আমার স্নিকার্স

আমাদের ছোটবেলায় কোনো কিছুর প্রাচুর্য ছিল না। সেই দুনিয়ায় আমাদের দুই ধরনের জুতা ছিল। চামড়ার জুতা আর কেডস। চামড়ার জুতা তখন অধিকাংশ সময় মানুষ অর্ডার দিয়ে জুতার দোকান থেকে বানিয়ে নিত। সেই সব জুতায় সব সময় কিছু না কিছু খুঁত থাকত।
হয় সাইজে একটু খাটো হতো, না হয় ভেতরে কোনা-কাঞ্চি দিয়ে পেরেকের গুতো খেতে হতো। সাইজে খাটো জুতা নিয়ে অভিযোগ করতে গেলে জুতাওয়ালা বলত, এটা পরতে পরতে ঠিক হয়ে যাবে। এই সব গেঞ্জামের কারণে আমার পছন্দ ছিল কেডস। আমার ধারণা, বাংলাদেশে কেডস প্রথমে বাটাই নিয়ে এসেছিল ষাটের দশকে।
আমি যখন থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি, একদিন আমার কেডস খেলতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে বলে বাবাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি যে আমাকে এক জোড়া কেডস কিনে দিতে হবে। কারণ হিসেবে ছেঁড়া জুতা দেখলাম।
বাবার তখন হয়তো মুডটা ভালো ছিল, তাই হেসে বলল, 'ঠিক আছে বাপু কিনে দেব!'
কোনো তর্ক কিংবা উপদেশ ছাড়াই বাবা এত সহজে রাজি হয়ে গেল বলে আমি মহা খুশি!
পরের দিন বিকেলে উনি যখন আমাকে নিয়ে কেডস কিনতে বের হলেন, তখন আবার ভিন্ন মুড! সারা রাস্তা উনি বলতে লাগলেন, 'কেন রে বাপু...এত ঘন ঘন জুতা নষ্ট হবে কেন?'
আমি বলার চেষ্টা করি যে আমার এর আগে জুতা ছেঁড়েনি–প্রতিবছর বড় হচ্ছি, তাই সাইজ বদলে যায়।
উনি মাথা নেড়ে বলেন, 'কই...আমি এক জোড়া জুতা পরছি তিন বছর ধরে...আমারটা তো ছেঁড়ে না! তোমারটা কেন ছিঁড়বে?'
আমি কী বলব...আমি কেডস পরে খেলি, দৌড়াই! উনি তো অফিস যায় আর আসে। উনারটা কেন ছিঁড়বে! কিন্তু বাবা আমাকে বকেই যাচ্ছে, 'না বাপু...এসব একদম অপচয়! অপচয়কারী শয়তানের ভাই!'
তখন আমার অবস্থা–দরকার নেই আমার কেডসের, বাসায় ফিরতে চাই!
এরপর কেডস সেদিনই কেনা হয়েছিল কি না, মনে নেই! তবে তখনকার ব্যাপারটা ছিল এমন। এক জোড়ার জায়গায় দুই জোড়া কেডস কিংবা জুতা কল্পনা করা যেত না। কিন্তু আজ আমার দুই জোড়া অ্যাডিডাস, এক জোড়া নাইকি, এক জোড়া আসিক্স, তিন জোড়া আন্ডার আর্মর, দুই জোড়া নর্থ ফেস, আরও দু-এক জোড়া অন্য ব্র্যান্ডের স্নিকার্স আছে। আমি স্নিকার্স ভালোবাসি। আমি নিয়মিত হাঁটি আর মাঝে মাঝে অনলাইনে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্নিকার্স দেখতে ভালোবাসি।
আপনারা হয়তো আমাকে পাগল ভাবছেন। আমি অবশ্যই কিছুটা পাগল। কিন্তু বিষয়টা কেবল পাগলামি না। যে-ই লোক সিরিয়াসলি নিয়মিত হাঁটে, তাকে স্নিকার্স কিনতেই হবে। আপনি উল্টাপাল্টা জুতা পরে নিয়মিত হাঁটেন, আপনার পা ব্যথার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি।

ইয়ংওয়ানের কর্ণধার কিহাক সুং, যিনি সারা বিশ্বে গার্মেন্টস, টেক্সটাইলস, ব্যাগ এবং জুতা নির্মাণ এবং রপ্তানিকারক হিসেবে সুপরিচিত, একবার আমাকে ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে জুতা তৈরির ব্যবসা অনেক বড়; কিন্তু তার মধ্যে স্নিকার্সের ব্যবসা অকল্পনীয় বড়। বিষয়টা সত্যি তা-ই। যারা হাঁটেন এবং স্বাস্থ সচেতন, তারা কখনোই এক জোড়া স্নিকার্স কিনে সন্তুষ্ট থাকেন না। অফিস যাওয়ার জুতা এক জোড়া হতে পারে; কিন্তু হাঁটার জন্য কমপক্ষে দুই জোড়া থাকা চাই।
আর স্নিকার্সের রং এবং ডিজাইনের বৈচিত্র্য এত বেশি যে ওরা আপনাকে ডাকতে থাকে: আমাকে কেন! কিনিস না কেন আমাকে?
আমি প্রথম যখন ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম সেই ১৯৮৩ সালে, আমি তখন কলেজে ঢুকেছি। ইন্ডিয়া গিয়েই এক জোড়া স্নিকার্স কিনলাম। ঢাকায় তখন এলিফ্যান্ট রোডে স্নিকার্স বেচে, কিন্তু অনেক দাম। আমাদের কাছের বন্ধুদের মধ্যে শুধু বুলান্দ এই সব নাইকি, অ্যাডিডাস কেনে। কারণ, ওই ব্যাটা জুয়াড়ি। আর ও তাসের জুয়ায় সব সময় জেতে। আমি খুব খারাপ জুয়াড়ি ছিলাম। হারতাম...তাই আমি জুয়া খেলতাম না। বুলান্দ মাসে মাসে টাকা জমিয়ে এলিফ্যান্ট রোড থেকে থাই জিনস কিনত। অ্যাডিডাসও কিনত। আমার কপালে সেসব ছিল না।
যা-ই হোক, কলকাতায় গিয়েই আমি এক জোড়া কেডস কিনলাম। খয়েরি রঙের স্ট্রাইপ ছিল। ওটা পরে আমি খুব উত্তেজিত; কারণ, ওটা আমার প্রথম স্নিকার্স (কেডস না)।
আমরা চারজন এরপর দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি ট্রেন দিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনি টয় ট্রেন দিয়ে দার্জিলিং যাওয়া যাবে না; কারণ, ভূমিধস হয়েছে। নিয়মিত বাস বা গাড়িও আজ যাচ্ছে না। সে কী কথা! তাইলে কী হবে। আমরা বাসস্ট্যান্ড গেলাম সমাধানের জন্য। সমাধান পেয়ে গেলাম–আমরা ৪ জন প্লাস আরও বেশ কিছু লোকজন দার্জিলিং যাবে। আমরা সবাই মিলে একটা ট্রাক ভাড়া করলাম, যেটা ভিন্ন রাস্তা দিয়ে কালিম্পং হয়ে দার্জিলিং যাবে।
উঠলাম ট্রাকে। ভীষণ গরম বলে খালি গেঞ্জি আর জিনস পরে আছি। জুতা জোড়া খুলে রেখেছি সামনে। আমরা ট্রাকের পেছনে খোলা জায়গায় ব্যাগ-বস্তা নিয়ে বসে। আমার পাশে কলকাতার একটা বুড়ো-বুড়ি। শুরু হলো যাত্রা।
চা-বাগানের পাশ দিয়ে ক্রমে ওপর দিকে উঠতে থাকল সেই ট্রাক। কী দুর্দান্ত দৃশ্য। পাশে তিস্তা নদী–সাদা বালি; পাহাড়ি ঢাল। এ যেন জীবন্ত একটা গান (ইয়েস ব্যান্ডের ক্লোস টু দ্য এজ–ঠিক এমন পরিবেশের অনুভূতি দেয়)। কিন্তু সরু রাস্তা। একটু পর আমার ভয় লাগা শুরু হলো। মনে হতে থাকল এক্ষুনি আমাদের ট্রাক খাদে পড়ে যাবে। তার ওপর গরমের বদলে বেশ ঠান্ডা লাগা শুরু হলো।
ভয়ংকর সব বাঁক পার হওয়ার পর একসময় হটাৎ আমার পাশে থাকা কলকাতার বুড়িটা ভক ভক করে বমি করা শুরু করল! একি কারবার! আমি কোনোমতে পিছিয়ে আমার হাত-পা রক্ষা করলাম। উনি যখন বমি শেষ করল, তখন দেখলাম সব বমি সুন্দরমতো আমার নতুন স্নিকার্সের ভেতর পড়েছে। আমার তো হার্ট অ্যাটাক! জীবনের প্রথম নিজের স্নিকার্স! তার মধ্যে বমি! আমি কটমট করে বুড়ির দিকে তাকাই। সে খুব সরি! আমি কী আর বলতে পারি!
একটু পর একটা জায়গায় ট্রাক থামল পর আমি মনোকষ্ট নিয়ে সেই স্নিকার্স একটা ঝরনার পানিতে ধুলাম। আর যেহেতু আর অন্য কোনো জুতা নেই, সেই ভিজা জুতা পরেই আমাকে দার্জিলিংয়ে সেদিন হাঁটতে হয়েছিল!
এদিকে তখন বাংলাদেশে নিয়মিত নাইকি এবং অ্যাডিডাস পাওয়া গেলেও দাম ছিল অনেক। আমি নিজের পয়সায় ঢাকার বাজার থেকে এসব জুতা কেনার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। আমার প্রথম নাইকি আমি কিনেছিলাম সিঙ্গাপুর বেড়াতে গিয়ে সেই ২০০১ সালে। তখনো কলিজাটা এতো বড় হয়নি যে ১০০-১৫০ ডলার দিয়ে নাইকি কিনব। একটা সেলে ৬০ ডলার দিয়ে এক জোড়া নাইকি কিনে মহা খুশি!
কিন্তু আমি নাইকির ওপর খুব নাখোশ হলাম এক বছর পর। জুতা তখনো যথেষ্টই ঝকঝকে; কিন্তু ওটার সোল নিজে নিজে খুলে গেছে। ওটার আঠায় সমস্যা! মুচির কাছে নিয়ে সেলাই করে জুতা পরি আর নাইকিকে গালি দেই! কারণ, তখন জুতাটা পরলে মনে হতো আমি সেকেন্ড হ্যান্ড জুতা পরছি।
এরপর থেকে যখনি বিদেশ গিয়েছি, এক জোড়া স্নিকার্স কিনেছি।
বাংলাদেশে এখন অনেকেই ফেসবুকে স্নিকার্সসহ বিভিন্ন বিদেশি পণ্য বেঁচে। এরা কেউ আমেরিকা; কেউ ভিয়েতনাম; কেউ মালয়েশিয়া আবার কেউ জার্মানি থেকে জুতা এনে দেয় বলে দাবি করে। আমি যেমন মালয়েশিয়া-ভিয়েতনামের অ্যাডিডাস, নাইকি এবং আন্ডার আর্মর ওয়েবসাইট থেকে আমার জুতা পছন্দ করে ওদের কাছে অর্ডার দিয়েছি, ওরা এনে দিয়েছে।
এসব স্নিকার্স খুব সস্তা না। সবচেয়ে নিচে ৫০০০ টাকা আর ওপরের দিকে দামের কোনো শেষ নেই। তবে আমি ১৫০০০ অতিক্রম করি না। কিন্তু লোকে লক্ষ টাকা দিয়েও জুতা কেনে–বিশ্বাস করেন!
ঢাকার বাজারে এসব জুতা পাওয়া যায়। কিন্তু ভেরিয়েশন কম। অন্তত ব্রান্ডের ওয়েবসাইটে যত ভেরিয়েশন আর সাইজ আছে, সেটা এমনি ঢাকায় পাওয়া যায় না। সাইজ একটা বিশাল ফ্যাক্টর; যদি আপনার পায়ের মাপ বেশি বড় হয়। যেমনটা ছিল প্রয়াত টেলিকম বিশেষজ্ঞ আবু সায়ীদ ভাইয়ের।
সায়ীদ ভাইয়ের পায়ের মাপ ১২। আমার পায়ের মাপ ৮। বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ মানুষের পায়ের মাপ ৬ থেকে ৯-এর ভেতর। আপনার পায়ের মাপ ১০ হলে মাপমতো জুতা পাওয়া মুশকিল হবে। আর ১২ মাপের জুতা বাংলাদেশের কোনো দেশি ফ্যাক্টরি বানায় না। তাই সায়ীদ ভাইয়ের জুতা পাওয়া নিয়ে ছোটকাল থেকেই সমস্যা।
একবার ওনার মামা আমেরিকা থেকে ফিরবে। বাসায় ফোন করে মামা জানতে চাইল, তোর জন্য কী আনব সায়ীদ?
সায়ীদ ভাই খুশিতে ভুসি হয়ে বলল, 'এক জোড়া জুতা! ১২ সাইজের!'
'নো প্রব্লেম,' মামা বলে ফোন রাখল।
পরের সপ্তাহে মামা এল পর সায়ীদ ভাই উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে গেল মামার কাছে। মামা স্যুটকেস খুলে কাপড়চোপড়, শ্যাম্পু ইত্যাদি বিভিন্নজনকে দিচ্ছে। সায়ীদ ভাই গিয়ে বলল: মামা, আমার জুতা?
মামা রীতিমতো খেপে গেল, 'তোর ওগুলো কি পা, না অন্য কিছু, এ? ওই রকম সাইজের জুতা খুঁজে আমি নাকাল! ওই সাইজের জুতা কি আছে? জানি না!'
সায়ীদ ভাইয়ের চেহারাটা মলিন হয়!
মামা কিন্তু উত্তেজিত হয়ে বলেই যাচ্ছে, 'তোর জুতার সমস্যা কী! এক জোড়া গরু নিয়ে আয়। ওদের পু*কির্ ভেতর তোর দুই পা ঢুকিয়ে হাঁটবি!'
সায়ীদ ভাই খাবি খায়! মামা অবশ্য জুতা জোড়া এনেছিল! একটু ঝাড়ি দিল আরকি!
সব কথার শেষ কথা: নাইকির চেয়ে অ্যাডিডাস পরে হাঁটতে বেশি আরাম। নাইকি টেকে কম, অ্যাডিডাস বেশি টেকে!