ঐ তে ঐরাবত

রাজার হাতি তথা রাজহস্তি কোথায় থাকে? হাতিশালে। মনে আছে শৈশবে ঘোড়াশাল নামের একটা জায়গা পার হয়ে দাদুবাড়িতে যেতাম। কোথায় ঘোড়া? চিকচিকে টাট্টু দূরে থাক, এক্কাগাড়ি টানা জিরজিরে ঘোড়াও তো চোখে পড়েনি! মিউনিসিপ্যালিটির অসম্পূর্ণ লাল লাল পুলের খাম্বা নদীর ওপর, লঞ্চ চলে যাচ্ছে ধোঁয়া তুলে, সেই দৃশ্য মনে আছে আমার। জায়গাটার নাম ঘোড়াশাল শুনে মনে হয়েছিল―এরপর নিশ্চয়ই হাতিশালও পথে পড়বে। পড়েনি। রাতের বেলায় হাতিশাল ঘোড়াশালে ঢুকে এক রাক্ষসী হাতি-ঘোড়া খেত, দিনের বেলায় সেই রাক্ষসী রানি সেজে থাকত। সেই ইচ্ছাধারিণী রানির নাম ছিল রুপতরাসী। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার শুনিয়েছিলেন আমাদের সেই রুপতরাসীর গল্প। ছোট্টবেলায় হাতি-ঘোড়া ছিল সব রূপকথার সুঠাম সঙ্গী।
ছড়ার শেষ লাইনে 'হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামণির বিয়ে' পড়ে ভারি আমোদ পেতাম, সারা দুনিয়ার প্রাণীরাও মানুষকে ভারি আদুরে ভাবে নাকি? বেশ তো! অ্যানথ্রপোমরফিজমের আরেক নমুনা ছিল আলেক্সান্দর কুপ্রিনের 'হাতি' বইটার শেষে―
'সেই রাত্রেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল নাদিয়া যে টমির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, আর তাদের ছেলেপুলে অনেক―ছোট্ট হাসিখুশি বাচ্চা হাতির পাল। হাতিটাকে রাতেই সার্কাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল―স্বপ্নে এই মিষ্টি, আদুরে মেয়েটিকে দেখতে পেল সে। এ ছাড়া সে দেখল বিরাট বড় বড় কেক, পেস্তাবাদাম আর আখরোট দেওয়া ফটকের মতো উঁচু...' নাদিয়া ছোট্ট মেয়ে, অবসন্ন রোগিনী, সার্কাসের হাতি এসেছিল তাকে দেখতে। এক দিনেই অবসাদ কেটে গেছিল মেয়ের, সেরে উঠেছিল সে, আর জাদুর কাঠির ছোঁয়াচ লেগেছিল আমাদের মতো খুদে পাঠকের মনেও। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাতিকে মনে আছে?
'হস্তী মশাই, হস্তী মশাই,
কিসের এত রাগ?
দেয়নি বুঝি হস্তিনী আজ
খাবার সমান ভাগ!
তাইতে কি গো এমন ক'রে
দাঁড়িয়ে আছ মানের ভরে?
বুক ফেটে জল আসছে চোখে,
মান্ছে না ক বাগ!'

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পঞ্চাননের হাতি' ছোটদের জন্য চমৎকার উপন্যাস, ছোট্ট মেয়ে পণ করেছে সে হাতিতে চড়ে দাদুর বাড়ি বেড়াতে যাবে। এদিকে দেশসুদ্ধ কেবল শিঙেল গরু আর দেড়েল ছাগল, হাতি কোথায়! পেল্লায় একটা জানোয়ার, তার জন্য তো বড়গোছের জঙ্গল চাই, জমিদারদের গড় তো সাফ হয়ে গেছে, জঙ্গল খোঁজা যাক তাহলে! এ কি আর শেয়াল-খাটাশ-ভাম যে ঝোপঝাড়ে থাকবে? আমাদের শৈশবে টেক্সটবুক বোর্ডের বাংলা বইয়ে পোষা কুনকি হাতিকে দিয়ে বন্য হাতিকে খেদায় এনে বশ করার প্রক্রিয়ার একটা বিবরণ ছিল। বাকি জীবন হাতি গহিন জঙ্গলের কাঠ বয়ে পার করে, রেলওয়ের শ্রমিক হয়ে জীবন দেয়। পরে বোর্ডের নতুন বইয়ে সেই রচনাটি বাতিল করে দেয়া হয়।
এই যে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড, এই ট্রাংকটা হস্তিশুঁড় থেকে এসেছে বলে ভাববেন না যেন! ঢাকার হাতিরপুল বা এলিফ্যান্ট রোড এই সব নাম শুনেও ছোট্টবেলায় ভাবতাম―এদিক দিয়ে হাতি যায় নিশ্চয়ই। পরে শুনেছি, হাতিরপুল দিয়ে একসময় ঠিকই হাতির পাল পার হতো। পুলের নিচে ছিল রেললাইন, হাতিরা রেললাইনের নুড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে পারত না―নরম গদি-আঁটা পা তাদের (হুমায়ুন আজাদ যেমন লিখেছিলেন, হাতি নাকি শুঁড় দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে পথের ধুলা সরিয়ে হাঁটে, যেন কুলবরইয়ের বীজ পায়ের তলায় না বেঁধে)। উপরের পুল বেয়ে পিলখানার হাতি দলে দলে হাতিরঝিলে যেত গোসল করতে। সেই থেকে জায়গাটার নাম হাতিরপুল। পিলখানা/ফিলখানা নামটার অর্থ হাতির আশ্রয়। সরকারি হাতিরা থাকত পিলখানায়। পিলখানা নামটা এখনো আছে। পিলখানা থেকে রমনার সবুজে চরতে যেত হাতির পাল, যে রাস্তা দিয়ে তাদের নেয়া হতো, সেটার নাম এলিফ্যান্ট রোড। হাতির মাহুতরা নির্ঘাত থাকত মাহুতটুলিতে। জায়গাগুলো আছে, হাতিরা নেই। কদাচিৎ মাহুতসওয়ার হাতি পথ রোধ করে দাঁড়ায়―শুঁড় তুলে ভিখ মাঙে, মাহুত প্রকৃতির বিপুলতম সন্তানকে ভিক্ষে করতে শিখিয়েছে।
হিন্দুধর্মে সর্বাধিক পূজিত দেবতা গণেশ। মা দুর্গার দুটি ছেলে―গণেশ আর কার্তিক। গণেশ নাদাপেটা―মাথাটি ঐরাবতের, ইঁদুর তাঁর বাহন। স্বল্পায়ু শিশুটিকে নিয়ে দুর্গা শোকাকুলা হয়ে উঠলে হাতির মাথা জুড়ে দিয়ে তাঁকে বাঁচানো হয়, জন্মাবধি গণেশ অত্যন্ত মাতৃভক্ত। মা দুর্গা একদিন ঘোষণা করলেন, যে আগে পৃথিবী ঘুরে এসে মাকে প্রণাম করতে পারবে, তাকেই তিনি গলার হার পুরস্কার দেবেন। কার্তিক চললেন পৃথিবী পরিক্রমায়। গণেশের মনে হলো, মা-ই তো জগৎ, তিনিই তো গণেশের পৃথিবী। মায়ের চারপাশটা ঘুরে এসে গণেশ মাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। কার্তিক ময়ূরে চড়ে দ্রুতগতিতে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এসে দেখলেন গণেশ গলায় মায়ের হারটি পরে মায়ের কোলে বসে আছেন। গণেশের ৩২টি রূপের ভেতর তান্ত্রিক রূপ আছে, তাঁর নাম উচ্ছিষ্টগণেশ (এ নামটা শুনলেই কেন যেন আমার ঢাকার রাস্তার শুষ্কচর্ম-ভিক্ষাবৃত্তিপটু হাতিদের কথা মনে হয়)। ইন্দ্রের বাহন ছিলেন 'ঐরাবত' হাতি, চারখানা দাঁত তার, আরেক নাম অভ্রমাতঙ্গ―মেঘের হস্তি। এই অভ্রমাতঙ্গ নামটা শুনলে রবীন্দ্রনাথের ছড়ার কথা মনে পড়ে―বৃষ্টির দিনে আকাশের মেঘ দলে দলে হাতির যুথ হয়ে চলেছে। ভারি সুন্দর সেই উপমা।
রূপকথায় রাজার মৃত্যুর পর রাজার আদরের হাতিকে পথে ছেড়ে দেয়া হতো, উন্মত্ত বেগে হাতি পথে ছুটতে ছুটতে একটি অনামা অচেনা মানুষের কপালে অদৃশ্য রাজটীকা দেখতে পেয়ে তাকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে পিঠে তুলে নিত, সেই হতো পরবর্তী রাজা। শামসুর রাহমান রৌদ্র করোটিতে লিখেছিলেন―
'ঐরাবতের খেয়ালখুশির ধন্দায়
ভোরের ফকির মুকুট পরে সন্ধ্যায়।
প্রাক্তন সেই ভেল্কিবাজির মন্তরে
যাচ্ছে চেনা অনেক সাধু-সন্তরে।
সেই চালে ভাই মিত্র কিবা শত্তুর
চলছে সবইÑমস্ত সহায় হাতির শুঁড়।'

সাধারণ মানুষ থেকে এক লহমায় হাতির মনোনীত রাজপুরুষ হওয়া...সেটা হয়তো রূপকথাতেই সম্ভব ছিল, আর সম্ভব আমাদের মতো দেশে। শুনেছি বাংলার রাজাদের বাহুবল ছিল হাতি, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের ভয়াল চেহারা দেখলেই কর্মকাবার। খোদ আলেকজান্ডার নাকি বিপাশার তীর থেকে ফিরে গেছিলেন নন্দ সাম্রাজ্যের যুদ্ধহস্তির বহর দেখে, শুনেছিলেন গঙ্গরিড়ইয়ের সম্রাটরা ৬০০০ হাতির বহর নিয়ে যুদ্ধে যেতে পারঙ্গম। আলেকজান্ডারের সেনাদের সঙ্গে হাতির বহরের প্রথম পরিচয় পারস্যের যুদ্ধে, পনেরোটা হাতি প্রতিপক্ষের সেনাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন আলেকজান্ডার। ঝিলম নদীর তীরে পুরুরাজের সঙ্গে যুদ্ধে আলেকজান্ডার সামনা করেন এক শ হাতির বহরের, সেসব হাতির দাঁতে লোহার বর্শা গাঁথা, পায়ের চাপে সৈন্যদের দলতে সিদ্ধহস্ত তারা...নাকি সিদ্ধপদ? হাতির সঙ্গে যুদ্ধে আদিম যোদ্ধার টেকনিক ব্যবহার করেছিলেন আলেকজান্ডারের সৈন্যরা―হাতির অরক্ষিত পায়ে আক্রমণ করেছিলেন তাঁরা―আতঙ্কিত যুদ্ধাহত হাতি তখন উল্টো আক্রমণ করছিল নিজ দলের সৈন্যদেরকেই, মাহুতের হাতে বিষমাখা বর্শা ছিল হাতিকে মারবার―কিন্তু মাহুত তো ততক্ষণে নিজেই নিহত। মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ছিল নয় হাজার হাতির বহর, 'গজাধ্যক্ষ' সেই হাতিদের দায়িত্বে ছিলেন। কলিঙ্গের যুদ্ধে সম্রাট অশোকের পক্ষে লড়েছিল সাত শ হাতি―স্বাস্থ্যে-শক্তিমত্তায়-সক্ষমতায় কলিঙ্গের হাতিদের জুড়ি ছিল না। দক্ষিণ ভারতের চোল সম্রাটদেরও লড়িয়ে হাতির বহর থাকত, গজনভি রাজবংশের যোদ্ধারাও হাতি ব্যবহার করতেন। আলেকজান্ডারের মতো করে মঙ্গোল চেঙ্গিস খাঁ এবং কুবলাই খাঁ হাতির বহরদের পরাস্ত করেছিলেন, তৈমুর লং প্রায় হেরেই যাচ্ছিলেন যুদ্ধে যদি না তিনি তাঁর উটের পিঠে খড়ের গাদায় আগুন দিয়ে হাতিদের দিকে অগ্রসর করে দিতেন। মুঘলরা নিজেরা ঘোড়সওয়ার হলেও হাতিকে বাগে আনতে পেরেছিল। মুঘল সম্রাট আকবরের ছিল বিরাট হাতিশালা। পলাশীর যুদ্ধের বিবরণে যেখানে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সারি সারি হাতি আর ঘোড়সওয়ার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে―আর বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটছে, সেখানটায় এসে আমার প্রতিবার ভারি কান্না পেত।
আদি ভারতের যুদ্ধে হাতি ছিল চতুরঙ্গের অংশ। ষোলটি মহাজনপদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার বেড়ে যায়। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে ছিল সাত অক্ষৌহিণী, আর কৌরবদের পক্ষে প্রায় দ্বিগুণ―এগারো অক্ষৌহিণী যোদ্ধা। একটি অক্ষৌহিণীর অংশ ২১,৮৭০টি হাতি। যুদ্ধে হাতির ফৌজের ব্যবহার হতো আদি পারস্যে, মেসিডোনীয় ও হেলেনিস্টিক গ্রিক রাষ্ট্রে, প্রাচীন রোমে, কার্থেজে, নুবিয়ায়, টলেমিক মিসরে, আদি চীনে। মধ্যযুগে কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিতে যুদ্ধহস্তি ব্যবহৃত হয়েছিল। গুপ্তযুগের সম্রাটদের যুদ্ধহস্তির তত্ত্বাবধানে থাকতেন যিনি, তাকে বলা হতোÑমহাপিলপতি। বাণভট্ট হর্ষচরিতে লিখেছিলেন হর্ষযুগে হাতিকে যুদ্ধে ব্যবহারের কথা। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতিকে দেখলে ঘোড়ার পিলে চমকে যেত, হাতি যেন জীবজাগতিক ট্যাংক একখানা―দেগে দেবার আগেই ভয়ংকর তার রূপ। প্রাচীন চীনা যুদ্ধগাঁথায় আছে হাতিরা কেমন করে পদাতিকদের আক্রমণ করত―তিরন্দাজরা হাতির গায়ে এত তির ছুড়ত যে হাতিগুলোকে অতিকায় সজারুর মতো দেখতে লাগত। গানপাউডার ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুরু হবার পর হাতি তার সেই বিধ্বংসী মহিমা হারায়। কামানের গোলার সামনে একসময় পরাস্ত হয় জীবজগতের অপরাজেয় ট্যাংক। চীন-বার্মা যুদ্ধে, ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধে তারপরও হাতি ব্যবহৃত হয়েছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বড় বড় অস্ত্রশস্ত্র বহনে ব্যবহার করা হয়েছিল হাতিকে, অনতি-অতীতের ভিয়েতনাম যুদ্ধেও হাতি ব্যবহৃত হয়েছে। জেমস হাওয়ার্ড উইলিয়ামসের 'এলিফ্যান্ট বিল'-এর ভূমিকায় আছে, 'যত জাহাজ তৈরিতে আর ভাসাতে হাতি আমাদের সহায়তা দিয়েছে, তত জাহাজ হেলেনের জন্যেও গ্রিকরা ভাসায়নি।'
ইসলামের ইতিহাসে আম-আল-ফিল বা হস্তিবর্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেনের খ্রিষ্টান রাজা আব্রাহা দ্য আবিসিনিয়ান তাঁর ষাট হাজার ইথিওপীয় যোদ্ধার বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে রওনা হন, উদ্দেশ্য কাবা ধ্বংস করবেন। কিন্তু হাতিদের সর্দার শ্বেতহস্তি মাহমুদ কাবার প্রাঙ্গণে পা ফেলতে অস্বীকার করে―ইয়েমেনি এবং মক্কিদের কাছে এ দৃশ্য এক অদ্ভুত পূর্বাভাস হয়ে ধরা দেয়। এই বহরকেই লাঞ্ছিত ও পরাজিত করে আবাবিল নামের ছোট্ট পাখির ঝাঁক, চঞ্চুতে তাদের ছোট ছোট পাথর, কোনো কোনো ইসলামিক ইতিহাসবিদ বলেন, পাখি নয় এ ছিল উড়ন্ত পতঙ্গবাহিত মড়ক। এ বছরই মহানবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় জন্ম নেন।
যেকোনো ভাষায় বাগধারা কেমন অতিসংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্রের মতো। এই যে হাতিকে নিয়ে ইংরেজিতে 'এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম' শুনলেই মনে হয় হাতিটা সারাটা ঘরজুড়ে দাঁড়িয়ে থেকে কান নাড়ছে―অথচ সব্বাই তাকে না দেখার ভান করছে। হাতির রং অনুযায়ী আবার অর্থ আলাদা, 'হোয়াইট এলিফ্যান্ট/শ্বেতহস্তি পোষা' আর 'গোলাপি হাতি দেখা' কতই না আলাদা। 'অন্ধের হস্তিদর্শন'―কথাটা শুনলেই মনে হয়, সাতজন অন্ধ মিলে হাতির গায়ে খামোকা হাত বোলাচ্ছে―কেউ ভাবছে হাতি আসলে শুঁড়ের মতো, কেউ পায়ে হাত দিয়ে ভাবছে―হাতিটা আসলে গোদা পায়ের মতো দেখতে। সংস্কৃত প্রবাদে আছে, 'গজভুক্ত কপিত্থবৎ', অর্থাৎ হাতিতে খাওয়া কদবেলের মতো, ভেতরে অসার বাইরে খোলস ঠিকঠাক আছে...যদিও সুবলচন্দ্র মিত্র বলছেন, এই গজ হাতি নয়, গজকীট। নারীর রকমফের প্রসঙ্গেও হাতি উপস্থিত। প্রাচীন পণ্ডিতরা চতুর্বিধ রমণীর উল্লেখ করেন―পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী, হস্তিনী। হস্তিনীদের শরীর ভারী, গলার স্বর সজোর, প্রচুর খায়-ঘুমোয়-মিথ্যে বলে-ধর্মে-কর্মে মন নেই, পরকীয়াতেও আসক্ত। এ প্রকরণ নিয়ে ভাবি, টের পাই অশনে-ব্যসনে-রোয়াবে-খোয়াবে নারীকে পিছপা হতে বা শক্তিমত্তায় নিরুৎসাহিত করতে পণ্ডিতরা কত বুদ্ধিই না বের করেছেন। মন চাইলেই আপনি খেয়ে-দেয়ে-হুলিয়ে-চিল্লিয়ে জীবন যাপন করতে পারবেন না, আপনার পিঠে পুরুষের মনোরঞ্জনের অদৃশ্য গুরুভার হাওদা। কিনা সুন্দর হতে হবে। যেন হাতি মন্দ্র-সুন্দর নয়। বর্ণনা পড়লেই তো মনের হাতিটা বিদ্রোহে জেগে ওঠে।

কালিদাসের 'কুমারসম্ভব'-এ বসন্তের সকাল কি সুন্দর, তিলফুলে ভোমরা বসেছে, কৃষ্ণসার হরিণ একে অন্যের গা চুলকাচ্ছে, হস্তিনিরা অতি স্নেহের বশবর্তী হয়ে পদ্মরেণুর সুগন্ধভরা জল শুঁড়ে তুলে প্রিয় হাতিদের দিচ্ছে। হাতিসংক্রান্ত বইয়ের কথা উঠলে 'লালজীর হাতির সঙ্গে পঞ্চাশ বছর' বইটির কথা উঠবেই, বুদ্ধদেব গুহর লেখায় প্রথম আমি বইটির কথা জানতে পারি। ভাওয়াল, মুক্তাগাছা, সুসং দুর্গাপুরের জমিদাররা হাতি প্রশিক্ষণের জন্য খ্যাত ছিলেন, আর ছিলেন আসামের গৌরীপুরের দ্বিতীয় রাজকুমার প্রকৃতীশ চন্দ্র বড়ুয়া (অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই)। হাতিমহল ইজারা নিয়ে তিনি হাতি ধরতেন। হাতির ভয়ানক মেজাজ, বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি―গন্ধের সূক্ষ্মতম ভেদ ধরার ক্ষমতা এড়িয়ে তাকে ধরা শুধু সাহসিকতার কাজই নয়, বুদ্ধির কাজও। হাতি ধরতে সারা শরীরের মনুষ্যগন্ধ লোপ করতে হাতির গু মেখেও বসে থেকেছেন, হাতি-পরিবৃত কুয়ার নোংরা জলে মাহুতদের সঙ্গে নেয়েছেন, আর ভালোবেসেছেন হাতিকে। তিনি বলতেন, পোষা হাতি কিন্তু পোষা গরুর মতো হয় না, বছরের একটি সময়ে সে রুদ্রগণেশ, উন্মত্ত হয়ে ওঠে। জানিয়ে দেয়, অন্তরে সে কোনো দিন পোষ মানেনি। ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী লিখেছেন 'হাতির বই'। মহাশ্বেতা দেবীর হাতিবিষয়ক ছোট গল্প বেশ কয়েকটি, সেই সংকলন হাতে করে আমি লেবার-রুমের দুরূহ সময় কাটিয়েছিলাম, পড়েছিলাম―মৃত্যু সন্নিকট হলে হাতি গভীর জঙ্গলে চলে যায়। জীবনকে যেমন প্রাণী অভ্যর্থনা জানায়, মৃত্যুকেও সে জানায় নিরালা অভিবাদন। টলকিয়েনের উপন্যাস 'দ্য লর্ড অব দ্য রিংস'-এ দক্ষিণের হারাদ্রিম জাতি হাতির মতো বা উলি ম্যামথের মতো একরকমের প্রাণীকে যুদ্ধে ব্যবহার করে, তাদের নাম অলিফন্ট। ধূসর, চলিষ্ণু পাহাড়ের মতো দেখতে। বনফুল 'স্থাবর' উপন্যাসে এই উলি ম্যামথের সঙ্গে আদিম মানুষের প্রথম পরিচয়ের নমুনা তুলে ধরেছিলেন।

সিনেমার হাতির প্রসঙ্গে আসি। প্রমথেশ বড়ুয়ার 'মুক্তি' সিনেমাটিতে বিশাল যে দাঁতাল হাতিটিকে আসামের জঙ্গলে লালিত-পালিত হতে দেখা যায়, সেটি লালজীর পোষা হাতি। তার দাঁত দুটি ছিল প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই। মনে পড়ে 'দ্য লায়ন কিং'-এ হাতির পালকে বন্য প্রাণীদের সবার কুর্নিশ, তারা বনের প্রাচীন রক্ষী। ১৯৭১ সালের সবচেয়ে হিট ছবি রাজেশ খান্নার 'হাথি মেরে সাথি', দক্ষিণ-এশীয় সাহিত্যে ও সিনেমায় প্রিয় পোষ্য প্রাণীর মৃত্যু দিয়ে করুণরসের অবতারণা করার একটা প্রচলন আছে, এ সিনেমাটিও ব্যতিক্রম নয় (নায়িকা তনুজার কন্যারা এই ফিল্ম দেখবার পর ছোটবেলায় দীর্ঘদিন মায়ের সঙ্গে কথা বন্ধ রেখেছিল, তনুজার জন্যই তো হাতিটাকে মরতে হলো!)। অবশ্য 'দ্য লর্ড অব দ্য রিংস' সিনেমায় পেলেনর ফিল্ডসের যুদ্ধে সব কটি অলিফন্টকে মরতে দেখেছি―পিঠে তাদের হাওদার মতো করে ওয়ার-টাওয়ার বসানো। শুভর জয় হয়েছে, তবু হাতির মতো দেখতে সেই প্রাণীগুলোর জন্য ব্যথাবোধ করেছি, মনে হয়েছে কি অসম্ভব প্রাণের অপচয় মানুষ করতে পারে! যে যুদ্ধে জয়ী হলে হাতির কোনো উপকার হবে না, সে রকম একটা বেফুজুল যুদ্ধে তাকে মরতে হয়! এর চেয়ে ঢের ভালো মুঘল-এ-আজমে দেয়ালের রিলিফে হাতির পায়ে দলিত হয়ে মরবার দৃশ্য দেখেও ভয় ভুলে প্রেমের জয়গান। কিংবা শিরিরূপী মধুবালা জরির হাওদার খুঁটি ধরে গাইছেন, 'গুজরা হুয়া জামানা আতা নহি দোবারা, হাফিজ খুদা তুমহারা।' (এই রে, ওটা তো উটের পিঠে বোধ হয়, শিরি মরুভূমিতে হাতি পাবেন কী করে!) 'গজগামিনী'র মাধুরীকে মিউজ-হিসেবে অমর করে গেছেন মকবুল ফিদা হুসেন। ১৯৪১ সালের মুভি 'ডাম্বো', সার্কাসের এক হাতির গল্প, গাধার মতো কান-লম্বা বলে তার নাম দেয়া হয় ডাম্বো...অথচ একদিন সে টের পায় এই লম্বা কান আসলে ডানা, সে উড়তে পারে! ডিজ্যাবিলিটি একদিন ডিফারেন্ট-অ্যাবিলিটি হিসেবে পরিচিত হবে, তার আগাম আভাস ডাম্বো। এমনি অন্তলীন সুরে বাঁধা চলচ্চিত্র ডেভিড লিঞ্চের 'দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান', উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে হাতির মতো আকারের চেহারার একটি অজাতশত্রু মানুষের জীবনের কথা। সিদ্ধিদাতা গণেশের মতোই, মা তারও অন্বিষ্ট।
যেসব দেশে হাতি বন্য প্রাণী হিসেবে বিচরণ করত, হাতি সেখানে সহসা বিলোপের শিকার হতে চলেছে। বহুমূল্য গজদন্ত, হাড়ের কারণে বলা হয় 'মড়া হাতির দাম লাখ টাকা', অথচ মড়া হাতির দাম আসলে চুকাতে হয় বাস্তুসংস্থান খুইয়ে। খাপছাড়ার কবিতায় রবীন্দ্রনাথের সেই 'হাতির হাঁচি'র কথা মনে পড়ছে।
'শুনব হাতির হাঁচি' এই ব'লে কেষ্টা
নেপালের বনে বনে ফেরে সারা দেশটা।
শুঁড়ে সুড়্সুড়ি দিতে নিয়ে গেল কঞ্চি,
সাত জালা নস্যি ও রেখেছিল সঞ্চি,
জল কাদা ভেঙে ভেঙে করেছিল চেষ্টা―
হেঁচে দু-হাজার হাঁচি মরে গেল শেষটা।'
কে মরে গেল? হাতিটা নাকি কেষ্টা? দক্ষিণ ভারতে আনারস ভেবে গ্রেনেড খেয়ে ফেলা গর্ভিনী হাতি আর হাতির বাচ্চার খবর আমাদের এলিফ্যান্ট ম্যানের অন্তিম অনুভবের কাছেই ফিরিয়ে আনে―মানুষের নিষ্ঠুরতা জগতে তুলনাহীন।
'নাই বা গেলে তাহার কাছে,
সারাটা বন প'ড়ে আছে, ―
সাবাড়্ করো গোড়া থেকে
গাছের অগ্রভাগ!
হস্তী মশাই, হস্তী মশাই,
কিসের এত রাগ?'
যোগীন্দ্র সরকার দেখে গেলেন না, বন নেই তো হাতি আগডাল খাবে কোত্থেকে? সে তাই নেমে আসে পাকা ফসলের খেতে, আখ-কলা-ভুট্টা-ধান তছনছ করে। হোটেলের আমবাগিচায় আম পাকে―বাতাস আমের গন্ধে মশহুর―হোটেলের ভেতর দিয়ে গজেন্দ্রগমনে চলে হাতি―আম খাবে প্রকৃতির আদরের দুলাল। কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্কের আশপাশে ২০০ বিঘা ধানের জমিতে আগে হাতির জন্য ধান আর ঘাস ফলানো হবে, হাতিরা সেসব খেয়ে ডেরায় ফিরে গেলে আবার ফসল ফলাবে কৃষকেরা...সেটা কি আদৌ করা হয়েছে? এমন উদ্যোগে আশ্বস্ত বোধ করতে চাই, পৃথিবীটা সকলের। কামানের গোলার কাছে একদা হার মেনেছিল হাতি, খিদের কাছে পরাভব মানলে যে তার মৃত্যু!