সাঈদ আহমেদ একটি পুরোনো বাড়ি সংস্কার করেছেন সম্প্রতি। এটি জনাকয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দাদা বা পূর্বপুরুষেরা গড়ে তুলেছিলেন। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন অংশ ভেঙে গিয়েছিল। পূর্বপুরুষের স্মৃতি রক্ষার্থে এবং নিজেদের অবকাশ যাপনের জন্য ওই পরিবার বাড়িটিকে সংস্কার করাতে চাইছিল। সাঈদ আহমেদ একে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন বাড়িটি রিসোর্ট হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ব্যক্তিরা বাড়িটিতে ভাড়া গুনে থাকতে পছন্দ করছেন।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এ কে খান গ্রুপের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলা শহরে হেরিটেজ ভবন খুঁজে ও সংস্কার করে কফিশপ করার আগ্রহ দেখা গেছে। এ পর্যায়ে সাঈদ আহমেদ বললেন, 'রাজস্থানের উদাহরণ আমাদের সবারই কমবেশি জানা। সেখানকার হেরিটেজ ভবনগুলো এখন পাঁচ তারকা হোটেল বা কনভেনশন সেন্টার। প্রাইভেট হেরিটেজ ভবন টিকে থাকার সম্ভাবনা তখনই বেশি দেখা যায়, যখন এ থেকে উপার্জনের সুযোগ তৈরি হয়। আমাদের দেশে শত শত হেরিটেজ বিল্ডিং আছে, আমি আজ পর্যন্ত ১৩-১৪টি স্থাপনা সংস্কার করেছি, হয়তো আর ছয়-সাতটি করতে পারব, নতুন প্রজন্ম বাকিগুলো করবে, তবে তার জন্য নীতিমালা প্রয়োজন আর অর্থ সমাগমের পথও উন্মুক্ত করতে হবে।'
শেষ করা যাক কলম্বো সাহিবকে দিয়েই। বুড়ো দারোয়ান তার ইতিহাস বলেছেন কিন্তু লিখিত ইতিহাস চাপা পড়ে আছে কালের গর্ভে। সেখান থেকে কোনো দিন কি তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে নাকি ওয়াকার খানের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হবে, 'সম্ভবত যেমন আছে তেমনই রয়ে যাবে, কলম্বো সাহিব রহস্য উল্টে কালে কালে কৌতূহল আরও বৃদ্ধি পাবে।' তবে সংস্কারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৌধটি তার টিকে থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন গবেষকেরা।
ছবি সৌজন্য: প্রফেসর ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ