বুনো বিড়াল থেকে পোষা বিড়াল: রহস্যময় রূপান্তরের অজানা ইতিহাস

জিনগত বা জেনেটিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নতুন নতুন আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে বন বিড়ালরা মানুষকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছিল, আগে যা মনে করা হতো, তার থেকেও অনেক আগে। অন্যদিকে রূপান্তরের পর্বটি সম্পন্ন হয়েছিল–আগে যা মনে করা হতো, সে জায়গায় নয়। ভিন্ন আরেক জায়গা।
'দ্য ইভাল্যুশন অব হাউস ক্যাট' শিরোনামে সায়েন্টিফক আমেরিকায় এ নিয়ে যৌথভাবে লিখেছিলেন কার্লোস এ ড্রিসকোল, জুলিয়েট ক্লাটন-ব্রক, অ্যান্ড্রু সি কিচনার ও স্টিফেন জে. ও'ব্রায়েন।
বিড়ালকে কখনো গম্ভীর আর নিরাসক্ত মনে হয়। আবার কখনো মনে হয় মায়াময়, ভালোবাসায় ভরা পোষা প্রাণী। আবার কখনো শান্ত, তো পরক্ষণেই হিংস্র। কখনো মন মাতানো, কখনো বিরক্তিকর। ক্ষণে ক্ষণে মতিগতি বদলায়। তারপরও বিড়ালই পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা প্রাণী। কেবল আমেরিকাতেই এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে বিড়াল রয়েছে। আর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬০০ কোটি বিড়াল মানুষের সঙ্গে বসবাস করছে। এটি কয়েক বছর আগের হিসাব। এখন এ সংখ্যা হয়তো বেড়েছে। অন্তত কমেনি সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়।
কিন্তু এত পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের সাথে বিড়ালের সম্পর্কের শুরু বা মাখামাখি সূচনার রহস্য পুরোপুরি জানা যায়নি। গাধা, ঘোড়া, গরু, ছাগল বা ভেড়া মানুষ পোষ মানিয়েছিল দুধ, গোশত এবং পশম বা হাল বা গাড়ি টানা বিংবা ভারবহন বা দূরপাল্লার পথ পাড়ি দেওয়ার কাজে সাহায্যের জন্য। কিন্তু বিড়াল না খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়, না মানুষের কাজে সহায়তা করে। কখনো কখনো ইঁদুর বা সাপ মারে। তা-ও শহরে পোষা বাবু বিড়ালগুলো এসব কাজ কখনো করে না। তাহলে কীভাবে মার্জার মহাশয় আমাদের ঘরে জায়গা করে নিল?
অনেককাল ধরেই গবেষকেরা মনে করতেন, প্রায় ৩৬০০ বছর আগে প্রাচীন মিসরীয়রাই প্রথম বিড়ালকে পোষ মানিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে জেনেটিক আর প্রত্নতাত্ত্বিক নতুন আবিষ্কার এই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এখন আমরা আরও ভালোভাবে জানি বিড়ালের পূর্বপুরুষ কোথা থেকে এসেছে। মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কীভাবে শুরু হয়েছে।
পোষা বিড়ালের প্রথম চল কোথায় শুরু হলো, তা খুঁজে বের করা কঠিন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সব পোষা বিড়ালই ফিলিস সিলভেস্ট্রিস নামের এক প্রজাতির বন বিড়াল থেকে এসেছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলেন না; কারণ, ফিলিস সিলভেস্ট্রিস ইউরোপ, আফ্রিকা আর এশিয়া অর্থাৎ পুরোনো পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে ছিল। স্কটল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত সব জায়গায়ই ছিল এদের বসবাস। বন বিড়ালের কোন ধরন থেকে আজকের দিনের পোষা বিড়ালের উদ্ভব, তা ঠিকঠাকভাবে বের করার পদ্ধতিও তখন তাদের কাছে ছিল না। অতি সাম্প্রতিককালে অবশ্য তারা এ পদ্ধতি বের করতে পেরেছে। পোষা বিড়ালের উদ্ভব মিসরে। এক দল এ কথা বলতেন সেকালে। অন্য দলগুলো পৃথক পৃথক জায়গায় বিড়ালের পোষ মানানোর কাজটি প্রথমে হয়েছে বলে দাবি করতেন।

এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের বন বিড়াল আর বনে জন্মানো পোষা বিড়াল দেখতে প্রায় একই রকম। সমস্যা হলো, বন বিড়াল আর বনজ পোষা বিড়াল (যাদের গায়ে মাছের কাঁটার মতো দাগ থাকে) দেখতে প্রায় একই রকম। সবার শরীরেই একই রকম বাঁকা ডোরা দাগ রয়েছে। এছাড়া এরা একে অপরের সঙ্গে সহজেই মিলে যায় বা প্রজনন করে, ফলে কোন বিড়াল কোন দলের, নির্ণয় করা বেশ কঠিন।
২০০০ সালে ড্রিসকোল এই রহস্য সমাধানের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের ৯৭৯টি বুনো আর গৃহবিড়ালের ডিএনএ সংগ্রহ শুরু করেন। বুনো বিড়াল সাধারণত জীবনের পুরোটা এক এলাকায় কাটায়। তাই ধারণা করা হয়েছিল, একেক অঞ্চলের বুনো বিড়ালের ডিএনএ আলাদা হবে। যদি পোষা বিড়ালের ডিএনএ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বুনো বিড়ালের সঙ্গে মিলে যায়, তবে সেখানে থেকেই পোষা বিড়াল পালনের চল শুরু হয়েছিল বলে প্রমাণ হবে।
২০০৭ সালে প্রকাশিত ডিএনএ বিশ্লেষণে ড্রিসকোল, ও'ব্রায়েন ও তাদের অপর সহকর্মীরা দুই ধরনের ডিএনএ পরীক্ষা করেন–মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (যা মায়ের থেকে আসে) আর নিউক্লিয়ার ডিএনএর ছোট পুনরাবৃত্তি ধারা (মাইক্রোস্যাটেলাইট)। কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে তারা প্রতিটি বিড়ালের ডিএনএ একে অপরের সঙ্গে তুলনা করে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। তারপর পরীক্ষা করেন মিলিয়ে যাওয়া বিড়ালের মধ্যে বেশির ভাগ একই অঞ্চলের কি না।
ফলে তারা বুনো বিড়ালের পাঁচটি জেনেটিক গোষ্ঠী বা লাইনেজ খুঁজে পেয়েছেন। ইউরোপে ফিলিস সিলভেস্ট্রিস সিলভেস্ট্রিস, চীনে এফএস বিয়েতি, মধ্য এশিয়ায় এফএস অর্নাটা, দক্ষিণ আফ্রিকায় এফএস কাফ্রা আর পঞ্চম লাইনেজে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এফএস লিবিকা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই এফএস লিবিকা গ্রুপে পড়েছে বিশ্বের সব পোষা বিড়াল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর জাপানের বিভিন্ন জাতের বিড়ালও। অধিকৃত ফিলিস্তিন বা ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর সৌদি আরবের মরুভূমি থেকে সংগ্রহ করা এফএস লিবিকা বুনো বিড়ালের জিনের সাথে পোষা বিড়ালের জিনের সাদৃশ্য রয়েছে। দুটো জিনই প্রায় অভিন্ন। তার মানে আজকের দিনের পোষা বিড়ালের উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্যের লিবিকা বুনো বিড়াল থেকেই, অন্য কোথাও নয়।
পোষা বিড়ালের উৎপত্তি না হয় জানা গেল, কিন্তু এবার প্রশ্ন হলো, কখন মানুষ বিড়ালকে পোষ মানিয়েছিল? বিজ্ঞানীরা অনেক সময় 'মলিকুলার ক্লক' বা ডিএনএর পরিবর্তনের হার ব্যবহার করে বিবর্তনের সময়কাল অনুমান করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর জন্য, যেমন বিড়ালের গৃহপালন সূচনা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার বছর আগে। সে ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি যথেষ্ট নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা যায় না। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসা।

২০০৪ সালে জ্যঁ-দেনি ভিগন ও সহকর্মীরা সাইপ্রাস দ্বীপে ৯৫০০ বছর পুরোনো কবরের সন্ধান পান। করবটিতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এবং একই সাথে আট মাস বয়সী একটি বিড়ালকে একসঙ্গে সমাহিত করা হয়েছিল। মানুষ ও বিড়ালকে মাত্র ৪০ সেন্টিমিটার তফাতে একই দিকে মুখ করে শোয়ানো ছিল। সাইপ্রাস দ্বীপে প্রাকৃতিকভাবে বিড়াল ছিল না। কাজেই মানুষই নৌকায় করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিড়াল নিয়ে গিয়েছিল। বিড়ালকে সমুদ্রপথে নিয়ে যাওয়া এবং মানুষের পাশে সমাধি দেওয়া প্রমাণ করে যে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মানুষ-বিড়ালের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল। এটা ডিএনএ গবেষণার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। সেই সময় ফার্টাইল ক্রিসেন্ট অঞ্চলে,বর্তমান ইরাক-সিরিয়া-ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল। এ ভূখণ্ডে বিড়ালকে পোষ মানানোরও প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল।
বোঝা গেল, কোথায় এবং কখন বিড়াল মানুষকে সঙ্গী করল। এবার প্রশ্ন হলো, কেন? অধিকাংশ গৃহপালিত প্রাণী এসেছে গোষ্ঠীবদ্ধ প্রজাতি থেকে, যেখানে নেতা থাকে। মানুষ সেই নেতার জায়গা নিয়ে প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। গরু বা ভেড়ার মতো এই গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণী আগে থেকেই গায়ে গায়ে লাগিয়ে একসাথে থাকতে অভ্যস্ত। তাই খাবার আর আশ্রয়ের অভাব না থাকলে তারা সহজেই বন্দী অবস্থায় মানিয়ে নিতে পারে।
কিন্তু বিড়াল একাকী শিকারি, দলবদ্ধ নয়। নিজেদের এলাকা নিয়ে হিসাব খুবই টনটন। রক্ষণশীল। নিজ এলাকা রক্ষায় অন্য পুরুষ বিড়ালের সঙ্গে লড়াই করে। শুধু সিংহ দলবদ্ধ থাকে। সিংহরা পরিবার নিয়ে বা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। দলে অনেক সিংহ একসঙ্গে থাকে, একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং শিকার করে। সাধারণত একটি দলে থাকে কয়েকটি স্ত্রী সিংহ, তাদের শাবকেরা এবং এক বা দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সিংহ। অন্য বিড়াল প্রজাতির মতো একা না থেকে সিংহরা সাধারণত এভাবে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে।
আরও বড় কথা, গৃহপালিত প্রাণীর অনেকেই উদ্ভিদভোজী, যা সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু বিড়াল বাধ্যতামূলক মাংসাশী। আর তারা মানুষের কথা শুনতেও পছন্দ করে না। ফলে মানুষ পরিকল্পিতভাবে বিড়ালকে কোনো কাজে লাগানোর জন্য পোষ মানানোর চেষ্টা করেনি; বরং বিড়ালই মানুষের কাছে আসতে শুরু করেছিল নিজের সুবিধার জন্য।
প্রায় ৯-১০ হাজার বছর আগে ফার্টাইল ক্রিসেন্ট অঞ্চলে ছোট ছোট কৃষি গ্রাম গড়ে উঠতে শুরু করে। শস্যের গুদামগুলোতে ভারত থেকে আগত ঘরের ইঁদুর বা মুস মাকুলাস ডোমেস্টিকাসকুল মানুষের আশেপাশে বসবাস শুরু করে। অধিকৃত ফিলিস্তিন বা ইসরায়েলের প্রাচীন শস্যগুদামে ১০ হাজার বছরের পুরোনো ইঁদুরের হাড় পাওয়া গেছে। মানুষের আশেপাশে এই ইঁদুরের বসতি বুনো বিড়ালকে টেনে এনেছিল। গ্রামগুলোর আবর্জনার স্তূপও বিড়ালের জন্য খাবারের উৎস হয়ে ওঠে। ফলে মানুষকে না ভয় পাওয়া বুনো বিড়ালরা এভাবে মানব বসতির কাছাকাছি বসবাসের জন্য টিকে যায়। ছোট ছোট বিড়াল খুব বেশি ক্ষতি করে না। এ গুণ দেখে মানুষ তাদের আশেপাশে বিড়াল থাকালে বিরক্ত হতো না। বরং যখন মানুষ বিড়ালদের ইঁদুর আর সাপ মারতে দেখে, তখন তাদের পাশে পাশে থাকতে উৎসাহই দিত। বিড়ালের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণও ছিল। কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, বুনো বিড়ালদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, যা তাদের মানুষ-ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য আগেভাগেই উপযুক্ত করে দিয়েছিল। বিশেষ করে, তাদের বড় বড় চোখ, ছোট নাকওয়ালা মুখ আর উঁচু, গোল কপাল–এসব 'কিউট' বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে বিড়ালের প্রতি মমতা জাগায়। সম্ভবত এই কারণেই অনেকে শুধু মায়ার বশে বাচ্চা বিড়ালকে ঘরে নিয়ে পুষতে শুরু করে। আর সেখান থেকেই মানুষ আর বিড়ালের বন্ধুত্বের শুরু। এসব বিড়ালের বংশধর মানুষের কাছাকাছি থাকতে অভ্যস্ত হয় যায়। এভাবেই বিড়াল পোষ মানে বা গৃহপালিত হতে শুরু করে।

তাহলে প্রশ্ন, কেন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের এফএস লিবিকা বুনো বিড়াল পোষা বিড়ালের পূর্বপুরুষ হলো? ইউরোপ বা চীনের অন্য বুনো বিড়ালরা কেন নয়? ধারণা, ইউরোপ আর চীনের বুনো বিড়াল মানুষের কাছে কম সহনশীল ছিল, তাই তারা গৃহপালিত হয়নি। আর দক্ষিণ আফ্রিকা বা মধ্য এশিয়ার বুনো বিড়ালদের বাসস্থানের কাছাকাছি কৃষির সূচনা হয়নি, তাই তারা গৃহপালনের পথে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের এফএস লিবিকা ফার্টাইল ক্রিসেন্টের কৃষি গ্রামগুলোর কাছাকাছি থাকার প্রাথমিক সুযোগ পেয়েছিল। কৃষির বিস্তারের সাথে পাল্লা দিয়েই তাদের ছানাপোনারা নতুন নতুন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, অন্য বুনো বিড়ালের জায়গা দখল করে নেয়।
কত দ্রুত বুনো বিড়াল পুরোপুরি গৃহপালিত হলো, সে কথা পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। ১৯৫৯ সালে রাশিয়ার এক বিখ্যাত পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা বুনো শিয়ালকে মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে পুরোপুরি পোষ মানিয়ে ফেলেছিলেন। শুধু শান্ত স্বভাবের শিয়াল বেছে বেছে প্রজনন করেই এ কাজ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন কৃষকেরা বিড়ালের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। কারণ, প্রাচীন মানুষের ঘরে দরজা-জানালা ছিল না। বিড়াল অবাধে আসা-যাওয়া করত। বনে থাকা বুনো বিড়ালের সঙ্গেও মিশত। ফলে গৃহপালন প্রক্রিয়াটি ছিল ধীরে ধীরে, হাজার হাজার বছর সময় লেগেছে।
বিড়াল পোষ মানানোর সঠিক সময় জানা যায়নি। তবে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। সাইপ্রাসের আবিষ্কারের পর সবচেয়ে পুরোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে ইসরায়েলের অধিকৃত ফিলিস্তিনে। ইহুদিবাদীর অধিকৃত এ ভূমির খননস্থলে প্রায় ৯,০০০ বছরের পুরোনো বিড়ালের একটি দাঁত পাওয়া গেছে। আরেকটি বিড়ালের দাঁত পাওয়া গেছে পাকিস্তানে। সেটি প্রায় ৪,০০০ বছরের পুরোনো। এই প্রমাণগুলো মানুষ আর বিড়ালের সম্পর্কের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে রয়েছে। বিড়ালকে পুরোপুরি পোষ মানানোর সূত্রও মিলেছে আরও পরে।
৩৭০০ বছর আগের অধিকৃত ফিলিস্তিনের এক হাতির দাঁতের মূর্তিতে বিড়ালের চিত্রই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বোঝা যায়, মিসরে জনপ্রিয় হওয়ার আগেই মানুষের ঘরবাড়ির কাছাকাছি বিড়াল বাস করত। এটা স্বাভাবিক; কারণ, অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণী ও শস্যও মিসরে ফার্টাইল ক্রিসেন্ট থেকে গিয়েছিল। এ তালিকায় গাধার নাম অবশ্য নেই। তবে বিড়ালের পুরোপুরি পোষ মানার প্রমাণ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে ৩৬০০ বছর আগের মিসরের নতুন রাজবংশের সময়কার আঁকা ছবিগুলোয়। ছবিতে বিড়ালকে চেয়ারের নিচে, গলায় রশি বাঁধা, পাত্র থেকে খাবার খেতে অথবা টেবিল থেকে খাবারের টুকরো নিতে দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায়, তখন পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছিল মার্জারকুল।
মিসরের এই চিত্রগুলো দেখে প্রাচীন মিসরীয়দের বিড়াল পোষার পথিকৃৎ ভাবা হতো। কিন্তু মিসরের প্রাচীনতম বিড়ালের ছবি সাইপ্রাসের সমাধির চেয়ে বয়সে অন্তত ৫-৬ হাজার বছরের ছোট। অর্থাৎ মিসর বিড়ালকে পোষ মানানোর কাজ শুরু করেনি, তবে বিড়ালকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মিসরীয়রা বিড়ালকে এত ভালোবাসত যে ২৯০০ বছর আগে তারা পোষা বিড়ালকে দেবী বাস্তেত হিসেবে পূজা করতে শুরু করে। তখন বিড়াল উৎসর্গ করে, মমি বানিয়ে, বাস্তেতের নগর বুবাস্তিসে কবর দেওয়া হতো। মিসরে টনকে টন বিড়ালের মমি পাওয়া গেছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, মিসরীয়রা প্রথমবারের মতো নিয়মিতভাবে বিড়াল প্রজনন করত।
মিসর একসময় কয়েক শ বছর ধরে বিড়াল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কিন্তু ২৫০০ বছর আগে বিড়াল গ্রিসে পৌঁছে যায়, বোঝা যায় সে নিষেধাজ্ঞা বাস্তব ক্ষেত্রে জোরালোভাবে কার্যকর ছিল না। এরপর আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে শস্যবোঝাই জাহাজে বিড়াল ছড়িয়ে পড়ে রোমান সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে। কারণ, নাবিকেরা ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য বিড়াল রাখত। বন্দরনগরী থেকে বিড়াল আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০০ বছর আগে রোমান সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় বিড়াল রোমানদের সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে যায়। এর প্রমাণ জার্মানির টফটিং এলাকার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে পাওয়া যায়। এই খননকার্য চতুর্থ-দশম শতকের মধ্যে দেশটিতে বিড়ালের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। সেই সময় থেকেই ইউরোপীয় চিত্রকলা আর লেখায় বিড়ালের উল্লেখ বাড়তে থাকে। মজার বিষয় হলো, রোমানরা আসার আগেই ব্রিটেনে বিড়াল ছিল, কিন্তু তারা কীভাবে পৌঁছেছিল, তা এখনো অজানা।
প্রায় ২০০০ বছর আগে গ্রিস-রোম থেকে বাণিজ্যপথে বিড়াল চীন ও ভারতে পৌঁছায়। পূর্ব এশিয়ায় বুনো বিড়ালের প্রজাতি না থাকায় বিড়ালের ছোট ছোট গোষ্ঠী একেক অঞ্চলে একেক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়। এটি জেনেটিক ড্রিফট নামে পরিচিত এবং ডিএনএর এলোমেলো পরিবর্তনের কারণে এমনটি ঘটে। ফলে তৈরি হয় থাইল্যান্ডের কোরাট, সিয়ামিজ, বামির্জ প্রজাতি, যেগুলোর বর্ণনা থাই সন্ন্যাসীরা 'তামারা মেও' অর্থাৎ 'বিড়ালের কবিতা' গ্রন্থে লিখেছিলেন সম্ভবত ১৩৫০ সালেই। সাম্প্রতিক জেনেটিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, ইউরোপীয় ও এশীয় বিড়াল প্রজাতিগুলো অন্তত ৭০০ বছর ধরে আলাদা আলাদাভাবে বিবর্তিত হচ্ছে।
কীভাবে বিড়াল আমেরিকায় গেল, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অনেকে মনে করেন, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আর অন্যান্য অভিযাত্রীর জাহাজে বিড়াল ছিল। মেফ্লাওয়ার জাহাজ বা জেমসটাউন উপনিবেশের বাসিন্দারাও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ ও ভাগ্য ফেরানোর প্রতীক হিসেবে বিড়াল এনেছিল। ১৬০০-এর দশকে ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের হাত ধরে বিড়াল সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়, তবে নিশ্চিত প্রমাণ নেই। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিড়ালের জেনেটিক্স বিশ্লেষণ করে এই রহস্য বোঝার চেষ্টা করছেন।
মানুষ বিড়ালের নতুন বৈশিষ্ট্যের জন্য নিয়মিত প্রজনন শুরু করে সাম্প্রতিক সময়েই। এমনকি মিসরীয়রাও বিড়ালের গায়ের রং বা প্যাটার্ন নিয়ে প্রজনন করত না, প্রাচীন চিত্রে সব বিড়ালই একই ডোরা দাগের। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আধুনিক বিড়ালের বেশির ভাগ প্রজাতি উনিশ শতকের ব্রিটেন থেকে এসেছে। ১৮৭১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে প্রথম শখের বিড়াল প্রদর্শনীতে পার্সিয়ান বিড়াল বিজয়ী হয়, আর সিয়ামিজ বিড়াল খুব জনপ্রিয় হয়।
আজ ক্যাট ফ্যান্সিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাট অ্যাসোসিয়েশনের মতো সংস্থা প্রায় ৬০ প্রজাতির বিড়ালকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কয়েকটি জিনই বিড়ালের গায়ের রং, লোমের দৈর্ঘ্য, গঠন ও ঝলক নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৭ সালে অ্যাবিসিনিয়ান প্রজাতির বিড়াল 'সিনামনের' পুরো জিনোমসিকোয়েন্স করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বিড়ালের ত্বকের নানা বৈশিষ্ট্যের সাথে জড়িত জিন খুঁজে পেতে সাহায্য করে। তবে ত্বকের জিন বাদ দিলে বিড়ালের মধ্যে জেনেটিক পার্থক্য খুবই সামান্য–যেমন ফরাসি-ইতালিয়ান মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের মতোই ক্ষুদ্র।
নাম 'বেঙ্গল' কেন রাখা হয়েছে? হ্যাঁ, এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে লেপার্ড ক্যাটের বৈজ্ঞানিক নামের অংশ 'bengalensis' থেকে। কারণ, এশীয় লেপার্ড ক্যাটের প্রকৃত আবাস ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়া, অর্থাৎ 'বেঙ্গল' অঞ্চলের নাম থেকেই এর বৈজ্ঞানিক নাম এসেছে।
কুকুরের মধ্যে আকার ও স্বভাবে বিপুল বৈচিত্র্য দেখা যায়; কারণ, মানুষ তাদের শিকার বা পাহারার জন্য বেছে প্রজনন করেছিল। কিন্তু বিড়াল মানুষের কোনো কাজে লাগেনি, তাই ত্বক ছাড়া বিড়ালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য তৈরি হয়নি। মানুষ শুধু তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য পোষ মানিয়েছে।
পোষা বিড়াল মানুষকে সহ্য করে, কিন্তু অনেকেই মানুষের খাবার বা সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল নয়, নিজের মতো বাঁচতে পারে। কুকুরের চেয়ে পোষা বিড়াল দেখতে বুনো বিড়ালের মতোই। ছোট কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে–তাদের পা বুনো বিড়ালের চেয়ে ছোট, মস্তিষ্কও ছোট, আর চার্লস ডারউইন লিখেছিলেন, পোষা বিড়ালের অন্ত্র বুনো বিড়ালের চেয়ে লম্বা। মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কারণেই এ পরিবর্তন ঘটেছে। তা বলে বিড়ালের বিবর্তন থেমে নেই।
আধুনিক প্রজননকারীরা এখন কৃত্রিম প্রজনন ব্যবহার করে বুনো বিড়াল প্রজাতির সঙ্গে পোষা বিড়াল মিশিয়ে নতুন প্রজাতি তৈরি করছেন। যেমন বেঙ্গল প্রজাতি এসেছে এশীয় লেপার্ড ক্যাটের সঙ্গে পোষা বিড়ালের মিলনের ফলে। বেঙ্গল প্রজাতির বিড়ালের উদ্ভব ঘটেছে ১৯৬০-৭০-এর দশকে। আমেরিকান প্রজননবিদ জিন সাগডেন মিল প্রথমবার পোষা বিড়ালের সঙ্গে এশীয় লেপার্ড ক্যাটের (Prionailurus bengalensis) সংকর ঘটিয়ে এ বিড়াল তৈরি করেন। উদ্দেশ্য ছিল, নতুন জাতের বিড়ালটি হবে বুনো বিড়ালের মতো দৃষ্টিনন্দন স্পট বা দাগযুক্ত, কিন্তু স্বভাবে হবে পোষা বিড়াল।
নাম 'বেঙ্গল' কেন রাখা হয়েছে? হ্যাঁ, এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে লেপার্ড ক্যাটের বৈজ্ঞানিক নামের অংশ 'bengalensis' থেকে। কারণ, এশীয় লেপার্ড ক্যাটের প্রকৃত আবাস ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়া, অর্থাৎ 'বেঙ্গল' অঞ্চলের নাম থেকেই এর বৈজ্ঞানিক নাম এসেছে। তাই এই সংকর বিড়ালের নামও 'Bengal' রাখা হয়েছে। এ বিড়ালের 'বেঙ্গল' নামটি আসলে এর বন্য পূর্বপুরুষের বৈজ্ঞানিক নাম থেকে নেওয়া।
আর কারাক্যাট এসেছে ক্যারাকাল প্রজাতির মিলনের ফলে। ক্যারাকাল হলো মাঝারি আকারের এক ধরনের বন্য বিড়াল। বৈজ্ঞানিক নাম 'Caracal caracal'। এরা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার কিছু এলাকায় পাওয়া যায়।
ক্যারাকালের বৈশিষ্ট্য কান লম্বা আর কোনার দিকের লোম লম্বা ও কালো রঙের দেখতে অনেকটা তিরের মতো। দেহের রং সাধারণত লালচে-বাদামি। এরা খুব চটপটে শিকারি, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি ইত্যাদি ধরতে দক্ষ। 'ক্যারাকাল' শব্দটি এসেছে তুর্কি ভাষা থেকে–'কারা কুলাক' মানে 'কালো কান'। কারাক্যাট হলো পোষা বিড়াল আর ক্যারাকালের সংকর প্রজাতি। এতে ক্যারাকালের বন্য রক্ত আর পোষা বিড়ালের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ থাকে। ফলে গৃহবিড়ালের বিবর্তন এখন এমনভাবে বদলে যেতে পারে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
কুকুরের আকার ও কাজের বৈচিত্র্য এসেছে মানুষের প্রয়োজনমাফিক প্রজননের কারণে। কিন্তু মানুষ কখনো বিড়ালকে নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করতে চায়নি। তাই ত্বকের সামান্য রং আর দৈর্ঘ্য বাদে বিড়াল প্রায় এক রকমই থেকে গেছে।