অরুন্ধতী রায়ের নিষিদ্ধ বই ‘আজাদী’: নীরবতাই সবচেয়ে জোরালো শব্দ

নব্বইয়ের দশক থেকে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে চলছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলন দমনে ভারতীয় বাহিনীর দীর্ঘদিনের অভিযানে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। যদিও ভারত সরকার এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
গত ৯ আগস্ট সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় অরুন্ধতী রায়ে 'আজাদী'সহ ২৫পট বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অরুন্ধতী রায়ের 'আজাদী' বইটিতে কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে নিহত ও গুম হওয়া হাজার হাজার মানুষের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ হওয়া বইগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার স্নেডেনের 'ইন্ডিপেনডেন্ট কাশ্মীর', যেখানে কাশ্মীরের স্বাধীনতার সংগ্রাম বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
নিষিদ্ধ বইয়ের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিক্ষাবিদ হাফসা কানজওয়ালের 'কলোনাইজিং কাশ্মীর: স্টেট-বিল্ডিং আন্ডার ইন্ডিয়ান অকুপেশন' এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক সুমন্ত্র বোসের 'কনটেস্টেড ল্যান্ডস: ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, বসনিয়া, সাইপ্রাস অ্যান্ড শ্রীলঙ্কা'।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বহুদিনের স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে, অঞ্চলটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই সেখানে মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমনপীড়নের অভিযোগ ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে অভিযান চালায় পুলিশ। সে সময় ৬৫০টিরও বেশি বই জব্দ করা হয়। বইগুলো নিষিদ্ধ মতাদর্শ প্রচার করছে বলে অভিযোগ তোলে কর্তৃপক্ষ।
ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার ৭৩তম বছর উদযাপন করছে। ঠিক সেই সময় দিল্লির যানজটের ফাঁক গলে ছিন্নবস্ত্র শিশুদের দেখা যাচ্ছে। শিশুগুলো বেঢপ আকারের বিশালাকায় জাতীয় পতাকা আর ছোটখাটো স্মারক বিক্রি করছে। এসবের ওপর লেখা, মেরা ভারত মহান। অর্থাৎ আমার ভারত মহৎ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, এই মুহূর্তে ভারতকে মহান বা মহৎ মনে করা কঠিন। কারণ, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
গত সপ্তাহেই সরকার একতরফাভাবে বাতিল করল ১৯৪৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময় স্বাক্ষরিত ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনের মৌলিক শর্ত। এই ঘটনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল আগের দিন। ৪ আগস্ট রাতের অন্ধকারে। গোটা কাশ্মীরকে রূপ দেওয়া হয়েছিল এক বিশাল কারাগারের। সেখানকার সাড়ে ৭০ লাখ মানুষকে বাড়ির ভেতর আটকে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগ। আর ফোন লাইনও হয়ে যায় নিস্তব্ধ।
৫ আগস্ট ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার প্রস্তাব তোলেন। এই অনুচ্ছেদই ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার শর্তাবলির আইনি ভিত্তি। বিরোধী দলগুলো প্রায় কোনো প্রতিরোধই করল না। পরের দিন সন্ধ্যার মধ্যেই সংসদের দুই কক্ষ পেরিয়ে পাস হয়ে গেল জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন, ২০১৯।
এই আইনের মাধ্যমে বাতিল হলো জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা। এর বলে রাজ্যটির নিজস্ব সংবিধান, নিজস্ব পতাকার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হলো। শুধু তা-ই না, রাজ্যটিকে ভেঙে দেওয়া হলো দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। একদিকে জম্মু ও কাশ্মীর, যা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকবে, যদিও সেখানে নির্বাচিত বিধানসভা থাকবে, তবে তার ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হবে। অন্যদিকে লাদাখ, যা পুরোপুরি দিল্লি থেকেই শাসিত হবে। কোনো বিধানসভা থাকবে না।
সংসদে এই আইন পাস হওয়ার পর ঘটল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ঐতিহ্যবাহী টেবিল চাপড়াতে চাপড়াতে উল্লাস প্রকাশের দৃশ্য। বাতাসে যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল ঔপনিবেশিক গন্ধ। মনে হচ্ছিল, এক অবাধ্য উপনিবেশকে অবশেষে রাজমুকুটের আয়ত্তাধীন করা হলো। অবশ্যই এমনটি করা হলো অবাধ্য উপনিবেশের মঙ্গলার্থেই।
এখন ভারতীয় নাগরিকেরা সেখানে জমি কিনতে পারবেন। নতুন ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করতে পারবেন। এলাকাকে ঘোষণা করা হলো ওপেন ফর বিজনেস। ইতিমধ্যেই ভারতের শীর্ষ শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি বিভিন্ন 'ঘোষণা'য় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। লাদাখ ও কাশ্মীরের রয়েছে বিস্তীর্ণ হিমবাহ, উচ্চভূমির হ্রদ এবং পাঁচটি প্রধান নদী। কিন্তু এই ব্যবসাবান্ধব উন্মুক্তকরণ ভঙ্গুর হিমালয়ী পরিবেশের জন্য কতটা ধ্বংস ডেকে আনবে, তা কল্পনা করতে গেলেই ভয়ংকর মনে হয়।
জম্মু ও কাশ্মীরের আইনি সত্তা বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ দাঁড়াল ৩৫এ অনুচ্ছেদও বিলুপ্ত হওয়া। নিজেদের ভূমির রক্ষক হতে পারে, সেজন্য এই অনুচ্ছেদ রাজ্যের বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকার ও সুবিধা দিয়েছিল। সুতরাং, 'ওপেন ফর বিজনেস' মানে হতে পারে ইসরায়েলি ধাঁচের (ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে) বসতি স্থাপন কিংবা তিব্বতের মতো জনসংখ্যা স্থানান্তর।
কাশ্মীরিদের জন্য এটি কোনো নতুন ভয় নয়। এটি আসলে বহু পুরোনো, আদিম এক ভয়। তাদের বারবার ফিরে আসা দুঃস্বপ্ন হলো-ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আতঙ্কের বাণিজ্য করেছেন, তার এক উল্টো রূপ। সেই দুঃস্বপ্নে তারা দেখে, বিজয়োল্লাসে উন্মত্ত ভারতীয়দের এক বিরাট জলোচ্ছ্বাস তাদের উপত্যকার শান্ত-সবুজ অরণ্যময় প্রান্তরে ঢুকে পড়ছে, প্রত্যেকে চাইছে সেখানে নিজের জন্য একটুখানি ঘর বানাতে। এই দুঃস্বপ্ন খুব সহজেই বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
আইন পাস হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। মূলধারার গণমাধ্যম মাথা নুইয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল। শহরজুড়ে নাচানাচি শুরু হলো। আর ইন্টারনেটে দেখা গেল ভয়াবহ নারীবিদ্বেষ। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর, যিনি তার রাজ্যে নারী-পুরুষের অনুপাত ঠিক করার প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন, ঠাট্টা করে বললেন, 'আগে ধনখড়জি বলতেন বিহার থেকে বউ আনতে হবে...এখন সবাই বলছে, কাশ্মীরকে খুলে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে মেয়েদের তুলে আনা যাবে।'
কিন্তু এই অশ্লীল উল্লাসের মধ্যেই সবচেয়ে জোরালো শব্দ হয়ে বাজতে লাগল নীরবতা। কাশ্মীরের রাস্তাঘাটে কড়া টহল। ব্যারিকেড। আর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ, যাদের শিকলবন্দী করা হয়েছে কাঁটাতারের নিচে। নজরদারি ড্রোনের তলায়। সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কোনো সরকার এত সহজে পুরো এক জনগোষ্ঠীকে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগহীন করে ফেলতে পারে, এটা ভবিষ্যতের ভয়াবহ সংকেত বহন করছে।
প্রায়ই বলা হয়, কাশ্মীর হলো ভারত বিভাজনের 'অসমাপ্ত কাজ'। শব্দটা শুনলেই মনে হয়, ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা সেই কুখ্যাত অসাবধানী দাগ টেনে টেনে উপমহাদেশকে ভাগ করল, তখন যেন একটা পূর্ণাঙ্গ সত্তাকে ভেঙে টুকরা টুকরা করা হলো। কিন্তু সত্য হলো, ব্রিটিশ ভারতের বাইরে কোনো 'পূর্ণাঙ্গ সত্তা' আসলে ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে ছিল শত শত স্বাধীন দেশীয় রাজ্য, যেগুলো একে একে সিদ্ধান্ত নেয় ভারত কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। অনেকগুলো রাজ্যকে জোর করে যুক্ত করা হয়েছিল।
বিভাজন ও তার ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ এখনো উপমহাদেশের গভীর ক্ষত। তবে এই সহিংসতা শুধু বিভাজনের কারণে নয়, (ভারতে) সমানভাবে একীকরণের কারণেও ঘটেছে। ভারতে 'জাতি গঠন' নামক পতাকার তলায় একীকরণের মানে দাঁড়িয়েছে-১৯৪৭ সালের পর থেকে একটিও বছর এমন যায়নি, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশের ভেতরে নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে মোতায়েন হয়নি। তালিকাটা দীর্ঘ-কাশ্মীর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, হায়দরাবাদ, আসাম।
এই একীকরণের প্রক্রিয়া ছিল জটিল, বেদনাদায়ক ও প্রাণবিনাশী। কয়েক হাজার নয়, কয়েক লাখ মানুষের জীবন গেছে। আর আজও জম্মু ও কাশ্মীরের দুই প্রান্তে যা ঘটছে, তা আসলে সেই অসমাপ্ত একীকরণেরই ধারাবাহিকতা।
ভারতের সংসদে গত সপ্তাহে যা ঘটল, তা যেন ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। এই দলিলটির জন্মই ছিল জটিল প্রেক্ষাপটে। এতে স্বাক্ষর করেছিলেন এক জনপ্রিয়তাহীন এবং দুর্বল শাসক-ডোগরা হিন্দু রাজা মহারাজা হরি সিং। তার টলমলো রাজত্ব জম্মু ও কাশ্মীর ছিল নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা ফাটলের ওপর দাঁড়িয়ে।
১৯৪৫ সালেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আগুনকে আরও উসকে দিয়েছিল বিভাজনের সহিংসতা। পশ্চিমের পাহাড়ি জেলা পুঞ্চে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মহারাজার সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, হামলা করে হিন্দু বেসামরিক মানুষদের ওপরও। অন্যদিকে দক্ষিণে জম্মুতে মহারাজার বাহিনী, অন্য সামন্ত রাজ্য থেকে ধার করা সেনাদের নিয়ে, মুসলমানদের ওপর চালায় হত্যাযজ্ঞ। ইতিহাসবিদ ও সমসাময়িক সংবাদমাধ্যমের হিসেবে সেই সময়ে সত্তর হাজার থেকে দুই লাখ পর্যন্ত মানুষকে শুধু জম্মু শহর ও আশপাশের এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় হত্যা করা হয়েছিল।
জম্মুর হত্যাযজ্ঞের খবর পাকিস্তানে পৌঁছাতেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে 'অনিয়মিত বাহিনী' বা ছদ্মবেশী সেনারা পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। পথে পথে আগুন আর লুটপাট চালিয়ে তারা প্রবেশ করে কাশ্মীর উপত্যকায়। আতঙ্কিত মহারাজা হরি সিং পালিয়ে যান কাশ্মীর থেকে জম্মুতে, আর সেখান থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে সাহায্য চান। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে ঢোকানোর আইনি ভিত্তি ছিল সেই দলিল-ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন।
ভারতীয় সেনারা স্থানীয় কিছু মানুষের সহায়তায় পাকিস্তানি অনিয়মিত বাহিনীকে উপত্যকার প্রান্তের পাহাড়ি বলয় পর্যন্ত ঠেলে পাঠাতে সক্ষম হয়। ডোগরা রাজ্য তখন ভাগ হয়ে গেল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। শর্ত ছিল-ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন পরবর্তী সময়ে গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হবে। তাতে বোঝা যাবে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ কী চায়। সেই গণভোট আর কোনো দিন অনুষ্ঠিত হয়নি। আর সেখান থেকেই জন্ম নিল উপমহাদেশের সবচেয়ে জটিল ও বিপজ্জনক রাজনৈতিক সংকট।
তার পর থেকে বাহাত্তর বছর ধরে ভারতের একের পর এক সরকার এই দলিলের শর্তগুলোকে ক্ষয় করতে করতে শেষ পর্যন্ত কঙ্কালটুকুই রেখে দিল। আর এখন সেই কঙ্কালকেও নরকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
সব উত্থান-পতনের ইতিহাস একসঙ্গে বলার চেষ্টা করা হলে নেহাৎই গাধামি হবে। শুধু এটুকুই বলা যায়, ঘটনার জটিল আর বিপজ্জনক দিকগুলো ভিয়েতনামের থেকে কম নয়। যেখানে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুতুল সরকারগুলো নিয়ে খেলেছিল।
অনেক বছরের নির্বাচনী কারচুপির ইতিহাসে বড় মোড় পরিবর্তন ঘটে ১৯৮৭ সালে, যখন দিল্লি প্রকাশ্যেই রাজ্যের নির্বাচন জালিয়াতি করে। দুই বছরের মধ্যে, ১৯৮৯ সালে, তখন পর্যন্ত প্রধানত অহিংস আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি রূপ নেয় পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, আর তাদের বারবার গণহত্যা চালিয়ে নিকেশ করে ফেলা হয়।
অচিরেই কাশ্মীর উপত্যকা ভরে ওঠে সশস্ত্র বিদ্রোহীতে। এদের মধ্যে ছিল দুই প্রান্তের কাশ্মীরি যুবক এবং পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র বিদেশি যোদ্ধারা। অধিকাংশ কাশ্মীরি জনগণ তাদের স্বাগত জানায়। কিন্তু আবারও কাশ্মীর জড়িয়ে পড়ল উপমহাদেশের বাতাসে বইতে থাকা রাজনৈতিক ঝড়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা ক্রমে কট্টর হয়ে ওঠা ইসলাম, যা কাশ্মীরি সংস্কৃতির কাছে ছিল বহিরাগত। অন্যদিকে ভারতের ভেতরে বাড়তে থাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদ।
এই বিদ্রোহের প্রথম শিকার হলো কাশ্মীরি মুসলমান আর স্থানীয়ভাবে পণ্ডিত নামে পরিচিত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যকার শতাব্দীপ্রাচীন সহাবস্থান। সহিংসতা শুরু হলে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংগঠন কাশ্মীরি পণ্ডিত সংরক্ষা সমিতি বা কেপিএসএসের হিসাব অনুযায়ী, সশস্ত্র যোদ্ধাদের হাতে প্রায় চার শ পণ্ডিত নিহত হয়। ১৯৯০ সালের শেষ নাগাদ সরকারি অনুমান অনুযায়ী ২৫ হাজার পণ্ডিত পরিবার উপত্যকা ছেড়ে চলে যায়। তারা হারায় ঘরবাড়ি। ভিটেমাটি। মাতৃভূমি। সবকিছুই। কয়েক বছরের মধ্যে আরও হাজার হাজার পরিবার চলে যায়। উপত্যকা থেকে প্রায় পুরো পণ্ডিত জনসংখ্যাই বিলীন হয়ে যায়।
কেপিএসএসের হিসাব অনুযায়ী, সংঘাত চলাকালে আরও ৬৫০ জন পণ্ডিত নিহত হয়েছে, পাশাপাশি নিহত হয়েছে হাজার হাজার মুসলমান।
তার পর থেকে বিপুলসংখ্যক পণ্ডিত জম্মু শহরে দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীশিবিরে জীবন কাটাচ্ছে। তিন দশক কেটে গেছে, কিন্তু দিল্লির কোনো সরকারই তাদের ঘরে ফেরাতে চেষ্টা করেনি। বরং তাদের অনিশ্চয়তায় জিইয়ে রেখে ক্ষোভ ও দুঃখকে কাজে লাগিয়ে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদী বয়ানকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির শুধু একটি অংশকে কৌশলে সামনে আনা হয়েছে। আর বাদবাকি ভয়াবহতাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।
আজ কাশ্মীর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি, অথবা বলা যায় সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ সামরিক অঞ্চলগুলোর একটি। পাঁচ লাখের বেশি ভারতীয় সেনা মোতায়েন রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বীকারোক্তি, সৈন্যদের কাজ এখন কেবল হাতে গোনা কয়েকজন 'সন্ত্রাসবাদী'র মোকাবিলা করা। আগে যা-ও সন্দেহের ছিটেফোঁটা ছিল, এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বাস্তবে ভারতীয় বাহিনীর শত্রু হলো কাশ্মীরি জনগণ। গত ৩০ বছরে কাশ্মীরে ভারত যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। অনুমান করা হয়, প্রায় ৭০ হাজার সাধারণ মানুষ, গেরিলা ও নিরাপত্তাকর্মী সংঘাতে নিহত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ 'গুম' হয়েছে। আর কয়েক হাজারকে যেতে হয়েছে নির্যাতনকেন্দ্রের ভেতর দিয়ে। গোটা উপত্যকায় আবু গারিব কারাগারের আদলে ছোট ছোট গারদখানা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের নতুন অস্ত্র, পেলেটগান বা ছররা বন্দুক দিয়ে গত কয়েক বছরে শত শত কাশ্মীরি কিশোরকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজ যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে, তারা মূলত কাশ্মীরি তরুণ, স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত। তারা জানে, একবার বন্দুক হাতে নিলে তাদের আয়ু ছয় মাসের বেশি নয়। তবু প্রতিবার একজন 'সন্ত্রাসবাদী' নিহত হলে হাজার হাজার কাশ্মীরি জড়ো হয় তাঁকে শহীদ হিসেবে দাফন করতে।
এগুলো ৩০ বছরের ভারতীয় সামরিক দখলের শুধু মোটামুটি রেখাচিত্র। এর সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রভাবগুলো এর থেকে সংক্ষিপ্তভাবে বলা সম্ভব নয়।
নরেন্দ্র মোদির প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় তার কঠোর নীতি কাশ্মীরের সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক কাশ্মীরি আত্মঘাতী হামলায় ৪০ ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মী নিহত হলে ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান পাল্টা আঘাত হানে। এভাবে ইতিহাসে প্রথমবার দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাল। আর নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র দুই মাস পেরোতেই তার সরকার খেলল সবচেয়ে বিপজ্জনক তাস-বারুদের স্তূপে ছুড়ে দিল জ্বলন্ত দেশলাই।
তবুও এখানেই শেষ নয়। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো যেভাবে প্রতারণামূলক কৌশলে কাজটি করা হলো। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে হঠাৎই কাশ্মীরে পাঠানো হলো আরও ৪৫ হাজার অতিরিক্ত সেনা। নানা অজুহাত দেখানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো অজুহাত ছিল-অমরনাথ যাত্রায় পাকিস্তানি 'সন্ত্রাসী' হামলার আশঙ্কা। এই বার্ষিক তীর্থযাত্রায় কয়েক লাখ হিন্দু ভক্ত কাশ্মীরি বাহকদের কাঁধে ভর করে বা পায়ে হেঁটে দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছে যান অমরনাথ গুহায়, যেখানে তারা প্রাকৃতিক বরফের লিঙ্গকে শিবের অবতার বলে পূজা করেন।
১ আগস্ট, কিছু ভারতীয় টিভি নেটওয়ার্ক ঘোষণা করল যে অমরনাথ যাত্রার পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চিহ্নসংবলিত একটি স্থলমাইন পাওয়া গেছে। ২ আগস্ট সরকার নির্দেশ দিল, সব তীর্থযাত্রী (এমনকি যারা যাত্রাপথ থেকে বহু মাইল দূরে থাকা পর্যটকও) যেন অবিলম্বে উপত্যকা ছেড়ে চলে যায়। শুরু হলো আতঙ্কের মধ্য দিয়ে প্রত্যাবর্তন। উপত্যকায় থাকা প্রায় দুই লাখ ভারতীয় অভিবাসী দিনমজুরের ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ দেখা গেল না কর্তৃপক্ষের। সম্ভবত তারা অতটা 'গুরুত্বপূর্ণ' নয় বলেই। ৩ আগস্ট শনিবার নাগাদ সব পর্যটক ও তীর্থযাত্রী চলে গেলেন, আর ভারতীয় সেনারা অবস্থান নিল উপত্যকার সর্বত্র।
রোববার রাতের মধ্যেই কাশ্মীরিরা বন্দী হলো নিজেদের ঘরে। সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হলো। পরদিন সকালে জানা গেল, শত শত লোকের সঙ্গে তিন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী-ফারুক আবদুল্লাহ, তার ছেলে ওমর আবদুল্লাহ (ন্যাশনাল কনফারেন্স) এবং মহবুবা মুফতি (পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি) গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা হলেন সেই মূলধারার ভারতপন্থী রাজনীতিক, যারা বছরের পর বছর দিল্লির হয়ে কাজ করে এসেছেন।
খবর এল, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশকেও নিরস্ত্র করা হয়েছে। অথচ এত বছর ধরে এই স্থানীয় পুলিশরাই প্রথম সারিতে থেকে ভারতের হয়ে কাজ করেছে। গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। দমননীতির অমানবিক আদেশ পালন করেছে; ফলে একদিকে ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্ট করেছে, অন্যদিকে নিজের জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে। ভারতের পতাকা উপত্যকায় উড়িয়ে রাখার জন্য তারা করেছে অক্লান্ত পরিশ্রম। আর এখন, যখন পরিস্থিতি বিস্ফোরক, তাদেরই কামানের খোরাক বানানো হচ্ছে। তাদেরই ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে ক্ষুব্ধ জনতার মুখে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের মিত্রদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রকাশ্য অপমানের কাজটি করেছে এক ধরনের দাম্ভিকতা ও অজ্ঞতা থেকে। এই দাম্ভিকতা ও অজ্ঞতা ধ্বংস করেছে ভারতীয় রাষ্ট্রকৌশলের চতুর, জটিল এবং বহু দশকের শ্রমে গড়ে তোলা সূক্ষ্ম কাঠামোকে। এখন সবকিছু এসে ঠেকেছে রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষ বনাম সৈন্যের মুখোমুখি সংঘর্ষে। রাস্তার তরুণ কাশ্মীরিদের ওপর এর যে প্রভাব পড়ছে, তা এক বিষয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যদের এমন পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া, এটিও একেবারেই অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক ও ভয়াবহ। (এই পরিস্থিতি শুধু কাশ্মীরিদের জন্যই বিপর্যয়কর নয়, ভারতীয় সৈন্যদের জন্যও ভয়ংকর অন্যায়। রাষ্ট্র কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা হারিয়ে তাদের এক অসম্ভব সংঘাতের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।)
কাশ্মীরি জনগণের যে অংশগুলো বেশি উগ্রপন্থী, যারা স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার দাবি করে আসছে, তারা ভারতের আইন বা সংবিধানের তোয়াক্কা করে না।
তাদের কাছে যাদের সহযোগী বা 'দালাল' মনে হয়েছে, তারা এখন বিশ্বাসঘাতকতার শিকার; এতে তারা অবশ্যই খুশি হবে এবং ভাববে যে ভাঁওতা আর ছলনাবাজি অবশেষে নিকেশ হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের এখনই আনন্দ করার সময় হয়নি। কারণ, যেমন ডিম সব সময় ডিমই থাকে, মাছ সব সময় মাছই থাকে, তেমনি আবারও নতুন ভাঁওতাবাজি আসবে, নতুন ছলনার খেলা আসবে। আসবে নতুন রাজনৈতিক দল। আর আসবে এক নতুন খেলা।
৮ আগস্ট, লকডাউনের চতুর্থ দিন, নরেন্দ্র মোদি টিভিতে হাজির হলেন। এক উদযাপনে মাতোয়ারা ভারত আর কারাগারে আবদ্ধ কাশ্মীর-এই দুই প্রান্তের উদ্দেশে তিনি ভাষণ দিলেন। তার কণ্ঠে ছিল এক অচেনা কোমলতা, যেন এক নবযুবতী মা সন্তানের সঙ্গে কথা বলছে। সেটাই ছিল তার সবচেয়ে শীতল রূপ।
কণ্ঠ কাঁপছিল, চোখে জমা ছিল অশ্রু-তিনি তালিকা দিতে লাগলেন কত কী উপকার বর্ষিত হবে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের ওপর, যেহেতু এখন তারা মুক্ত দুর্নীতিগ্রস্ত পুরোনো নেতাদের হাত থেকে এবং সরাসরি দিল্লি শাসন করবে তাদের। আধুনিক ভারতের আশ্চর্য সব কীর্তি তিনি গুনে গুনে শোনালেন, যেন কয়েক শতাব্দীর পুরোনো ক্রীতদাস কৃষকদের নতুন সভ্যতার সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন। বললেন, আবারও বলিউড চলচ্চিত্র শুটিং হবে উপত্যকার সবুজ প্রান্তরে।
তিনি ব্যাখ্যা করলেন না, কেন কাশ্মীরিদের গৃহবন্দী করে, যোগাযোগ বন্ধ করে তার এই আবেগঘন ভাষণ দিতে হলো। বোঝালেন না, যে সিদ্ধান্ত নাকি কাশ্মীরিদের জন্য এত কল্যাণকর, তা কেন একবারও তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে নেওয়া হলো। বলেননি, সামরিক দখলের নিচে চাপা পড়া মানুষ কীভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই মহান উপহার ভোগ করবে। শুধু ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন আগেভাগেই। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিলেন না যে উৎসব উপলক্ষে লকডাউন শিথিল করা হবে। আর তা হয়ওনি।
পরদিন ভারতীয় সংবাদপত্র ও বহু উদারপন্থী বিশ্লেষক, এমনকি মোদির কড়া সমালোচকেরাও তার বক্তৃতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো। যেন প্রকৃত ঔপনিবেশিক মানসিকতা। নিজেদের অধিকারের জন্য এত সতর্ক। অথচ কাশ্মীরিদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানদণ্ড।
১৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে, লালকেল্লার প্রাচীর থেকে মোদি গর্ব করে ঘোষণা করলেন যে তার সরকার অবশেষে 'এক দেশ, এক সংবিধান'-এর স্বপ্ন পূর্ণ করেছে। অথচ আগের সন্ধ্যাতেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি অশান্ত রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠন, যেগুলোরও কাশ্মীরের মতো বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিল। যখন লালকেল্লায় উল্লাস চলছিল, তখন উপত্যকায় ৭০ লাখ কাশ্মীরি রয়ে গেল বন্দী। শোনা যাচ্ছে, যোগাযোগ অবরোধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
একদিন না একদিন এই অবরোধ ভাঙবেই। কিন্তু তখন যে সহিংসতার বিস্ফোরণ হবে, তা ছড়িয়ে পড়বে সারা ভারতে। আর তা ব্যবহার করা হবে ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরও ঘৃণা উসকে দেওয়ার কাজে। মুসলমানদের আগেই করা হচ্ছে অপমানিত, বঞ্চিত, গরিব। আর নিয়মিত ভয়াবহভাবে গণপিটুনির শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। রাষ্ট্র সেই সুযোগে আরও আক্রমণ করবে তাদের ওপর; সক্রিয়বাদী বা অ্যাক্টিভিস্ট, আইনজীবী, শিল্পী, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক-যারা সাহস করে প্রতিবাদ করেছে।
হুমকি আসবে নানা দিক থেকে। ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন-উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, সংক্ষেপে আরএসএস। আরএসএসের সদস্যসংখ্যা মোদি ও তার বহু মন্ত্রীসহ ছয় লাখের বেশি। আরএসএসের রয়েছে মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্টদের অনুসরণে গড়া প্রশিক্ষিত 'স্বেচ্ছাসেবক' মিলিশিয়া। দিনে দিনে আরএসএস ভারতের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আরও শক্তভাবে দখল আঁটছে। সত্যি বলতে, এখন তারা মোটামুটি রাষ্ট্রের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই রাষ্ট্রের 'সদয় ছায়া'য় দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উগ্র হিন্দু সংগঠন। হিন্দু রাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী বা স্ট্রম ট্রুপারস। এই বাহিনী প্রাণঘাতী কাজগুলো নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য এখন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ। মে মাসে, বিজেপি নির্বাচনে জেতার পরদিন সকালে, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং আরএসএসের সাবেক মুখপাত্র রাম মাধব লিখলেন, 'ভুয়া ধর্মনিরপেক্ষ, উদারপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অবশিষ্টাংশ, যারা এত দিন ভারতের নীতি ও প্রজ্ঞাভিত্তিক কাঠামোর ওপর অযথা প্রভাব বিস্তার করেছে, তাদের অবশ্যই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও প্রজ্ঞাভিত্তিক কাঠামোর পরিমণ্ডল থেকে সরিয়ে দিতে হবে।'
১ আগস্ট, 'শুদ্ধিকরণ'-এর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন নামে পরিচিত কালাকানুনের সংশোধন করা হলো। সংশোধনী আইনে সরকারকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যদি চায় তবে যেকোনো ব্যক্তিকে 'সন্ত্রাসী' ঘোষণা করতে পারবে। এর জন্য প্রাথমিক তদন্ত বা এফআইআর, অভিযোগপত্র, বিচার বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মতো আইনি প্রক্রিয়া মানা লাগবে না।
কোন ধরনের মানুষকে এই আইনের লক্ষ্যবস্তু করা হবে, তা পরিষ্কার করে দিলেন ভারতের শীতলস্বভাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন:
'মাননীয় স্পিকার, বন্দুক সন্ত্রাসের জন্ম দেয় না। এর মূল শিকড় হলো সেসব প্রচারণা, যা সন্ত্রাস ছড়াতে ব্যবহৃত হয়। ...আর যদি এ ধরনের ব্যক্তিদের সবাইকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবে আমার মনে হয়, সংসদের কোনো সদস্যেরই আপত্তি থাকা উচিত নয়।'
আমাদের কয়েকজনের মনে হলো, সংসদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার শীতল দৃষ্টি যেন সোজা আমাদের ভেদ করে তাকিয়ে আছে। এতে কোনো সান্ত্বনা মেলে না, নিজ রাজ্য গুজরাটে একাধিক হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে তিনি একসময় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেই মামলার বিচারক বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিশন লোয়া রহস্যজনকভাবে বিচার চলাকালীন মারা যান। পরে আরেকজন বিচারক দায়িত্ব নেন। তিনি দ্রুত অমিত শাহকে খালাস দেন।
এসব ঘটনার পর যেন সাহস আরও বেড়ে যায় ভারতের শত শত ডানপন্থী টেলিভিশন সঞ্চালকের। তারা এখন প্রকাশ্যে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছুড়ছে, গ্রেপ্তার বা তার থেকেও ভয়াবহ শাস্তির দাবি তুলছে। আজকের ভারতে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা হয়ে উঠছে, 'টেলিভিশনে লিঞ্চিং' বা টেলিভিশনের গণপিটুনি।
বিশ্ব যখন তাকিয়ে আছে, ঠিক তখনই দ্রুত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের স্থাপত্য।
আমি ২৮ জুলাই কাশ্মীরে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে উড়াল দেওয়ার টিকিট কেটেছিলাম। তখনই গুঞ্জন উঠেছিল, কোনো বড় ধরনের গোলযোগ ঘটবে। প্রচুর সেনা বিমানযোগে নামানো হচ্ছে। যাব কি যাব না-এই দোটানায় ছিলাম। সেই সময় আমার এক বন্ধু, সরকারি হাসপাতালের এক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আজীবন তিনি জনসেবায় নিবেদিত থেকেছেন, তবে তিনি মুসলমান। আমরা আলাপ শুরু করলাম ভারতের নতুন এক আতঙ্কের কথা নিয়ে-রাস্তার দাঙ্গাবাজ ভিড় মানুষকে ঘিরে ধরছে, বিশেষত মুসলমানদের, আর বাধ্য করছে তাদের মুখে স্লোগান তুলতে: 'জয় শ্রী রাম!'
কাশ্মীরকে যদি নিরাপত্তা বাহিনী দখল করে রাখে, তবে ভারত দখল হয়ে আছে 'মব' বা উন্মত্ত জনতার হাতে।
আমার সেই চিকিৎসক বন্ধু বললেন, তিনি এ নিয়েও ভেবেছেন। কারণ, প্রায়ই তাকে দিল্লির বাইরে হাইওয়ে ধরে কয়েক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পরিবারে কাছে যেতে হয়।
তিনি শান্তভাবে বললেন, 'আমাকে যেকোনো সময় থামিয়ে দেওয়া হতে পারে।'
আমি বললাম, 'তাহলে অবশ্যই জয় শ্রী রাম বলতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে।'
তিনি বললেন, 'বলব না। কারণ, তারা যেভাবেই হোক মেরে ফেলবে। যেমনটা করেছিল তবরেজ আনসারির (২০১৯ সালে ঝাড়খণ্ডে উন্মত্ত হিন্দু জনতার গণপিটুনিতে নিহত ২২ বছরের যুবক। আনসারিকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডে বিগত তিন বছরে ১৮ মুসলমান গণপিটুনতে নিহত হয়েছেন) সঙ্গে।'
এমনই আলাপচারিতা হচ্ছে আজকের ভারতে-আমরা অপেক্ষা করছি কাশ্মীর কবে কথা বলবে। আর কাশ্মীর কথা বলবেই।
(অরুন্ধতী রায়ের 'আজাদী' থেকে অনুবাদ, প্রথম প্রকাশ: নিউ ইয়র্ক টাইমস, আগস্ট ১৫, ২০১৯)