যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়া নতুন রপ্তানি বাজার হিসেবে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দিকে নজর দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ইও হান-কু।
কোরিয়া ইকোনমিক ডেইলিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হান-কু বলেন, "আমরা গ্লোবাল সাউথের বাজারের মধ্যে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াকে বেছে নিয়েছি। এ অঞ্চলে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বাস করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। বিশাল ভোক্তা বাজার হিসেবে এর প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক।"
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য আলোচনা এগিয়ে নেওয়া হবে।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াকে শুধু ভোক্তা বাজার নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ সরবরাহ শৃঙ্খল জোরদারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ অঞ্চলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপকে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশে বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ) নিয়ে প্রথম দফার আলোচনা শুরু হয়েছে আগস্ট মাসে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো শুধু শুল্ক নয়, বরং বিনিয়োগ, সেবাখাত, মেধাস্বত্ব এবং নিয়ন্ত্রণমূলক বিষয়েও দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করা।
১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল রাষ্ট্র এবং পোশাক উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র।
হান-কু বলেন, "প্রচুর শ্রমশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে গড়ে ৬-৭ শতাংশ হারে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।"
বর্তমানে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার শতাধিক কোম্পানি উৎপাদন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এদের মধ্যে ইয়ংওয়ান করপোরেশন সবচেয়ে বড়। প্রতিষ্ঠানটি দ্য নর্থ ফেস ও নাইকির মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য 'অরিজিনাল ডিজাইন ম্যানুফ্যাকচারার' (মূল নকশা অনুযায়ী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) হিসেবে কাজ করে।
২০২৪ সালে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশ এখনও সিউলের বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে ৫৪তম স্থানে রয়েছে।
এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯০ শতাংশই আসে বাণিজ্য থেকে। তাই রপ্তানির বাজার বহুমুখীকরণ এখন তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত কোরীয় রপ্তানিকারকরা নতুন সম্ভাবনা খুঁজছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি দুই দেশের বাণিজ্য বাড়াবে বলে আশা করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী হান-কু।
তিনি জানান, ২০১০ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে, আর কোরিয়ার বিনিয়োগ প্রায় চারগুণ বেড়েছে।
হান-কু আরও বলেন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হবে। কারণ আসিয়ান (আসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশন্স) এখন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে উঠে আসছে।
চলতি বছরের আগস্টে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে কোরিয়ার রপ্তানি দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এটি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায় এবং চীনে রপ্তানি হওয়া ১১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে।
আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো হলো—ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
অনেক উন্নয়নশীল দেশ সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রনিকস, বৈদ্যুতিক পণ্য ও অটোমোবাইল শিল্পে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চাইছে। এ প্রেক্ষাপটে সিউল 'উইন-উইন' (লাভের বিনিময়ে লাভ) কৌশলের ভিত্তিতে বাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যাবে।
ইয়ো বলেন, "আমরা গ্লোবাল সাউথের অন্যান্য দেশ—মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষভাবে প্রস্তুত বাণিজ্য চুক্তি করব।"