ঋত্বিক ঘটকের কন্যা: এক অসমাপ্ত আলাপ

১
বাবা আর মেয়ে–এই দুইয়ের সম্পর্ক নিয়ে পৃথিবীতে বইয়ের অন্ত নেই। বিখ্যাত বাবার জীবন নিয়ে কন্যা লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ বই। অমিয়ভূষণ মজুমদারের কন্যা এনাক্ষী মজুমদার লিখেছেন বাবাকে নিয়ে 'বনেচর' গ্রন্থটি। এ বইতে নিভৃতচারী লেখককে অত্যন্ত আন্তরিক ঘরোয়া পরিবেশে পাঠকেরা পেতে পারেন। আবার শাঁওলী মিত্র বাবা বিখ্যাত নাট্যাভিনেতা পরিচালক নাট্যকার শম্ভু মিত্রের জীবন ও কাজ কেন্দ্র করে লেখেন 'শম্ভু মিত্র বিচিত্র জীবন পরিক্রমা ১৯১৫-৯৭'।
কন্যার লেখা বইটি বাংলার নাটকের ইতিহাসের এক অসামান্য দলিল। বিদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই সিলভিয়া প্লাথ এবং টেড হিউজ দম্পতির কন্যা ফ্রিদা হিউজ এক জীবন কাটিয়ে দেন মায়ের লেখা সংরক্ষণে। তার বাবা-মায়ের দাম্পত্য যে সুসংহত ছিল, এটি প্রমাণেও কার্পণ্য করেন না। যদিও 'রেড কমেট' আর 'লাভিং সিলভিয়া প্লাথ' বই দুটির সুবাদে আমরা জানি, সম্পর্কটা ছিল আজকালকার ভাষায় টক্সিক রিলেশন। তবু মেয়ের মন!
সংহিতা ঘটক ঋত্বিক ঘটকের বড় কন্যা। আজ এই দুজনের কথাই লিখতে বসেছি। ঋত্বিকের বিয়ের কিছুদিন আগে বোম্বে থেকে সুরকার, গীতিকার সুনীল চৌধুরী চিঠি ও টেলিগ্রামে জানান তাঁর চাকরি পাকা। বোম্বের অর্থাৎ এখনকার মুম্বাইয়ের ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে চিত্রনাট্যকারের কাজ। ১৯৫৫ সালের ৮ মে ঋত্বিক ঘটকের বিয়ে হয়। কন্যা শিলংনিবাসী সুরমা ঘটক। সুরমা নিজেও স্বামীর জীবনাশ্রিত অন্তত দুটি বই লিখেছেন। 'ঋত্বিক' এবং 'পদ্মা থেকে তিতাস'। কর্মস্থল বোম্বেতে পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জির বাড়িতে তাঁরা ওঠেন। তখন বিমল রায় 'দেবদাস' চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। গোরেগাঁও থেকে ওয়ার্ডেন রোডে উঁচু ফ্ল্যাটে উঠে আসেন চিত্রনাট্যের কিছু আগাম টাকা পেয়ে। জানালা দিয়ে দেখা যেত আরব সাগরের নীল জল। আকস্মিকভাবে মায়ের শরীর খারাপ হওয়ার খবর শুনে কলকাতায় ফিরলেন। মা কিন্তু আর বাঁচলেন না। তখন সুরমা সন্তানসম্ভবা। আবার এলেন বোম্বে শহরে।
১৯৫৬ সালের ৬ অক্টোবর মেরিন ড্রাইভের ডক্টর পুরন্দরের নার্সিং হোমে ব্রাহ্মমুহূর্তে সংহিতার জন্ম। তাঁর ডাক নাম ছিল টুনটুনি। বাবা ঋত্বিক ঘটক প্রায়ই কাজ থেকে ফিরে, ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে স্ত্রীকে বলতেন, 'বাচ্চাটাকে আমার কোলে দাও।' সেই সময়টাতে 'মধুমতী' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখছিলেন ঋত্বিক ঘটক। হিন্দি অনুবাদ করেন বিশ্বনাথ আদিল। সিনেমার টাইটেল কার্ডে আদিলের নামই ছিল। অভিনেতা দিলীপ কুমার শুটিংয়ে এসে শিশু টুনটুনিকে আদর করতেন। পরের বছর ১৯৫৭ সালের ৯ অক্টোবর পার্ক সার্কাসে ছোট বোন বুলবুলির জন্ম হয়।

'অযান্ত্রিক' চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গাড়িটি ছিল শেভ্রোলে, ১৯২০ সালের মডেল। নম্বর ছিল বি আর ও ১১৭। সুবোধ ঘোষের গল্প অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটিতে আয়োজনের কমতি ছিল না। ১৯৫৯ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সাবটাইটেল ছাড়া স্পেশাল এন্ট্রি বিভাগে চলচ্চিত্রটি অংশ নেয়। সর্বজনমান্য ফরাসি চিত্র সমালোচক জর্জ শার্দুল ছবিটি দেখে আত্মহারা হয়ে লেখেন, 'ইনফ্যান্ট টেরিবল অব ইন্ডিয়ান সিনেমা।' মনে রাখতে হবে, ফ্রান্সে তখন ন্যুভেল ভাগ দানা বেঁধেছে, বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কাঁপছে। কিন্তু মুক্তির পরে কলকাতায় ছবিটি চলেনি। জনৈক নারী দর্শক প্রথম শো দেখে বেরিয়ে বলেছিলেন, এই পরিচালক পাগল। ঋত্বিক আহত হয়েছিলেন, চিন্তিত হয়েছিলেন, পরিশ্রম একটুও কমাননি।
একদিন সকালবেলা সটান শিবরাম চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়ে কিনে আনলেন 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' উপন্যাসের চলচ্চিত্রের রাইট। শিশু-কিশোরের চোখে ভালোবাসার, বীভৎসতার কলকাতাকে দেখা। তত দিনে ভবানীপুরের নতুন বাড়িতে উঠে গেছেন তাঁরা। প্রতিবেশীদের কাছে দুই বোনের ডাকনাম হয়েছে রসগোল্লা আর পান্তুয়া। সংহিতা তখন বছর দুই। এক মাথা চুল আর খালি গায়ে খেলছে, যা শোনে তা উচ্চারণের চেষ্টা করে। এইভাবে শিশুটির বুলবুল ভাজা উচ্চারণ ক্যামেরায় ধরে রাখলেন বাবা। ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই 'মিনার', 'বিজলি' আর 'ছবিঘর'–এই তিন ছবি মুক্তি পেল। যথারীতি ফ্লপ। এই ছবিও পরের বছর বিদেশে সাব টাইটেলরহিত দশাতেই সম্মান পেয়েছিল। তাঁর ভিজুয়্যাল এত শক্তিশালী ছিল, কেউ অগ্রাহ্য করতে পারত না। এই সময়েই আমাদের প্রিয় ঋত্বিকের মদ্যপানের মাত্রা বাড়তে থাকে।
২
চুয়াত্তরে এগিয়ে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। 'যুক্তি তক্কো গপ্পো' এবং 'তিতাস একটি নদীর নাম' মুক্তি পায়নি কলকাতায়। প্রথম ছবি 'নাগরিক' তো বিশ বাঁও জলের অতলে। মেয়ে সংহিতাকে একাধিকবার যুক্তি তক্কো গপ্প চলচ্চিত্রের সম্পাদনা টেবিলে বসিয়েছিলেন পরিচালক বাবা। নাটকে ফিরলেন আবার। নাটকের নাম 'জ্বলন্ত'। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, একটি মেয়েকে চারজন যুবক ধর্ষণ করে হত্যার পর পুড়িয়ে দেয়। এই ছোট্ট অথচ অত্যন্ত জ্যান্ত একটা খবরের ওপর নির্ভর করে ঋত্বিক ঘটক তৈরি করলেন নাটক। যে মেয়েটি মূল চরিত্রের জন্য ঋত্বিক ভেবেছিলেন, সে কিছুই পারছিল না। এ কারণে এই রকম একটি কঠিন চরিত্রে ঋত্বিক ঘটক নিজের মেয়েকে অভিনয় করতে বললেন। কোনো রকম শুচিবায়ু তার মধ্যে কাজ করেনি। ইসাডোরা ডানকান কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পীর শৈলী অনুসারী পায়ের মুদ্রা বাবা নিজেই দেখিয়ে দিতেন। নাটকে একটি গান ছিল–
'কোথায় একটা ভালো দেশ আছে
যেখানে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে
সে দেশ কোথায় জানি না
কিন্তু তার কথা মনে আসে!
একদিন এই পৃথিবীটা সুন্দর হবেই
মানুষ মানুষকে ভালোবাসবেই
কত হাজার বছর পর জানা নেই
কিন্তু জানা আছে এর কোনো মার্জনা নেই–
সেদিনের জন্য আমি টিকে আছি
সেই দিনটা আসার জন্য আমি ভালোবাসছি।'
গানটি ঋত্বিক ঘটক নিজেই লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন। জীবনের প্রায় শেষ বেলায় লেখা এই গানেও তাঁর দুর্মর আশাবাদ ও প্রবল জীবনবোধের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষ সম্পর্কে আমাদের প্রিয় পরিচালক কী ভাবতেন, সেই কথাটাও এই গানে স্পষ্ট। এমন সৃজনদক্ষ বাবা আর কন্যার যৌথ সৃষ্টি অবিনশ্বর। বাবার ছবিসমগ্রের তুলনায় তাঁর বাবাকে নিয়ে লেখা বই 'ঋত্বিক একটি নদীর নাম' কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই বই না হলে এত বিশদে জানা হতো না মহান চিত্রপরিচালকটিকে। তাঁরা দুজনই আজীবন পরস্পরের প্রিয় বন্ধু ছিলেন। ছবির সেটে একেবারেই পিতা তিনি। সেখানে প্রশ্রয় নেই।
সূত্র:
১. 'ঋত্বিক এক নদীর নাম': সংহিতা ঘটক
২. 'সেই ঋত্বিক': সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত