শোক হতে শ্লোক

আজ যে প্রসঙ্গের অবতারণা করবো, তা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রথম আমার মনে পড়লো একটি ছোট্ট মেয়ের কথা, বামী তার নাম। সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচতলায় যাচ্ছিল সে। হাতে প্রদীপ- বাতাসের ঝাপটা থেকে আঁচলে আড়াল করে নিয়ে চলেছিল, মাঝপথে তার প্রদীপ নিভে গেছে…মেয়ের কান্না শুনে ছাদ থেকে বাবা ছুটে গেছিলেন- জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কী হয়েছে বামি?" মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিয়েছিল, "হারিয়ে গেছি আমি!" এরপর কী হয়েছিল? 'পলাতকা'তে 'হারিয়ে যাওয়া' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন-
'তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে
ফিরে গিয়ে ছাতে
মনে হল আকাশপানে চেয়ে
আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে
নীলাম্বরের আঁচল্খানি ঘিরে
দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চলছে ধীরে ধীরে।
নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি
আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, "হারিয়ে গেছি আমি।"'
অল্পবয়সে কবিতাটা পড়ে মনটা কুহকে ভরে উঠেছিল, বামী কি মরে গেল, তাই ওরকম চৈত্রের আকাশের দিকে চেয়ে তার বাবা অমন আকাশময় অ্যালিগরির কথা ভাবছে? যে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন- ব্যথাবেদনার পরশরতন গেঁথে গেঁথে পরমেশ্বর আমাদের জীবন সাজান, সেই রবীন্দ্রনাথও যে তেমনি বাবা। সন্তানদের মরণযাত্রা তাঁকে বারবার দেখতে হয়েছে। ১৯১৮ সালে এই পলাতকা কাব্যের প্রকাশ, ১৯১৮তে রবীন্দ্রনাথ একে একে তিনটি সন্তানের মৃত্যু দেখে ফেলেছেন। সন্তানহারা শিল্পী-সাহিত্যিকদের কথা বলবো আজ, যে শোকে রাজা আর ঋষি সমান পরাভব মানেন- যে শোকের কোনো তুলনা ত্রিভূবনে নেই। ব্যথাবেদনার পরশরতন গেঁথে গেঁথে সত্যিই কি তাঁরা সেই শোকের সমাধিতে সাজাতে পেরেছিলেন আলোর ঝালর!

রবীন্দ্রনাথের মতো করে সন্তানশোক সইতে হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামকেও। কৃষ্ণ মুহাম্মদ এবং অরিন্দম খালেদ (বুলবুল) দুটি ছেলে নজরুলের, কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের কয়েক মাস পরেই মারা যান। বুলবুল মারা যান খুব অল্পবয়সে (সম্ভবত- ৩-৪ বছর বয়সে), বসন্তরোগে। এই বুলবুল অসুস্থ হলে, ছেলের চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে রেলগাড়িতে চেপে কলকাতায় কল্লোল পত্রিকার কার্যালয়ে আসার পথে আনমনে একটি কাগজে ছাপা বিজ্ঞাপনের উল্টা পৃষ্ঠায় পেনসিল দিয়ে গজল লিখেছিলেন কবি- বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল-শাখাতে দিস নে আজি দোল। ছেলে বসন্তে আক্রান্ত হবার পর নজরুল ডাক্তার-বদ্যির কাছে প্রাণপণ দৌড়েও তাকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি।
লোকমুখে শুনেছিলেন, দমদমের কাছে এক জাগ্রত সাধু আছেন, যিনি বসন্তরোগীদের সুস্থ করতে পারেন, বিশ্বস্ত দুই সঙ্গী মৈনুদ্দিন আর শান্তিপদ সিংহকে অবিলম্বে পাঠালেন সাধুর কাছে। সাধুসমেত তাঁরা যখন এলেন তখন বেশ রাত, মৈনুদ্দিন তাঁর 'যুগ স্রষ্টা নজরুল' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, 'আমাদের সাড়া পেয়ে কবি ছুটে এলেন। বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ওরে মৈনুদ্দিন, সাধু কি মরদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে? কবি আমার কাঁধ বারবার ঝাঁকাতে লাগলেন। আর একই কথা বারবার বলতে লাগলেন।' সন্তানের মৃত্যু প্রাণোচ্ছল এই কবির জীবনকে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল। কেউ বলেন, এই মৃত্যুর পর তিনি আধ্যাত্ম্য সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। কবি জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন, নজরুলকে তিনি একদিন খুঁজে পেলেন ডিএম লাইব্রেরির এক কোণে, পুত্রশোক ভোলার জন্য হাসির কবিতা লিখছেন আর কেঁদে চলেছেন। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল।

বুলবুলের রোগশয্যায় বসে তিনি অনুবাদ করলেন 'রুবাইয়াৎ ই হাফিজ', বুলবুলকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে লিখলেন, "তোমার মৃত্যু শিয়রে বসে 'বুলবুল ই সিরাজ' হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি- উড়ে গেছো। যে দেশে গেছো সে কি বুলবুলিস্তান, ইরানের চেয়েও সুন্দর? জানি না তুমি কোথায়? যে লোকেই থাকো, তোমার শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষদান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।" বুলবুলের মৃত্যুতে নলিনী সরকার পুত্রহারা নজরুল সম্পর্কে লিখলেন, "আমাকে দেখে অতবড় দুর্দম বিদ্রোহী নজরুল 'আমার বুলবুল উড়ে গেছে নলিনীদা' বলে আমার সামনে আছড়ে পড়লো।" বুলবুলের মৃত্যুর পর কবি লিখলেন কালজয়ী দুটি গান, 'ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি' এবং 'শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়, তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরে যায়'! কেউ বলেন- 'ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি' গানটি লিখে তাঁকে দাফনের খরচ জোটাতে হয়- গবেষকরা কেউ সেটা অস্বীকার করেন, আমার মনে হয় নজরুলের দুর্দমনীয় জীবনে বিষাদ প্রায় গ্রীক ট্র্যাজেডির মতো বিপুল- এই গজল লিখে দাফনের খরচা যোগাড় করার মিথটা যেন সেই বিপুল বেদনার সঙ্গে বেশ মানানসই!

মৃত্যুর সঙ্গে আসে সৎকার- অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া- দাফন, আসে খরচের প্রসঙ্গ, আর প্রকট হয়ে ওঠে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই মর্মস্পর্শী উপদেশ- "দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।" স্ত্রী কমলা একবার মৃত শিশু প্রসব করেছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সে ঘটনার কথা ডায়েরিতে লিখেছিলেন, "বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।" নিজের ছোট্ট মেয়েটি ম্যালেরিয়ায় ভুগে এক হেমন্তরাতে মারা গেলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি বলেছিলেন—এ রাত্রি কোনোকালে শেষ হবে না। কে জানে, সেই ব্যথার মাত্রা জেনেই 'অগ্রদানী' গল্পের সেই বামুনটির (পূর্ণ চক্রবর্তী) দুর্বিষহ পরিণতিটি রচনা করতে পেরেছিলেন কি না। জসীম উদ্দীনের পল্লীজননী আমাদের পাঠ্য ছিল,
"ছোট কুঁড়েঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।
ছেলে কয়, 'মারে, কত রাত আছে, কখন সকাল হবে,
ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে।" …পড়তাম আর ভাবতাম, জসীম উদ্দীন অত বিস্তারিত বিবরণ কেমন করে জানেন? তিনিও কি রাত জেগেছিলেন সন্তানের শিয়রে? মৃত্যুভয় তাড়া করেছিল তাঁকে? মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়ে সাদাত হোসেন মান্টো মাতাল হয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। সেই রোগগ্রস্ত মেয়েটি কি বেঁচে ছিল?

প্রতিভা বসুর 'জীবনের জলছবি'তে লিখেছিলেন- আমি তো সবকিছুরই স্বাদ জানি। জীবনে পরিপুর্ণ সুখের স্বাদ পাবার পর তিনি একে একে দুঃসহ সব ক্ষতির শিকার হতে লাগলেন, এলো আকস্মিক মৃত্যু, এলো প্রিয়-বিচ্ছেদ। সইলেন। এরপর এলো পুত্র পাপ্পা তথা শুদ্ধশীল বসুর মৃত্যু। তিনি লিখেছিলেন- "যিনি নিষ্ঠুর তিনিই কৃপাময় কিনা জানি না। এ-ও জানি না সত্যিই এমন কোনো শক্তিমান প্রভু অনন্ত আকাশে বিরাজ করছেন কিনা, যাঁর শক্তিতে বাতাস বয়, বৃষ্টি নামে, সূর্য ওঠে, আমরা আমাদের অগোচরেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করি, জগতের সব কিছুই নিয়মিত লয়ে চলতে দেখি। শুধু জানি আমরা সবাই যেন কার খেলার পুতুল, যেভাবে খেলাচ্ছেন সেভাবেই খেলছি, খেলাতে খেলাতে যেভাবে মারছেন সেভাবেই মরছি অথচ কীভাবে মারবেন তাও যেমন জানি না, কবে মারবেন তাও জানি না। এই পুতুল নাচের অদৃশ্য সুতোটা কার হাতে ধরা আছে তাও জানি না… আমি অনুভব করলাম আমার বুকের ভিতর থেকে কে যেন উপড়ে টেনে ছিঁড়ে আমার হৃদপিন্ডটা খসিয়ে নিল।
আমি জানলাম পৃথিবীতে দৈহিক এবং মানসিক যতো দুঃখ বেদনা অপমান লাঞ্ছনা এমনকি অতি প্রিয়জনের মৃত্যুশোকই হোক না কেন, সন্তান বিয়োগের সমতুল্য কিছুই নয়। এবং মানুষের সহ্যশক্তি অপরিসীম। তা না হলে আমার মৃত্যু হলো না কেন?" ডাক্তার তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিতে চাইলে তিনি অসম্মত হয়েছিলেন, কোনো ঘুমের ওষুধ তীব্রতায় তাঁর শোককে হারাতে পারবে না তো! বরং অনন্ত নিদ্রার যদি কোনো ওষুধ থাকে তবে তাই দেয়া হোক তাঁকে। তারপর জীবন আবার চলতে থাকে, ঈশ্বরপ্রেরিত পুত্র কন্যারা এসে মা বলে ডাকে (গর্ভধারিনী মা নয়, নির্বাচিতা মা, তাই বা কম কীসে), সংসার আবার ভরে ওঠে সোনামানিকে। প্রতিভা বসু ভাবেন- এখন এই এদের নিয়েই আমার জীবনযমুনা প্রবাহিত।

শহীদজননী জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে সন্তান হারানো মায়ের এক অবিস্মরণীয় উপাখ্যান। তাঁর কোলে মাথা রেখে এই তো শুয়ে ছিল রুমী- ইলিনয়ে পড়তে যাবার আমন্ত্রণ ফেলে যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে- যার জেদের কাছে নত হয়ে মা বলেছেন- তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে দিলাম! এই তো কোলকাতার রেডিও থেকে ভেসে আসছিল গান- একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। পরমুহূর্তে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম আর তার সহযোগী বিহারীদের হাতে ধরা পড়ে গেল রুমী। এরপর সারা একাত্তর জাহানারা ইমাম ছেলে ফিরে আসবে কি আসবে না সেই দোলাচলে কাটালেন, খুঁজে বেড়ালেন আদরের সন্তান রুমীকে। বন্দীদের ওপর অসহনীয় অত্যাচারের বিবরণ শুনে কাঁদতে কাঁদতে মুর্চ্ছা গেলেন। মিষ্টির সওগাত নিয়ে মগবাজারের পাগলা পীরের পায়ে উপুড় হয়ে পড়বেন বলে ঠিক করলেন। শোকে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করলেন- "আমি জানতে চাই রুমীকে কতোখানি টর্চার করেছে।… দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছ থেকে খবর পেয়ে মিলিটারি আমার রুমীকে ধরে কতোখানি টচার করেছে, আমি জানতে চাই।" সামরিক জান্তার কাছে মার্সি-পিটিশন করবেন না সেই সিদ্ধান্ত নিলেন। অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর এমন দুঃসময়কে উপেক্ষা করে বাগানের গোলাপগুলো ফুটে উঠেছে, বনি প্রিন্স গোলাপ…হায় তাঁর বনি প্রিন্স- সুকুমার যুবরাজ আজ কোথায়?

ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন তাঁর কন্যা ফারিয়া লারাকে হারিয়ে রচনা করেছিলেন কয়েকটি শোকগাঁথা- সেসব তখন দৈনিকে ছাপা হতো, পড়তাম আর ভাবতাম সেই দৃশ্য- অন্ধকার বনে-পাহাড়ে সন্তানহারা মা শোকের সাগর পাড়ি দিচ্ছেন। কি ভয়ানক সেই যাত্রা। ঠিক যেভাবে প্রতিভা বসু জীবনের এক সন্ধিক্ষণে দীঘার ফাঁকা কটেজে ঝাউবনের সোঁ সোঁ দীর্ঘশ্বাসের শব্দের ভিতর নিমজ্জিত হয়ে বসে শোক করেছিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের, অত রক্তস্নানের পরেও অসামান্য শিল্পরচনা করবার। হুমায়ূন আহমেদ জীবদ্দশায় একাধিক সন্তানকে হারিয়েছিলেন, তাঁর একাধিক লেখায় এই সন্তানদের নিয়ে শোকতাপ আছে। মহাশ্বেতা দেবী কোলের ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যকে ছেড়ে এসেছিলেন সাহিত্যিক জীবনের দায়ভার কাঁধে নিয়ে, অভিনেতা বাবা আর লেখক মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন নবারুণ। 'শেষ ইচ্ছে'য় নবারুণ লিখেছিলেন-
'তুমি আমার ছেলেকে
প্রথম অক্ষর শেখাবার সময়ে
ওকে মানুষ, রোদ্দুর আর তারাদের ভালোবাসতে শিখিও
ও অনেক কঠিন কঠিন অঙ্ক করতে পারবে
বিপ্লবের অ্যালজেব্রা ও আমার চেয়ে
অনেক ভালো করে বুঝবে
আমাকে হাঁটতে শেখাবে মিছিলে
পাথুরে জমিতে আর ঘাসে…' জীবদ্দশায় এই ছেলের মৃত্যুশোক সইতে হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীকে।

রুডইয়ার্ড কিপলিং প্রথম মহাযুদ্ধে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে তাঁর ছেলে জনকে হারিয়েছিলেন, জীবন বদল করে দেয়া সেই আঘাতের ছোঁয়াচ লেগেছিল তাঁর সাহিত্যে, বদলে গেছিল তার সুর তার রঙ। ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও বদলে গেছিলেন কিপলিং- হয়ে উঠেছিলেন রুষ্ট- তিক্তবিরক্ত আরেক মানুষ (রবীন্দ্রনাথ- নজরুল- বিভূতিভূষণের মতো করে প্রিয়জনের চিহ্ন খুঁজেছিলেন সুপারন্যাচারালে)। কিপলিং-এর প্রসিদ্ধ কবিতা 'মাই বয় জ্যাক' যেন সেই জনকে অন্বেষণরত বাপের আর্তি, যুদ্ধে যাওয়া জ্যাকের বাবা জলের ঢেউয়ের কাছে বাতাসের কাছে খুঁজে ফিরছেন ছেলের খবর- বহুকাল পর ঠিক যেভাবে শহীদজননী জাহানারা ইমাম খুঁজবেন রুমীর চিহ্ন। ব্যক্তিগতভাবে আমার অসম্ভব প্রিয় কিপলিং এর 'দে' (তাহারা), মোটরগাড়ি পথ ভুলে একটি বাগানবাড়ির সামনে এসে হাজির হয়, যেখানে শিশুরা খেলছে…এরা কি এমন শিশু যারা মৃত, যে শিশুদের কেবল তারাই দেখতে পায় যারা সন্তান হারিয়েছে? শিউরে উঠবার মতো প্লট, জীবন-মৃত্যুর সীমানায় সরু স্বচ্ছ অনতিক্রম্য পর্দাটির মতো দোলায়মান, শোকের এক আশ্চর্য ধ্যান কিপলিং-এর 'দে'।
আট বছরের শিশুপুত্র আনাতোলকে হারিয়ে কবি স্তেফান মালামে একটি 'কাব্যসমাধি' তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন, যে ভল্টে চুপচাপ গচ্ছিত থাকবে তার অ-যাপিত জীবন। এ কাজটি কখনো শেষ করেননি তিনি। হয়তো আরো গভীর-গোপন কোনো সিন্দুকের সন্ধান পেয়েছিলেন এই প্রক্রিয়ায়।

চীনা সাহিত্যিক ইউন লী দুই ছেলেকে হারিয়েছেন, বড় ছেলে ভিনসেন্ট ১৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করার পর তিনি লিখেছিলেন উপন্যাস- হোয়্যার রীজনস এন্ড। পারস্পরিক আলাপের ভঙ্গিতে লেখা, কখনো সেটা বাদানুবাদের আদল নিয়েছে। সন্তানকে বাঁচিয়ে তুলবার এক অদ্ভূত প্রয়াসে লিপ্ত হয়েই যেন লিখেছিলেন উপন্যাসটি- ছেলের গলার স্বর শুনতে পেয়েছেন, তাকে আবার চোখের সামনে দেখেছেন এই প্রক্রিয়ায়। ভিনসেন্টের জীবনের ষোলটি বছরের জন্য ষোলটা চ্যাপ্টার। এরপর ছোট ছেলে জেমস আত্মহত্যা করে ১৯ বছর বয়সে। বড়টি ছিল ভাবুক, ছোটটি চিন্তক। জেমসের মৃত্যুর পর লী ভেবেছিলেন- তাঁর কাছে আর ভাবপ্রকাশের মতো শব্দ নেই। তারপর একদিন লিখলেন স্মৃতিকথা- থিংজ ইন নেচার মেয়ারলি গ্রো।
গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সোফি ম্যাকবেইনকে তিনি বলেছেন- লেখাটি তিনি লিখলেন যেন ঘুর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বসে, যেখানে সবকিছু স্থির আর স্পষ্ট। লেখা শেষ করে ফিরে গেলেন ঘুর্ণিবাত্যায়, ঐ বাত্যাবিক্ষুব্ধ ঘুর্ণিই তো তাঁর জীবন এখন। কে বলে শোকের টানেলের শেষে আলো আছে? শোকের সঙ্গে অনেক ভাষাতেই ভার শব্দটার যোগ আছে (বাংলায়ও তো আছে শোকভার), তাঁর শোক তাঁর ভার নয়, কেননা তাঁর সন্তানরা তাঁর ভার ছিল না। শোক অতল, কিন্তু ঐ অতলেই তাঁর বাস্তু এখন।

দুই বছর বয়সী মেয়েকে হারিয়ে শোকসন্তাপের হাত থেকে বাঁচতে জেসন গ্রীন অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন লেখাকেই, সৃষ্টি হয়েছিল 'ওয়ান্স মোর উই স স্টারস'-এর। শান্ত একটি দিনে শান্ত মেয়েটি দিদিমার পাশে শান্ত একটি বেঞ্চে বসে ছিল, আটতলার ওপর থেকে একটা ইট পড়ে মেয়েটি মারা যায়। কেন যেন আমার এখানে শিল্পী এরিক ক্ল্যাপটন শিশুপুত্রের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে গায়ক রয় অর্বিসনের জীবনের ভয়াল ট্র্যাজেডি। ড্যানিশ সাহিত্যিক নায়্যা মারী-আইত ২৫ বছর বয়সী তরতাজা পুত্র কার্লকে হারিয়েছিলেন। প্রকৃতি প্রাণীকে শিখিয়েছে সে সন্তানধারণ করবে- তারপর মরে যাবে কিন্তু তার চিহ্ন রয়ে যাবে। সন্তানের মৃত্যুমাত্রেই অকালপ্রয়ান- সন্তানের মৃত্যু তাই তার কাছে প্রকৃতিবিরুদ্ধ, সন্তানকে নিয়ে সমস্ত ভবিষ্যত-কল্পনার সমাপ্তি, সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে- এরপর 'বাকি-জীবন' কাটাবার প্রাকৃতিক প্রনোদনা। নায়্যা মারী-আইত সেসব একে একে সইলেন, নয় মাস পর ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করলেন স্মৃতিলেখ- 'হোয়েন ডেথ টেকস সামথিং ফ্রম ইউ গিভ ইট ব্যাক', জীবনকে বুঝবার ঐ এক প্রয়াস লেখকের, লিখতে থাকা।
লিখতে লিখতে নায়্যা মারী-আইত টের পেলেন এ মৃত্যুর শ্লোক নয় শুধু- এ জীবনের জয়গান। লিখবার সময় হাত বাড়ালেন অন্যান্য শোকগ্রস্তের দিকে- যেন একটি সমবেত বিষাদগীতি তৈরি করতে চেষ্টা করলেন, হাত বাড়ালেন সাহিত্যের দিকে (সহিত থেকে সাহিত্য)- সাহিত্য সেই শরণার্থী হাত জড়িয়ে ধরলো। ক্লদিয়া ডে 'দ্য প্যারিস রিভিউ'য়ে লিখেছিলেন, সন্তানের সঙ্গে মৃত্যুও আমার জীবনে প্রবেশ করবে সে বিষয়ে আমাকে কেউ সতর্ক করেনি। মৃত্যু নরম পায়ে ভেসে আসবে, তোমার গর্ভস্ফিত শরীরকে চক্রাকারে ঘিরে ধরবে, তারপর তোমার সন্তান যখন শরীর থেকে বের হয়ে যাবে- তখন সেই শিশুকেও মৃত্যুর চক্র ঘিরে ফেলবে। সোনালি দেরানিয়াগালা সুনামির হাতে হারিয়েছিলেন স্বজনসহ দুই পুত্রকে, তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র বেঁচে ফেরা সদস্য, অকথ্য শোকে লিখেছিলেন বই- 'ওয়েভ'।
সন্তান হারানোর বেদনা স্পর্শ করেছে বহু অভিনেতাকে, চার্লি চ্যাপলিন থেকে অ্যান্থনি কুইন, পল নিউম্যান, মার্লন ব্রান্ডো, জেরি লুইস, জন ট্রাভোল্টা, সিলভেস্টার স্টালোন। অনাগত সন্তানকে হারিয়েছিলেন কিয়ানু রিভস, মিয়া ফারো হারিয়েছেন দত্তক নেয়া সন্তানদের। জীবন চিরতরে বদলে গেছে এঁদের অনেকের, শিল্প চলেছে সময়ের হাত ধরে- কিন্তু বহতা নদীর গহ্বরে ঢুকেছে অগাধ বালি।

গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে লিখেছিলেন ওরিয়ানা ফালাচ্চি (লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ন), লিখেছিলেন মায়রা টাসিন (পুওর ইওর সোল), যদ্দূর মনে পড়ে এমন মনোলগ পড়েছিলাম শিল্পী ট্রেসি এমিনের কলমেও— প্রতিটিই গর্ভপাতের পটভূমিতে লেখা। বেগম আখতার নাকি সাতবার গর্ভপাত সয়েছিলেন। কন্ঠে ঐ যে সোনালি বেহালা থেকে চুঁইয়ে পড়তো বুকভাঙা হাহাকার- তা কি আর এমনিতে! শেষ গানটি কী গেয়েছিলেন তিনি? অ্যায়, মোহাব্বত, তেরি আনজাম পে রোনা আয়া? সবচেয়ে বড় ভালোবাসা প্রাণঘাতী ছোবল দিয়ে যায়, অমন করে আর কিছু কাঁদায় কি!
সন্তানহারা শিল্পীসাহিত্যিকের এই মৃত্যুশোক সয়ে করা কাজগুলো কি অত প্রচন্ড ব্যক্তিগত বেদনার প্রদর্শনী? আজকাল সবই 'প্রদর্শনের নিমিত্ত তৈরি' ভাবা হয় কিনা। ইতিহাসবিদ স্তেফান গার্সন ছেলেকে হারিয়ে লিখতে বসেছিলেন, তিনি অ্যানি এর্নোর জবানিতে এর কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন, এর্নো বলেছিলেন- "আমার জীবনে যা ঘটেছে- তা আমার জীবনেই ঘটেছে বলে লিখি তা নয়, লিখি কারণ ওসব ঘটেছে, তার মানে ওসব ঘটে, ওসব অনন্য নয়, একমাত্র নয়।" এখানে আমার রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে যাচ্ছে আরেকবার— 'রচি মম ফাল্গুনী'।
আনন্দ রূপ আলো ব্যথা মৃত্যু সবকিছুর ছলকে পড়া বিন্দু দিয়ে তৈরি সেই ফাল্গুনের আখ্যান। জীবন ব্যথাময়, শিল্পীর জীবন তার ব্যতিক্রম নয়। সামান্য পার্থক্য এই যে সে ব্যথার ফুল ফোটায়, অস্কার ওয়াইল্ডের সেই গোলাপকাঁটা বুকে-বেঁধা নাইটিঙ্গেল সে- একরাতে শাদা ফুলকে রক্তিম করে তুলে কি এক স্বগত-সার্থকতায় মরে যায়।