আন্তঃনগর ট্রেনে আরও বেশি যাত্রাবিরতি দেওয়ার চাপে রেলওয়ে

অপ্রয়োজনীয় যাত্রাবিরতি (স্টপেজ) কমানোর পরিকল্পনার মধ্যেই ফের নতুন করে স্টপেজ বাড়ানোর চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন সময় আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। গত দেড় দশকে শুধু পূর্বাঞ্চলেই ২৩টি আন্তঃনগর ট্রেনকে ২৩টি স্টেশনে দুই দিকেই (মোট ৪৬ বার) যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছে।
যদিও অপ্রয়োজনীয় যাত্রাবিরতি পর্যালোচনা করে তা বন্ধের পরিকল্পনা করেছিল সংস্থাটি। কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেনের যাত্রাবিরতি চালুর জন্য আন্দোলন, রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা আসার কারণে এখন উল্টো যাত্রাবিরতির স্টেশন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চাপে পড়েছে রেলওয়ে।
এমন অবস্থায় আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রার সময় বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্য ট্রেনের সময় ব্যবস্থাপনা নিয়েও জটিলতায় পড়ছে সংস্থাটি।
রেলেওয়ের তথ্যমতে, সাবেক স্থানীয় সংসদ, মন্ত্রী, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত যাত্রাবিরতির জন্য রেলওয়েকে সুপারিশ করেছে। যত্রতত্র যাত্রাবিরতি প্রদানে রেলের অপারেশন ও বাণিজ্যিক বিভাগের অনীহা থাকলেও ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়েছে।
এতে রেলের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ট্রেন যাত্রায় সেবার মান অস্বাভাবিক কমে গেছে। ৫ আগস্টের পর অপ্রয়োজনীয় যাত্রাবিরতি বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলে উল্টো চাপে পড়ে রেলওয়ে। বর্তমানে আরও যাত্রাবিরতির দাবি আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে, আসন্ন নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধি বা ছাত্র প্রতিনিধিরা এ দাবি করছেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্ব) মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, "আমরা আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে চাই। কিন্তু বিভিন্ন স্টেশন এলাকার মানুষের আন্দোলন, দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কমানোর পরিবর্তে বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকছে না।"
রেলওয়ের তথ্যমতে, নরসিংদী স্টেশনে সর্বমোট ২৯টি ট্রেনের যাত্রা বিরতি রয়েছে। এর ১৪টিই আন্তঃনগর ট্রেন। এর বাইরে ১০টি কমিউটার ট্রেন ও ৫টি মেইল ট্রেনেরও যাত্রাবিরতি রয়েছে এই স্টেশনে। এরপরও সম্প্রতি পারাবত এক্সপ্রেস, মহানগর গোধূলি/প্রভাতী এক্সপ্রেস, তূর্ণা এক্সপ্রেস এবং উপবন এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতির আবেদন করা হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে।
রেল সচিব রেলওয়েকে যাত্রাবিরতির বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনাও দিয়েছেন। রেলের সময়ানুবর্তিতা ধরে রাখতে পরিবহন বিভাগ শুধুমাত্র মহানগর গোধূলি, মহানগর প্রভাতী ও উপবন এক্সপ্রেসকে নরসিংদী স্টেশনে যাত্রাবিরতি প্রদানে সম্মত হয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী মহানগর গোধূলি, তুর্ণা এক্সপ্রেস এবং সিলেট অভিমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের নাঙ্গলকোট স্টেশনে যাত্রাবিরতির জন্য চিঠি দিয়েছেন রেলওয়েকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে রেলের মহাপরিচালককে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে চট্টলা, পাহাড়িকা ও মেঘনা এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতি রয়েছে কুমিল্লার এই স্টেশনে। পাশাপাশি সিলেট-নাঙ্গলকোটসহ আরও একাধিক ট্রেনের যাত্রাবিরতি রয়েছে এই স্টেশনে।
নাঙ্গলকোট স্টেশনের মাত্র ১০ কিলোমিটারের মধ্যে আরও রেলওয়ে স্টেশন থাকায় বাড়তি যাত্রাবিরতির চাপে আন্তঃনগর ট্রেনগুলো নাজুক অবস্থায় পড়ছে বলে জানিয়েছে পরিবহন বিভাগ।
এছাড়া ৫ আগস্টের পর নাটোরের নলডাঙ্গার মাধনগর রেলওয়ে স্টেশনে আন্তঃনগর বরেন্দ্র, রূপসা এবং বুড়িমারী এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করা হয়। বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রাবিরতির দাবিতে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলপথ অবরোধ করেছিল ছাত্র-জনতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন দ্রুত সংস্কার ও অবিলম্বে সকল ট্রেনের যাত্রাবিরতির দাবিতে জেলা নাগরিক ফোরামের উদ্যোগে গত বছরের ৯ অক্টোবর মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়।
গাজীপুরের শ্রীপুর রেলওয়ে স্টেশনে আন্তঃনগর সব ট্রেনের যাত্রাবিরতির দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর আন্তঃনগর ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস আটকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত-শত মানুষ। পঞ্চগড়ে যাত্রাবিরতির দাবিতে দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস আটকে রেললাইন অবরোধ করেন স্থানীয়রা।
এছাড়া, টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেন চালুকরণ এবং চিত্রা এক্সপ্রেস একতা, পদ্মা ও লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রাবিরতির দাবিতে ট্রেন আটকে দিয়েছিলেন উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও মির্জাপুরের সাধারণ জনতা।
মূলত করোনা মহামারির সময় কমিউটার, লোকাল ও মেইল ট্রেনসহ দ্বিতীয় শ্রেণির মোট ৯৩টি ট্রেন বন্ধ করেছিল রেলওয়ে। এরপর আর ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল সংকটের কারণে ট্রেনগুলো চালু করা হয়নি। ফলে আন্তঃনগর ট্রেনেই যাত্রাবিরতির মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে চাইছেন স্থানীয়রা।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, রেলওয়েতে ইঞ্জিন সংকট এতোটাই তীব্র যে চাহিদার দুই তৃতীয়াংশেরও কম সচল। ফলে অধিকাংশ ট্রেনই কানেক্টিং ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করতে হয়।
এছাড়া, রেলওয়ের সুনির্দিষ্ট শিডিউল থাকায় নতুন করে যাত্রাবিরতি দেওয়া হলে রানিং টাইম বাড়বে। ফলে ফিরতি ট্রেনগুলোর শিডিউল বিপর্যয় হবে। প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে দূরত্ব হিসাবে গড়ে ১০টির বেশি যাত্রাবিরতি দেওয়া থাকে। ন্যূনতম দুই মিনিট যাত্রাবিরতির জন্য প্রতিটি ট্রেনের অন্তত ১০ মিনিট সময়ক্ষেপণ হয়। রেলের ইঞ্জিন, কোচ জনবল অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বাড়তি যাত্রাবিরতির কারণে সংকটগুলো প্রকট হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, "ঢাকার সন্নিকটের বিভিন্ন স্টেশনের যাত্রা কল্যাণ সমিতিগুলো প্রায় সকল ট্রেনকে যাত্রাবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে। এতে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর ভ্রমণ সময় বৃদ্ধি, সেবার মান কমে যাওয়া ছাড়াও শিডিউল বিপর্যয়ের মতো ঘটনা ঘটছে।"
"রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে অপ্রয়োজনীয় যাত্রাবিরতি পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নিলেও এখন উল্টো তা বাড়াতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রেলের যাত্রী পরিষেবা মারাত্মক ভাবে বিঘ্নিত হবে," যোগ করেন তিনি।