বিড়াল: বন্ধুত্ব

'আমার জীবনে বন্ধু বলতে ছিলই মাত্র দুইজন–একজন শিশু, আরেকজন পশু। শিশু বড় হইছে, পশু মারা গেছে। এখন আমার আছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি আর স্মৃতি তুমি বেদনা!'
বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে মজা করে দেয়া স্ট্যাটাস। এখন পিছন ফিরে দেখলে মনে হয় ঘটনা সত্যি। শিশু ছিল আমার বোনের ছোট মেয়ে রোকেয়া, এখন সে বালিকা, আমারে পাত্তা দেয় না, তার নিত্যনতুন খেলার সাথি আর রোবলোক্স আছে। আর পশু ছিল আমার একমাত্র বিড়াল, যে মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও 'মিস্টার প্রেসিডেন্ট' বা 'বিল ক্লিনটন' নাম তাকে ধারণ করতে হয়েছিল। এই নামের ইতিহাস বয়ানে কিছুক্ষণ পর আসি, তার আগে সে প্রশ্নটা বেশ কিছুদিন ধরে আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাকে নিয়ে ধ্যানমগ্ন হই–সখী, বন্ধুত্ব কারে কয়?
বন্ধু শব্দ শুনলেই হিন্দি বাংলা ইংলিশ মিলায়ে একগাদা গানের লাইন মনে আসে। সে গানগুলিতে বন্ধুত্বের ছায়া থাকলেও শব্দটা এতটাই ভার্সাটাইল যে তাকে ইলাস্টিকের মতন টানতে টানতে সারা দুনিয়া প্যাঁচানো যাবে– পার্থিব-অপার্থিব সমস্ত সম্পর্কই এই আড়াই অক্ষরের পরিসরে এঁটে যায়। একজনের নজর থেকে তারে দেখতে গেলে অন্ধের হাতি দেখার মতন ঘটনা ঘটবে। তবে যে গানটা আমার অবচেতনে লালিত বন্ধুত্বের ধারণার সাথে মিলে যায়, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা–
'বন্ধু রহো রহো সাথে, আজি এ সঘন শ্রাবণ প্রাতে
ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে...'
এমন বন্ধু আমার আর কে আছে বা ছিল? যে সাথিহারা রাতে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে, সঘন শ্রাবণ প্রাতে সাথে থেকেছে? একমাত্র আমার বিড়াল ছাড়া কারও কথাই মনে পড়ে না। অথচ বিড়ালের একই অঙ্গে কত যে রূপের আরোপ করেছি আমরা! সেই প্রাচীনকাল থেকে কেউ তারে ডাকিনী যোগীনির সাধন সঙ্গী হিসাবে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়েছে; আবার মিসরের দেবী বাস্তেতের সঙ্গী হিসাবে সে পূজাও তো কম পায় নাই। বিড়ালের প্রতি ভালোবাসার কারণে আমাদের নবী আদর করে তাঁর এক সাহাবির নাম দিয়েছিলেন আবু হুরায়রা। অবশ্য বাংলায় বিভিন্ন বাগধারা যেমন 'বাসর রাতেই বিড়াল মারা' অথবা 'থলের বিড়াল বের হয়ে আসা', 'বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা' ইত্যাদি থেকে অনুমান করি, বিড়ালের প্রতি বাঙালির প্রেম খুব গভীর ছিল না।
নিজের বিষয়ে বলতে হয়–দুনিয়ার যেকোনো কিছুর জন্যই আমার মায়া লাগে, তবে মানবজাতি ছাড়া বিড়াল, কুকুর অথবা যা কিছুই নড়েচড়ে এবং নিশ্বাস নেয়, তাদের প্রতি মায়াটা 'দূর থেকে ভালোবেসে যাই' ধরনের; কারণ, কাছে যেতে ভয় লাগে! আমার বিড়ালভীতি মোটামুটি কিংবদন্তি পর্যায়ে ছিল আমাদের বাড়িতে।
আমি যখন কোফিল্ড রেসকোর্সের কাছে দোতলার একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতাম, তখনকার একটা ঘটনা বলি। আমার বাসাটা ছিল এক কোণে, বের হলেই নিচে নামার সিঁড়ি, আর টানা বারান্দা চলে গেছে অন্য ফ্ল্যাটগুলির সামনে দিয়ে। বারান্দার ওই প্রান্তে আরেকটা সিঁড়ি। আমার ঠিক নিচের ফ্ল্যাটে এক যুগল থাকত প্রায় গার্ফিল্ডের মতো দেখতে তাদের কমলা রঙের বিড়াল নিয়ে। আমি দূর থেকে মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই বিড়ালের কাজকর্ম দেখলেও কখনোই কাছে যাওয়ার সাহস পেতাম না এবং ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চারপাশে দেখে নিতাম সে আশেপাশে আছে কি না। যদি দেখতাম আমার সিঁড়ির কাছাকাছি কোথাও সে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিষয়ে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন, আমি পা টিপে টিপে অন্য দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামতাম।

এক দুপুরবেলা এ রকমই দরজা থেকে মাথা বাড়িয়ে দেখলাম জগৎ সুনসান, কোথাও কেউ নেই। মনে মনে আল্লাহকে থ্যাঙ্কিউ দিয়ে যেই না কয়েক ধাপ নেমেছি, দেখি মহামান্য গার্ফিল্ড হেলতে দুলতে উপরে উঠে আসতেছে! আমি প্রাণপণে তারস্বরে যে চিল্লানটা দিলাম, বিড়ালের কানে বোধ হয় তা ইস্রাফিলের শিঙ্গার মতোই তীব্র হয়ে বেজে থাকবে, সে কয়েক সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বাতাসের বেগে দৌড়ে পালাল, আমি শুধু একপলক দেখলাম একটা কমলা ভাসমানতা। এরপর যত দিন ওই বাড়িতে ছিলাম, গার্ফিল্ড আমাকে দেখলেই পালাত।
সেই আমি এমন এক মানুষের প্রেমে পড়লাম, যে নিজেই নিজেকে ডাকত হুলোবিড়াল এবং দশ মাইল দূরে বিড়াল দেখলেও দুই হাত বাড়িয়ে ছুটে যেত। আমরা সংসার পাতলাম অকল্যান্ড শহরে। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে প্রথম যে নিজেদের বাড়িতে আমরা উঠলাম, তা ছিল একই ব্লকে পাঁচটা ছোট ছোট দুই রুমের ইউনিটের মধ্যে সবচেয়ে শেষেরটা। একদম শেষের বাড়িটা আমাদের; আর সে কারণেই বাগানের অংশ অন্যান্য বাড়ি থেকে কিছুটা বড়।
রাস্তা থেকে আমাদের ব্লকে ঢুকে আরও চারটা বাড়ি পার হয়ে আমাদের বাসা। একটা কাঠের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে সামনে ইট বিছানো উঠান, তারপরেই বসার ঘরে ঢোকার কাচের স্লাইডিং দরজা। মনে আছে বাইরের কাঠের দরজা লাগানো থাকত একটা জং ধরা ছিটকিনি দিয়ে। বাকি চার বাড়ির সবগুলিতেই অন্তত একটা করে বিড়াল ছিল। তারা মাঝে মাঝেই নিজেদের বাড়ির বেড়ায় বসে থাকত, অথবা ঘাসের উপরে শুয়ে থাকত। আমি প্রতিদিন অফিসফেরত মনে মনে সুরা পড়তে পড়তে ওই অংশটুকু পার হতাম।
আদিব প্রতিটা বিড়ালের একটা করে নাম দিয়েছিল–পাইরেট, মহারাজা, ঘুটুম ইত্যাদি। তখন নতুন দেশে নতুন শহরে জীবন শুরু করেছি। আমি চাকরি করতাম একটা ব্যাংকে। আর আদিব একটা পেট্রলপাম্পের গ্রেভইয়ার্ড শিফট, মানে কবরস্থান পাহারা দেয়ার মতো সারা রাত দোকান পাহারা। আমি বিকালে কাজ থেকে ফেরার পর আমাদের দেখা হতো দুই-তিন ঘণ্টার মতো, তারপর সে চলে যেত তার কাজে, ফিরত সকালবেলায় আমি অফিস রওনা দেয়ার আগে আগে। এই কয়েক ঘণ্টায় সে আমাকে বিড়ালবিষয়ক বিভিন্ন আপডেট পেশ করত, মনের মাধুরী মেশানো সব গল্প শোনাত বিড়ালের সংসার নিয়ে।

একদিন বলল, জানিস, পাশের বাসায় একটা বাঘের সাইজের কালো বিড়াল নিয়ে আসছে। ওইটার নাম আমি দিছি বেহেমথ! – সে আবার কে?
–আরে তুমি দেখি পুরাই অশিক্ষিত! মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা পড়ো নাই? ঐ যে দুই পায়ে মানুষের মতো হাঁটে বিলাই আর পিস্তল নিয়ে ঘোরাফিরা করে, ভাবতেছি বেহেমথ রে বডিগার্ড রেখে দিব, এমনিতেই গ্রেভইয়ার্ড শিফট করি!
কখনো শোনাত কোন শহরের এক বিড়াল নাকি বাসে চড়ে মাছের দোকানে যায়। বিড়ালের নাম অস্কার।
আমি বিশ্বাস না করলে সে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখাত আমাকে। তখন আমরা আলাপ করতাম বাস ড্রাইভার, মাছ ওয়ালা আর বিড়ালের বোঝাপড়া নিয়ে। কারও কিছু বলতে হয় না, ভাষার দরকার হয় না। ড্রাইভার ঠিকই বুঝে নেয় বিড়াল কোথায় যেতে চায়, বিড়াল জানে এখানে তার কোনো ক্ষতি হবে না, মাছওয়ালা তার সাধ্যমতো আপ্যায়ন করে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করতাম–আহা দুনিয়াটা যদি এ রকমই হইত!
ছুটির দিনে আমরা বসার ঘরে বসলে প্রায়ই সে এসে কাচের দরজার সামনে দাঁড়ায় পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে আর সামনের দুই পা দরজার কাচের উপরে মানুষের হাতের মতো বিছানো, মুখের ভাবে করুণ আর্তি; আদিব বলে, 'বিড়াল রাজ্যের অলিভার টুইস্টের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম!'
এ রকমই একদিন জং ধরা ছিটকিনি টেনেটুনে কোনোরকমে নামিয়ে কাঠের দরজা খুলে উঠানে পা ফেলেই দেখি একটা ট্যাবি টরটয়েজশেল উঠানের ঠিক মাঝখানে সোজা হয়ে লেজ গুছিয়ে ঠিক ছবিতে আঁকা বিড়ালের মতো বসে আছে। ঘরের স্লাইডিং দরজা খোলা, সেখানে সোফা বেডের উপরে শুয়ে শুয়ে আদিব বিড়ালের সাথে দার্শনিক আলাপ করতেছে। আমার তো বিড়াল দেখে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। চিল্লানোর জন্য মুখ হাঁ করলেও বাতাস ছাড়া কিছুই বের হলো না। তবু আল্লাহ বাঁচাইছে–বিড়াল আদিবের দিকে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে রাখছিল। আমার অবস্থা দেখে আদিব হাসতে হাসতে এসে বিড়ালকে কোলে তুলে নিল আর আমি কোনোরকমে ঘরে ঢুকে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঢক ঢক করে পানি খেলাম।
তারপর থেকে রোজকার ঘটনা হয়ে গেল এটা। আমি প্রতিদিন বাস থেকে নেমে আল্লাহর কাছে মিনতি করতে করতে আসি, যাতে বিড়ালটা না থাকে, আর রোজ এসে দেখি সে দরজার সামনে বসে আছে। আদিব আবার এর মধ্যে ক্যাট ফুড কিনে নিয়ে এসে রীতিমতো মেহমানদারি শুরু করে দিছে। আমি তাকে বললাম, এই বিড়ালকে খাওয়ানো যাবে না, আমি ভয় পাই। উত্তরে সে বলল, 'বিড়ালের তো তোমারে নিয়ে প্রবলেম নাই, সে তো তোমাকে মেনে নিছে, তুমিও তাকে মেনে নাও!'
ছুটির দিনে আমরা বসার ঘরে বসলে প্রায়ই সে এসে কাচের দরজার সামনে দাঁড়ায় পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে আর সামনের দুই পা দরজার কাচের উপরে মানুষের হাতের মতো বিছানো, মুখের ভাবে করুণ আর্তি; আদিব বলে, 'বিড়াল রাজ্যের অলিভার টুইস্টের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম!' কাচের উপরে বিছানো তার সামনের পা পিছলায়ে পিছলায়ে যায়, সে আবার ব্যালান্স ঠিক করে দাঁড়ায়, এর ভেতর একবারও আমাদের মুখ থেকে দৃষ্টি সরায় না। আমি বলি, 'একটু খাবার দাও না বেচারাকে!'

আমরা বলাবলি করি যে বিড়ালটাকে কেউ নিশ্চয়ই পালত, তারপর ছেড়ে গেছে; কারণ, তার ভিতর ভদ্রতার কোনো অভাব ছিল না।
একদিন শেষ বিকালের আলো এসে পড়ছে রাতাগাছের পাতায়। আদিব চলে গেছে কাজে। বিড়াল এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, সেই ক্লান্ত করুণ চেহারা, বিকালের নরম আলো তার গায়ে চিকচক করতেছে, চোখ কেমন ছলছল, আমার মন মুচড়ায়ে উঠল তাকে দেখে। জানি সে ক্ষুধার্ত, কিন্তু আমি কীভাবে তার সামনে যাব! শেষে জানালা নামায়ে এক মুঠ ক্যাট বিস্কুট নিয়ে ছুড়ে দিলাম বাইরে, উঠানে বিছানো ইটের উপরে ছড়ায়ে গেল তার খাবার। সাধারণত আদিব দিত একটা পিরিচে করে।
উঠানের উপরে গাছের ছায়া, দুর্বল রোদের উপরে গাছের ছায়া দুলতেছে, তার উপরে ছড়ানো বিড়ালের খাবার। সে মাথা নিচু করে, একটা একটা করে দানা খুঁটে খুঁটে খাইতেছে। কেন কে বলবে, অন্ধকার হতে থাকা উঠানে তাকে দেখতে দেখতে চোখ ভর্তি করে পানি এল। আমরা তো যা দেখি, নিজের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি, আমাদের অনুভূতি অপরের উপরে আরোপ করি। আমার মনে হচ্ছিল সে একজন ভেঙে পড়া প্রাণ, যারা তাকে একদিন আপন বলে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছিল, তারা তাকে ফেলে চলে গেছে। তার জন্য তীব্র এক মায়া উথলে উঠে চোখের পানি হয়ে গেছিল সেই দিন। পরে কত দিন দৃশ্যটা মনে পড়েছে আমার। কখনো অফিস থেকে বাসে বাড়ি ফেরার পথে, কখনো ভিড়ের রাস্তায় চলতে চলতে, একটা অদ্ভুত কোমল বিষণ্নতায় ভরে গেছি প্রতিবার।
বসার ঘরে আমাদের জানালার কাচ নামানো যেত দুই স্তরে। প্রথমে অল্প, আরেকটু চাপ দিলে আরেকটু নিচে। সবটুকু নামালে বিড়াল চাইলেই লাফ দিয়ে জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারে, এই ভয়ে শুধু একটা ধাপ নামাতাম। বিড়াল মাঝে মাঝেই জানালার নিচে দাঁড়িয়ে উচ্চতা মাপত। দুই-একবার লাফ দিয়ে ওঠারও চেষ্টা করত, আমি জানতাম এই দূরত্ব সে ঘোচাতে পারবে না, এই জন্য ঘরের ভিতর থেকে মজা দেখতাম, মাঝে মাঝে জানালার কাচে টোকা দিতাম আর সে বাইরে থেকে আমার হাতে থাবা দিতে চেষ্টা করত। আদিব মাঝে মাঝে তাকে কোলে করে আমার সামনে নিয়ে এসে বলত, একটা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে, আমি তাতেও ভয় পেতাম, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতাম।
ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফেনিস সিনেমাতে হোলি গো লাইটলির একটা বিড়াল ছিল। তার কোনো নাম ছিল না, হোলি বলত, তার যেমন কোনো ঘর নাই কোনো নাম নাই, তার বিড়ালেরও থাকবে না; কারণ, তাদের আসলে কোনো আশ্রয় নাই।
এর মধ্যে একদিন মজার ঘটনা ঘটল। আদিব সেই দিনও কাজে। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বিড়াল এসে উঠানে দাঁড়িয়ে কাকভেজা ভিজতেছে আর সমানে ডাকতেছে। আমি এখন কী করি? স্লাইডিং দরজা খুললে বিড়াল ভিতরে আসবে আমার দিকে, তখন তো আমি অজ্ঞান হয়ে যাব! পরে এক বুদ্ধি বের করলাম–পিছনের রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঘুরে সামনের উঠানে গিয়ে বিড়ালের পেছন থেকে স্লাইডিং দরজা খুলে দিলাম আর সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল, সে ঢুকতেই আমি দরজা দিলাম বন্ধ করে। এবার সে ঘরের ভিতরে আর আমি বাইরে বৃষ্টিতে। এইভাবে মনে হয় দুই ঘণ্টা ছিলাম আদিব ফেরা পর্যন্ত। জ্বরও আসছিল!
আরেক দিন আদিব রান্নাঘরে টম ইয়াম স্যুপ বানাচ্ছে। সে রান্না করা মানে আমাকে ভূতের বেগার খাটতে হতো। রান্নাঘর আর বসার ঘর আসলে একটাই লম্বা ঘর। দুই অংশের মাঝখানে একটা ডাইনিং টেবিল দিয়ে সীমানা করা। আমি চুলার পার থেকেই দেখছিলাম বসার ঘরের খোলা জানালা তাক করে বিড়াল সমানে লাফ দিয়ে যাচ্ছে। তারপর সে অসম্ভবকে সম্ভব করে ঠিকই জানালার উপরে উঠে এল, তারপরে এক লাফে ঘরের ভিতরে। আমি এখন কই লুকাব, সেই চিন্তায় বাঁচি না, আদিব খুশিতে নাচতে নাচতে বলল, 'আরে এ তো দেখি রবার্ট ব্রুস!'

কবে যে এরপর আর তাকে দেখে ভয় লাগত না, এখন মনে নাই, কিন্তু দেখা গেল আমি ঠিকই তাকে কোলে নিতে পারি। টিভি দেখার সময় সে আমার পাশে বসে মানুষের মতো ঝিমাত। আমি বাইরে কাপড় শুকাতে গেলে সে আমার সাথে সাথে বের হয়ে কাপড় শুকানোর ছাতার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে চরম অবাক হয়ে দেখত কীভাবে মেলে দেয়া কাপড় দোল খাচ্ছে বাতাসে। প্রতিদিন বাসস্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিত আমাকে। বাড়ি ফিরে আমি আর কারও সাথে কথা বললে মিউ মিউ করে দুনিয়া তোলপাড় করত, যতক্ষণ না তাকে আমি কোলে নিই। আর ঠিক বাচ্চাদের মতো লুকোচুরি খেলত আমার সাথে।
ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফেনিস সিনেমাতে হোলি গো লাইটলির একটা বিড়াল ছিল। তার কোনো নাম ছিল না, হোলি বলত, তার যেমন কোনো ঘর নাই কোনো নাম নাই, তার বিড়ালেরও থাকবে না; কারণ, তাদের আসলে কোনো আশ্রয় নাই। তাই সে বিড়ালকে ডাকত ক্যাট। আমিও তার দেখাদেখি বিড়ালের নাম দিলাম বিলাই, সেটা ছোট হয়ে হলো বিল, তারপর বিল ক্লিনটন, তারপর মিস্টার প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়াও তার কাজকর্ম অনুসারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম রাখা হতো–অপরাধী, মীর জাফর, পটোল, ঘোড়ার ডিম ইত্যাদি।
আমার মন খারাপ হলে সে ঠিকই টের পেত। চুপচাপ এসে বসত আমার কাছে। এখনো কিছু দৃশ্য চোখে ভাসে। আমি বাড়ির ডেকে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে ডাকছি আর সে কোন অদৃশ্য কোণ থেকে বেড়া ডিঙিয়ে ঘাসের উপর দিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসত আমার কাছে। আমার একটা ডাকের জন্য এমন তীব্র প্রতীক্ষা কোনো দিন কেউ করে নাই।
কোনো কোনো গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আমি বাইরে ডেকে বসে বই পড়তাম। কোন প্রতিবেশীর রান্নাঘর থেকে চকলেট কেকের গন্ধ ভেসে আসত বাতাসে। একটা হাঁসের পরিবার আমার বাগানের ক্যাবেজ ট্রির তলায় এসে বসত দিবানিদ্রার জন্য। বিড়াল পায়ে পায়ে আমার কোল ঘেঁষে এসে বসত। আমি দেখতাম তার কানের পাশে জড়িয়ে আছে মাকড়শার জাল, মাথায় ফুলের রেণু। সে গা এলায়ে দিত, আমার হাত টেনে নিত তাকে আদর করার জন্য। আমি তার রোদ চিকচিক গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে জানতে চাইতাম–সে আজকে কোন রহস্যের উদ্ঘাটন করে এসেছে?
তার কাছে আমি জেনেছি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একজন বিড়ালের মতো বেঁচে থাকাই সর্বোত্তম! সম্পর্ক, সময়, শরীর বা আর যা কিছু আছে এই ধরাধামে তার কিছুরই, মানে একটারেও আঁকড়ায়ে ধরার কিছু নাই। বেশি আঁকড়ালে আঙুলকে সাঁড়াশি মনে হয়, নিজেকেই চেনা যায় না। কী দরকার এত কিছুর? শুরুই হয় শেষ হওয়ার জন্য, ফুরাবে তা জানা কথা। যার আসার আসবে, যার যাওয়ার যাবে, যার সাথে থাকার থাকবে।
এই দুনিয়ায় বিড়াল-জীবনই ভালো। রোদে, ঘাসে গড়াগড়ি দিব, বৃষ্টিতে ভিজব, মাকড়শার জালের রহস্য আবিষ্কারের চেষ্টায় কান, নাক ছ্যাড়াব্যাড়া করব...আলো থেকে অন্ধকার আবার অন্ধকার থেকে আলোয় পিছলায়ে পিছলায়ে পার হব। আমি নরম থাবায় এমনভাবে মাটিতে পা ফেলব, 'যাতে মটির বুকেও আঘাত না লাগে'...আর গান গাব–
'ধূপ থি নাসিব মে তো ধূপ মে লিয়া হ্যায় দম,
চাঁদনি মিলি তো হাম চাঁদনি মে সো লিয়ে...'