অ্যান্টার্কটিকায় চোখধাঁধানো কয়েক দিন

অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার এক বিরল সুযোগ এল অপ্রতাশিতভাবে। আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে অসাধারণ এই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিলেন ল্যারি হবস। ল্যারি একাধারে নাবিক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষক ও প্রকৃতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এসেছিলেন মিয়ানমারের ইরাবতী নদীতে প্রাণী পর্যবেক্ষণকারী একটা দলের নেতৃত্ব দিতে। পাখি পর্যবেক্ষক হিসেবে ওই দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমাদের ইরাবতী অভিযান শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বব মাসের প্রথম সপ্তাহে। আমি ছাড়া বাকি দশজনই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের।
ইরাবতী নদীতে একসঙ্গে দশ দিন কেটেছে ল্যারির সঙ্গে। কেটেছে পৃথিবীর দুর্গম, রহস্যঘেরা আর মনোরম সব স্থানের গল্প করে। দুনিয়ার ভয়ংকর জায়গাগুলো দেখার বহু সৌভাগ্য ল্যারির হয়েছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর সংবাদ হলো দলনেতা হয়ে তিনি অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে যাচ্ছেন। আমি বললাম, 'ল্যারি, আপনাকে দেখে আমার যা হিংসা হচ্ছে, তা জীবনে কারও জন্যে এ রকম হয়নি।' হাসলেন ল্যারি। জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি কখনো অ্যান্টার্কটিকা যাবার স্বপ্ন দেখেছেন কি?'
ল্যারি আমাকে জানেন পাখিদর্শক হিসেবে। পৃথিবীর দুর্গম এলাকায় অভিযানকারীদের বীরত্বপূর্ণ সব কাহিনি পড়ে আমার তারুণ্যের কত রোমাঞ্চিত দিন যে কেটেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আবিষ্কার আর অভিযানের কাহিনিতে আমি আকণ্ঠ ডুবে আছি দেখে তিনি বললেন, 'পেঙ্গুইন আর অ্যালব্যাট্রসের দর্শন ছাড়াও অ্যান্টার্কটিকায় আপনার জন্য অনেক আকর্ষণ আছে। আমি দেশে ফিরে আপনাকে অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লিখব। আমাদের সঙ্গী হলে সাধ মিটিয়ে পেঙ্গুইন আর অ্যালব্যাট্রস দেখতে পারবেন।'
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমাদের ইরাবতী অভিযান শেষ হলো। বিদায় নিলেন ল্যারি। আমি অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেশে ফিরলাম। দিন কাটতে থাকল উৎকন্ঠায়। চিরতুষারের মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা এখনো পৃথিবীর দুর্গমতম স্থান। অ্যান্টার্কটিকার ভূগোল এখনো চাঁদের ভূগোলের চেয়ে বেশি অজানা। এখনো মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের অ্যান্টার্কটিকার ভূমিতে পদার্পণের ভাগ্য হয়েছে। এই একটা মহাদেশ এখনো মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর উল্লেখযোগ্য কোনো অংশ আজও মানুষের হাতে পরিবর্তিত হয়নি। মানুষের কোনো শহর, বন্দর, বসতি, কিছুই সেখানে নেই। অ্যান্টার্কটিকায় বাস প্রধানত সিল, পেঙ্গুইন আর পেট্রেলের; তা-ও অস্থায়ীভাবে। কোটি কোটি বছরের সঞ্চিত বরফের চাদরের নিচে সমাধিস্ত এই মহাদেশে কোনো প্রাণীই স্থায়ীভাবে বাস করতে পারে না। সিল, পেঙ্গুইন, পেট্রেল, অ্যালবাট্রস এসব সামুদ্রিক প্রাণী গ্রীষ্মে শুধু প্রজননের জন্য সমুদ্র ছেড়ে আসে অ্যান্টার্কটিকার উপক'লে। এখানে এরা গ্রীষ্মের অতিথি মাত্র।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে ল্যারির চিঠি পেলাম। সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার আমন্ত্রণ। জানুয়ারি ২২, ১৯৯৭ 'এক্সপ্লোরার' নামের জাহাজ আর্জেন্টিনার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশে রওনা হবে। বারো দিনের অভিযান শেষে ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৯৭ ফকল্যান্ড দ্বীপে ফিরে আসবে। ল্যারি লিখেছেন, এই অভিযানে যেতে সম্মত হলে আমি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি।
আর্জেন্টিনার যে বন্দর থেকে অভিযান শুরু হবে, তার নাম উশুআইয়া। উশুআইয়া পৃথিবীর সর্বদক্ষিণ শহর। এত দক্ষিণে মানুষ বাসের উপযোগী আর কোনো জায়গা নেই। অভিযাত্রী দলের উশুআইয়া যাওয়ার জন্য চিলির রাজধানী স্যান্টিয়াগো থেকে একটা বিমান চার্টার করা হয়েছে। সে বিমান আমাদের জানুয়ারি ২২, স্যান্টিয়াগো থেকে উশুআইয়া নিয়ে যাবে এবং ফেব্রুয়ারি ২, ফকল্যান্ড দ্বীপ থেকে স্যান্টিয়াগো ফেরত নিয়ে আসবে।
অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণে যাওয়ার সম্মতি জানিয়ে আমি পূর্বপ্রস্তুতি আরম্ভ করলাম। প্রথমে স্যান্টিয়াগো যাওয়ার বিমান টিকিট কেনা, তারপর চিলি আর আর্জেন্টিনার ভিসার ব্যবস্থা করা। ভিসার আবেদন করতে আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে; ভারতে অথবা থাইল্যান্ডে। ভাগ্যক্রমে অ্যান্টার্কটিকা কোনো দেশ নয়। সেখানে প্রবেশ করতে তাই কোনো ভিসা দরকার হবে না।

অ্যান্টার্কটিকায় মানুষের উপস্থিতি রয়েছে শুধু কয়েকটি গবেষণাগারে। আমাদের সফরের একটা উদ্দেশ্য হলো কয়েকটা গবেষণাগার দেখা। আমাদের অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য অবশ্য অ্যান্টার্কটিকার প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চরম ঠান্ডার মধ্যে বসবাসকারী বিচিত্র প্রাণীদের জীবনযাত্রার পর্যবেক্ষণ করা, আর পৃথিবীর পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে অ্যান্টার্কটিকার ভূমিকা উপলব্ধি করা। তবে আমার সবচেয়ে বড় অভিসন্ধি হলো নানা জাতের পেঙ্গুইনের ঘরকন্নার খুঁটিনাটি একেবারে তাদের ঘরের দাওয়ায় বসে দেখা। আর ভাগ্য প্রসন্ন হলে ম্যারাথন উড্ডয়নে পৃথিবীর সবচেযে বড় দুই চ্যাম্পিয়নকে স্বচক্ষে দেখা। এই চ্যাম্পিয়নরা হলো ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস আর আর্কটিক টার্ন। এই অসাধারণ দুই পাখিকে এক যাত্রায় দেখা পাওয়া একমাত্র অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রীর পক্ষেই সম্ভব।
অ্যান্টার্কটিকা যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া কোনো সোজা কর্ম নয়। প্রথমে চাই ঢাকা-স্যান্টিয়াগো-ঢাকার বিমান টিকেট। কাজটি ব্যয়বহুল, কিন্তু অসাধ্য নয়। এর চেয়ে কঠিন হলো কাপড়চোপড় বাছাই করা। চরম ঠান্ডার মধ্যে টিকে থাকার মতো সবকিছু চাই। আবার বোঝাটি খুব ভারী হলে চলবে না। মহা সমস্যা! অ্যান্টার্কটিকা যাত্রীর জন্যে ছাপানো নির্দেশাবলি আমার কাছে এসে গেছে। উলের অন্তর্বাস, টুপি, দস্তানা, মোজা আর সোয়েটার; ফ্লানেলের জামা আর গরম কাপড়ের প্যান্ট; রেইনপ্রুফ প্যান্ট-কোট; গাড়ো কালো চশমা; এসব সাথে নিতে হবে। জাহাজে আমাদের রাবারের বুট, লাল পার্কা (জ্যাকেট) আর ওয়াটারপ্রুফ ব্যাকপ্যাক মিলবে।
আর্জেন্টিনা আর চিলি এই দুই দেশের ভিসা সংগ্রহের জন্য আমি ১৪ জানুয়ারি দিল্লির পথে রওনা হলাম। দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকে চিঠি নিয়ে ভিসার কাজটি ত্বরান্তিত করার উদ্যোগ নিলাম। অ্যান্টার্কটিকা সফরে যাচ্ছি এই সংবাদে সবাই উৎসাহ জোগালেন। ফলে বাধাবিপত্তির দৈত্যগুলো পথ রোধ করে দাঁড়াল না কোথাও।
স্যান্টিয়াগো পৌঁছালাম ২১ জানুয়ারি। সেখানে নানা দেশ থেকে অভিযাত্রী এসে জড়ো হচ্ছে। হিমবাহ বিশারদ ডক্টর হ্যারল্ড বর্নসের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি বারোবার অ্যান্টার্কটিকা গেছেন! বয়স সত্তরের ওপরে। বললেন, 'আমাকে হ্যাল বলে ডাকবেন, সবাই তা-ই ডাকে।' মনে অনেক বল পেলাম। এই বয়সে হ্যাল তেরোতমবার যা করতে যাচ্ছেন, আমি একবার কি তা করতে পারব না!
জানুয়ারি ২২, ১৯৯৭: চার্টার করা বিমানে সদলবলে উশুআইয়া যাত্রা করলাম। চার ঘণ্টার ভ্রমণ। আমার পাশের যাত্রী ডরোথি আঙ্গারলাইডার, বয়স পঞ্চাশের ওপর–প্রথমবারের মতো অ্যান্টার্কটিকা যাচ্ছেন। বললেন, 'আমাকে ডটি বলে ডাকবেন, ওটাই আমার ডাকনাম।'
স্যান্টিয়াগো থেকে আন্দিস পর্বতশৃঙ্গের দীর্ঘ শুভ্র রেখা ধরে চার ঘণ্টা সোজা দক্ষিণ দিকে উড়ে গিয়ে উশুআইয়া শহরের দেখা মিলল। উশুআইয়ার খুদে বিমানবন্দরে দ্রুত আমাদের ইমিগ্রেশন শেষ হলো। ল্যারি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। জাহাজে করে তিনি আগেই উশুআইয়া এসেছেন। আমি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এই সুদূর উশুআইয়া পৌঁছাতে পারব কি না, তা নিয়ে তাঁর অনেক চিন্তা ছিল। দলের অন্য সবাই জাহাজে ওঠার আগে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের এই শহরটি দেখে নিতে গেলেন। বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝখানে ছোট একটু সমতল ভূমিতে লুকিয়ে রয়েছে উশুআইয়া শহর।
বিকেল পাঁচটায় উশুআইয়া থেকে যাত্রা শুরু হলো। যাত্রার শুরুতে যাত্রীদের সাথে জাহাজ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। ৮৪ জন যাত্রী এসেছেন: ৯ জন দক্ষিণ আফ্রিকার; ৬ জন যুক্তরাজ্যের; ৬ জন জাপানের; ৩ জন ইতালির; ২ জন মালয়েশিয়ার; আমি একা বাংলাদেশের; বাকি সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। আগামী বারো দিন জাহাজে সর্বক্ষণ আমাদের দোদুল্যমান থাকতে হবে। জাহাজের ক্যাপ্টেন উলি ডেমেল যাত্রীদের সতর্কতার সঙ্গে রেলিংয়ে হাত রেখে অথবা মাথার ওপর ঝুলান দড়ি ধরে চলাফেরার পরামর্শ দিলেন। জাহাজ অচিরে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দিল।
জাহাজে চড়ে সমুদ্রে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার এর আগে হয়নি কখনো। প্রতি মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছিল জাহাজের ডেকে গিয়ে চারদিক চেয়ে দেখতে। পরিচয় পর্বের শুরুতেই ল্যারি বললেন, 'এখানে আমার একজন বিশিষ্ঠ বন্ধু আছেন, যিনি এসেছেন সুদূর বাংলাদেশ থেকে। মিয়ানমারে আমাদের পরিচয় হয়। সেখানেই আমি তাঁকে আমাদের অভিযানের কথা বলেছিলাম। অভিযানের কথা শোনায় তিনি অ্যান্টার্কটিকা আসার জন্যে উতলা হয়ে পড়েন।' রঙ্গপ্রিয় ল্যারি অভিনয় করে দেখালেন আমার সেদিনের উৎসাহের অতিশয্যটা। সবাই বেশ মজা পেলেন। আমাকে দাঁড়িয়ে চেহারাটা দেখাতে হলো। সবাই হাততালি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন।
জাহাজের দুলুনিজনিত অসুস্থতা তথা সি-সিকনেসের প্রতিষেধক বড়ি খাবার অথবা ইনজেকশন নেবার জন্য ডাক্তার সবাইকে পরামর্শ দিলেন। বড়ি খেলে সি-সিক হবার ঝুঁকিটা কিছু কমে, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গা ম্যাজম্যাজ আর ঘুম-ঘুম ভাব দেখা দেয়। জীবনের দুর্লভ এই বারো দিনে আমি তো চোখের পলকই ফেলতে চাই না; ঘুম-ঘুম ভাব দিয়ে কি আমার চলবে! তাই ঠিক করলাম, বড়ি পকেটে রেখে দেব, অসুস্থতার লক্ষণ দেখা না দেয়া পর্যন্ত খাব না।

জাহাজ টেরে-ডেল-ফুগোর দ্বীপপুঞ্জের ভেতর দিয়ে প্রশস্ত সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা যে প্রণালি দিয়ে যাচ্ছি, তার নাম 'বিগল চ্যানেল'। আমরা এখন পৃথিবীর অনেক দক্ষিণে চলে এসেছি। সূর্যাস্ত দেখতে হলে রাট এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দক্ষিণ গোলার্ধে এখন গ্রীষ্মকাল। এখানে দীর্ঘ দিন আর ক্ষুদ্র রাত্রি। যতই দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকব ততই দিন দীর্ঘতর আর রাত ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে।
যাত্রীদের রাতের খাবারের ডাক পড়ল। ব্রিজ-ডেকের নিচতলাতেই খাবার ঘর। খাবার ঘরে চেয়ার-টেবিল সব মেঝের সাথে আটকানো। টেবিল থেকে থালাবাসন যাতে গড়িয়ে না পড়ে, তারও ব্যবস্থা রয়েছে। খাবার নিজে নিতে হবে, পরিবেশন করা হবে না। সেখানেই হলো সমস্যাটা। খাবারের থালা হাতে করে নিজের টেবিলের দিকে যাবার পথে টলে পড়ে যাবার সমূহ আশঙ্কা। জাহাজ তো নিরন্তর এপাশ-ওপাশ করতে থাকে, কোনো আহার-বিরতি দেয় না।
কোনোরকম ডিনার সেরে সবাই আবার ছুটে এলেন ব্রিজ-ডেকে। সবার মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে যাবার উত্তেজনা। জাহাজ প্রণালি থেকে সাগরের দিকে এগিয়ে চলছে। এখানে পূর্ব থেকে আটলান্টিক আর পশ্চিম থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এসে একত্র হয়েছে। সমুদ্রের এই স্থানের নাম 'ড্রেক-প্যাসেজ'। সবাই জাহাজের ডেক থেকে সমুদ্র দেখছে। সমুদ্র ক্রমেই দিকচিহ্নহীন, নীল আর উত্তাল হচ্ছে। বেশ কয়েকটি সামুদ্রিক পাখি ইতিমধ্যে জাহাজের সঙ্গী হয়েছে। রাত নয়টা বাজে। সূর্য ডুবতে এখনো অনেক দেরি।
সারা দিনের ছুটোছুটিতে শ্রান্ত সবাই। একসময় আলো আরও পড়ে গেল। সমুদ্রের কালচে পানি থেকে পেট্রেলদের আর আলাদা করে দেখার উপায় থাকল না। ডেকে দাঁড়িয়ে একা একা ঠান্ডা হওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার তো আর কোনো কারণ নেই। ক্লান্ত পায়ে আমার জন্যে নির্ধারিত কেবিনের দিকে ছুটলাম।
সরু এক চিলতে কেবিন। অতি অল্প পরিসরে আরাম-আয়েশের সব ব্যবস্থা রয়েছে। গরম হাওয়া দিয়ে ঘর উষ্ণ রাখা হয়েছে। দেয়াল ঘেঁষে বসানো একটা লম্বা কাঠের বাক্সের ওপর বিছানা। বিছানার শেষ প্রান্তে একটা খুদে ওয়ার্ডরোব। অন্য দেয়ালে রয়েছে সরু একটা সোফা। সোফার শেষে রয়েছে চার বর্গফুটের এক বামন-টয়লেট। কেবিনের শেষ প্রান্তে এক ফুট ব্যাসের একটা গোল কাচের জানালা। জানালা দিয়ে দেখা যায় শুধু ধাবমান সমুদ্রের পানি।
জানুয়ারি ২৩, ১৯৯৭: সমুদ্রে আমার কেটে গেল এক রাত। সকালে জেগে দেখি জাহাজের দোলার মাত্রাটা বেড়েছে আগের চেয়ে। মুখ ধুতে, দাড়ি কামাতে অহেতুক দীর্ঘ সময় লাগল। কত কী যে দেখা হচ্ছে না এই কেবিনবন্দী থাকার ফলে। তাড়াতাড়ি গরম কাপড় গায়ে চড়িয়ে বাইরে ছুটলাম। ডেকের রেলিং আঁকড়ে ধরে আমাদের অবস্থানটা আঁচ করার চেষ্টা করলাম। চারিদিকে নীল আকাশ আর সমুদ্র; মাটির কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। জাহাজ ড্রেক-প্যাসেজের নীল পানি কেটে চলছে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের চারদিকে অতিশীতল সমুদ্রের পানি যেখানে অ্যাটলান্টিক, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ পানির সাথে এসে মেশে, সেই বলয়কে বলা হয় 'অ্যান্টার্কটিকা কনভার্জেন্স'। এই বলয়টি মহাসমুদ্রগুলোর উর্বরতম অঞ্চলগুলোর একটি। এখান থেকেই আসে 'ক্রিল' নামের খুদে চিংড়ির অফুরন্ত সরবরাহ। এই ক্রিল খেয়ে বেঁচে আছে বহু প্রজাতির তিমি, সিল, পেঙ্গুইন এবং আরও অনেক সামুদ্রিক প্রাণী। আমাদের সবার প্রত্যাশা, এই অঞ্চলে এসে পৌঁছালে বিশাল তিমির ঝাঁক দেখতে পাব।
সকাল থেকে আমাদের জাহাজের সঙ্গী হয়েছে বেশ কয়েকটি দৈত্য 'পেট্রেল' পাখি, নাম 'সাদার্ন জায়ান্ট পেট্রেল'। বিশাল বিশাল ঘুড়ির মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা উড়ে চলেছে জাহাজের পেছনে। জাহাজের পাশে পানির সামান্য ওপরে উড়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পেট্রেল, স্টর্ম-পেট্রেল আর প্রায়ান পাখির দল। স্টর্ম-পেট্রেল আমাদের পরিচিত ফিঙ্গে পাখির মতো ছোট একটা পাখি। নির্ভীক এই খুদে পাখির দল সাগরের উত্তাল পানির ওপরে হাঁসের মতো চ্যাপ্টা পা ফেলে ফেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হয় যেন পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
পাখি দেখার বিরতি পড়ল সকালের নাশতার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে। এসে দেখি জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। তাই নাশতায় বসেও পাখিদের সঙ্গ পুরোপুরি ত্যাগ করতে হলো না। জানালার পাশে বসে পাউরুটি-ডিম খেতে খেতে পাখিদের মাছ শিকারের দৃশ্য উপভোগ করলাম। নাশতা শেষ করে সবাই আবার ব্রিজ-ডেকে চলে এলাম। পাখি দর্শকেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন 'ওয়ান্ডারিং অ্যালব্যাট্রস' পাখি দেখার জন্য। ডানার দৈর্ঘ্যরে মাপে ওয়ান্ডারিং অ্যালব্যাট্রসই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। ডানার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পাখিটি ১১-১২ ফুট দীর্ঘ হয়ে থাকে। দীর্ঘ ডানায় ভর করে এই পাখি ক্লান্তিহীনভাবে বছরের পর বছর মহাসমুদ্রে উড়ে বেড়ায়।
বেলা একটার সময় আমাদের প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাখিবিজ্ঞানী ব্রেন্ট হিউস্টন জাহাজের মাইকে ঘোষণা করলেন যে একটা ওয়ান্ডারিং অ্যালব্যাট্রস দেখা গেছে জাহাজের পেছনে। সবাই ছুটলেন জাহাজের পিছন দিকে। দেখা গেল ওই অসাধারণ পরিব্রাজক পাখিটি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের জাহাজ অনুসরণ করছে। পাখিদের সাথে বেশিক্ষণ কাটানো হলো না আমাদের। সবাইকে সভাকক্ষে যেতে হলো রাবারের বুট, লাল পার্কা ব্যাকপ্যাক সংগ্রহ করার জন্য।
আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী ডটি অঙ্গারলাইডার তাঁর পার্কা, বুট আর ব্যাগপ্যাক নিয়ে আমার সঙ্গে কেবিন পর্যন্ত এলেন। আমার পাশের কেবিনেই আছেন। ডটি বললেন, 'যথেষ্ট গরম কাপড় এনেছেন তো! কাল রাতে যে পোশাক পরে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেসব দিয়ে কিন্তু আর চলতে পারবেন না। ক্রমেই আমরা চরম ঠান্ডার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।' আমি বললাম, 'আমার বাক্সে যে পোশাক আছে, তা দিয়ে আমি কুমেরু থেকে দুবার ঘুরে আসতে পারব। তবে দিল্লির পালিকা বাজারে গরম কাপড় কিনতে গিয়ে উলের মোটা মোজা খুঁজে পাইনি বলে গরম মোজার একটু ঘাটতি রয়ে গেছে।'
কেবিনে এসে বুট, ব্যাকপ্যাক রাখতে না রাখতেই দেখি ডটি এসে হাজির। তাঁর হাতে উলের মোটা মোজা। ডটি বললেন, 'এই মোজা রাখুন, আপনার কাজে দেবে, আমার বাড়তি মোজা রয়েছে।' আমি বললাম, 'আপনার এই গোলাপি রংয়ের মোজা আমি পুরুষ মানুষ হয়ে পরব কী করে।' ডটি বললেন, 'অ্যান্টার্কটিকার শীতে প্রাণে বাঁচাতে চাইলে পড়বেন বৈকি।'
কাপড়চোপড়, বুট, ব্যাকপ্যাক, পার্কা, লাইফজ্যাকেট, সব গোছগাছ করে দুপুরের খাবারের জন্য দৌড় দিলাম। দুপুরের খাবারের পরে সবাই সভাকক্ষে এসে হাজির। কিম রবার্টসন তিমির গানের ক্যাসেট শোনালেন। তিমির ভাষা আমাদের কাছে অবোধ্য। তবে ধ্বনির ছন্দোবদ্ধ ব্যবহার আর বিশেষ পঙ্ক্তির বারবার উচ্চারণ শুনে মনে হয় পাখির মতো তিমিও গান গায়। সমুদ্রের তলদেশে তিমির গান দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে এবং শত শত মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। তিমির গানের উদ্দেশ্য আমাদের অজানা। অনুমান করা যায় যে তিমির সামাজিক জীবনে এবং প্রজননে এই গানের ভূমিকা রয়েছে।
সভা শেষে সবাই জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালেন। সমুদ্র আর আকাশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। আজ দিনের শেষে আমাদের ড্রেক-প্যাসেজের মাঝামাঝি স্থানে এসেছি। এখান থেকে পাঁচ শ মাইলের মধ্যে কোথাও মাটির সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে না। এখন আমরা পৃথিবীর ৬৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশের কাছাকাছি এসেছি। সমুদ্র আর আকাশ এখানে নীল, স্বচ্ছ আর বৈচিত্রহীন। প্রত্যাশা রয়েছে অ্যান্টার্কটিকা কনভারজেন্সে বিচরণকারী তিমি দলের সাক্ষাৎ পাব। সদ্য শোনা তিমির গান সবার মাথায় ভর করে আছে। মনে হচ্ছে জাহাজের সামনে এখনই হুস করে ভেসে উঠেবে কিম-এর কাহিনির কোনো এক গায়ক তিমি। অনেকেই হলপ করে বলে ফেললেন যে তাঁরা তিমির গান শুনতে পাচ্ছেন। পানিতে মাইক্রোফোন না ডুবিয়ে যে তিমির গান শোনা সম্ভব না, এইসব শুকনো তথ্য ড্রেক-প্যাসেজের এই অপার্থিব নীল বলয়ে ভাসমান মানুষগুলো এখন মনে রাখতে চান না। এই অসীম নীলের মধ্যে এই মুহূর্তে শুধু একটি প্রাণীর উপস্তিতি সবার কাম্য–একটা গায়ক তিমি। অনেক সময় কেটে গেল; তিমি এল না।
জানুয়ারি ২৪, ১৯৯৭: সমুদ্রে আর একটি ভোর হলো। জাহাজের দোলায় ঘুমের কোনো অসুবিধা হয়নি। দোলর তীব্রতা ধীরে ধীরে বেড়েছে বলেই হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছি। গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে দুরবিন নিয়ে দৌড়ে ডেকে উঠলাম। কোথায় এলাম দেখতে চাই। ঝকঝকে রোদের সকাল।
জাহাজ যখন ড্রেক-প্যাসেজ পার হচ্ছে, যাত্রীরা সবাই সভাকক্ষে অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা আর দুর্ঘটনার মোকাবিলার বিষয়গুলোর আলোচনা শুনছেন। প্রস্তুতি আর প্রশ্নোত্তরের পালা চলছে। ভাগ্যক্রমে আবহাওয়া খুব ভালো। ভয়ংকর ঢেউয়ের মধ্যে পড়েনি জাহাজ সারা দিনে। পাঁচ-ছয়জন যাত্রী সি-সিক হয়েছেন। বাকি সবাই ভালো আছেন, তবে কেউ তা নিয়ে বড়াই করার সাহস পাচ্ছে না। সামনে এখনো ১০ দিনের ভ্রমণ রয়েছে, সমুদ্রের ঢেউ কখন কেমন থাকবে, কেউ জানে না।
দুপুরের খাবারের পর আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল 'অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি'। ১৯৫৯ সালে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী ১২টি দেশের মধ্যে প্রথম এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে আরও দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর করায় এখন মোট ৪২টি দেশ এই চুক্তির আওতাভুক্ত। অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে কোনো জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার না করা এবং এই মহাদেশে পরিবেশের ক্ষতি সাধন না করা। অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর বৃহত্তম নির্জন প্রান্তর। সিল, পেঙ্গুইনের মতো অনেক প্রাণীর এটাই শেষ আশ্রয়। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ও অসতর্ক আনাগোনা এদের জীবনযাত্রায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। বরফে ঢাকা অতিশীতল পরিবেশে কোনো দ্রব্য মাটিতে মিশে যাবার সুযোগ পায় না বলে মানুষ পরিত্যক্ত বস্তুতে সহজেই অ্যান্টার্কটিকার পরিবেশ কুলষিত হতে পারে। 'অ্যান্টার্কটিকায় আগন্তুকের জন্য অবশ্য-পালনীয় নীতি হলো অ্যান্টার্কটিকায় কিছু ফেলে আসা যাবে না, অ্যান্টার্কটিকার কিছু নিয়ে আসা যাবে না।'
বেলা চারটার সময় বাইনোকুলার দিয়ে অ্যান্টার্কটিকার দীপপুঞ্জ দেখতে পেলাম। সাদা বরফে ঢাকা সমুদ্রের মধ্যে কুয়াশায় গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে এক সারি তুষারভূমি। জাহাজে কারও মুখে টুঁ শব্দটি নেই। এই সেই ভূমি, যা দেখে জেমস কুক ১৭৭৫ সালে অ্যান্টার্কটিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন; কিন্তু বরফের ব্যূহ ভেদ করে সেখানে পৌঁছাতে পারেননি।
এখন আমরা ড্রেক-প্যাসেজ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে দ্বীপের তুষারঢাকা পাহাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভাসমান বরফের প্রতিরক্ষা ব্যূহের মধ্যে দ্বীপগুলো দর্পভরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিকালের পড়ন্ত রোদে সাদা সাদা পাহাড়গুলোর বিশাল ছায়া শুয়ে আছে বরফের উপত্যকায়। উপসাগরের বরফ-গলা পানিতে হাজার হাজার পেঙ্গুইন শ্বাস নেবার জন্য বারবার লাফিয়ে উঠেই আবার পানিতে ডুব দিচ্ছে। আমরা অ্যান্টার্কটিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। সবার মধ্যে অভূতপূর্ব আর অপ্রত্যাশিত সব অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রত্যাশা আর উত্তেজনা।

জাহাজ দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপগুলোর মধ্যে পৌঁছে গেল। এখানকার কোনো দ্বীপে আজ কোনো অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে এখানে এসে অ্যান্টার্কটিকার ভূমিতে একবার পদার্পণ করার লোভ সংবরণ করা কঠিন। ফলে আইচো নামের এক দ্বীপের কাছে জাহাজকে নোঙর করতে হলো। 'জোডিয়াক' নামের বড় বড় স্পিডবোটে উঠে আমরা ডাঙায় গেলাম।
আইচো দ্বীপের যে অংশে আমরা নামলাম, সেটা বরফমুক্ত। বরফমুক্ত জমি অ্যান্টার্কটিকায় এক দুর্লভ বস্তু। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ৯৭.৫ শতাংশ জমি সর্বক্ষণ বরফের নিচে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মকালে পাহাড়ের ঢালু জায়গা থেকে জমাট বরফ পিছলে সমুদ্রে পড়ে গেলে কিছুদিনের জন্য অ্যান্টার্কটিকার কিছু ভ'মি উন্মুক্ত হয়। এই উন্মুক্ত জমি অ্যান্টার্কটিকার প্রাণীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রজননের জন্য চাই বরফমুক্ত জমি। শক্তিশালী পুরুষ 'ফারসিল' বাছাই করা জমি দখল করে মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করবে।
পেঙ্গুইনের দল দ্রুত নুড়ি-পাথরের বাসা বানিয়ে, ডিম পেড়ে, ছানা ফুটিয়ে, ছানা বড় করে সমুদ্রে ফিরে যাবে অ্যান্টার্কটিকার জমিন আবার বরফে ঢেকে যাবার আগে। প্রজননের এই শ্বাসরুদ্ধকর প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছে পেঙ্গুইনছানা। পেঙ্গুইনছানাদের পৃথিবীর আদর্শতম শিশুর সনদ দিতে যে কোনো মা সম্মত হবেন। কান্না নেই, দুষ্টুমি নেই, নেই অন্য শিশুর সঙ্গে বিবাদ-বসচা।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে ৩৫ কোটি পাখির বাস। এর অর্ধেকই পেঙ্গুইন। পেঙ্গুইন মূলত সমুদ্রের প্রাণী। জীবনের ৯০ ভাগ সময় সমুদ্রে থাকে। ডাঙায় আসে সে শুধু প্রজননের জন্য। অ্যান্টার্কটিকায় আগন্তুকের জন্য শর্ত রয়েছে পেঙ্গুইন থেকে কমপক্ষে ১৫ ফুট দূরে থাকার এবং পেঙ্গুইনের যাতায়াতের পথে না দাঁড়াবার।
আইচো দ্বীপে পেঙ্গুইনের পাশাপাশি আমরা শত শত 'এলিফ্যান্ট সিল' আর কয়েকটা 'ফার সিল' দেখলাম। এলিফ্যান্ট সিলের দল মসৃন পাথরখণ্ডের সাজানো বিছানায় শুয়ে আছে। এখানে তাদের গায়ের পুরোনো চামড়া খসে পড়বে। আর নতুন চামড়া তৈরি হবে। শীতের প্রকোপ শুরু হবার আগেই নতুন আবরণে সজ্জিত হয়ে তারা সমুদ্রে ফিরে যাবে।
আইচো দ্বীপ থেকে আটটা নাগাদ জাহাজে ফিরতে হলো। রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে জাহাজের রৌদ্রোজ্জ্বল ছাদে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা সিল আর পেঙ্গুইন দেখার প্রথম অভিজ্ঞতার গল্প বিনিময় করছে। আমরা এখন পৃথিবীর ৬০ ডিগ্রি দক্ষিণে। রাত এগারোটায় সূর্য সমুদ্রে ডুবে দিল, মাত্র চার ঘণ্টার জন্য। রাত তিনটায় সে আবার দেখা দেবে। ডোবার পরেও সূর্য দিগন্তের বেশ নিচে যায় না বলে এখানে রাতের অন্ধকার নামে না। রাত এগারোটার সময়ও পাহাড়, সমুদ্র আর মেঘের ছবি তোলার মতো যথেষ্ট আলো থাকে।
জানুয়ারি ২৫, ১৯৯৭: সকালে উঠে দেখলাম আমরা গেরলাশ প্রণালি দিয়ে দক্ষিণে যাচ্ছি। অগুনতি হিমবাহের মধ্য দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে জাহাজ এগোচ্ছে। ভাসমান বরফের পাহাড় কোনো কোনোটা এক কিলোমিটার লম্বা। সকালের খাবারের পর জোডিয়াকে চড়ে ভাসমান হিমবাহগুলো কাছ থেকে দেখার পরিকল্পনা ছিল। তার আগেই জাহাজের মাইকে জানানো হয়: 'তিমি, তিমি দেখা গেছে।' পড়িমরি করে আমরা ডেকে ছুটে গেলাম। দেখা গেলো বহুদূরে তিনটে বিশাল প্রাণী বারবার পানির ওপরে ভেসে উঠেছে। বাইনোকুলার দিয়ে দেখে বোঝা গেল তারা হাম্পব্যাক তিমি।
জাহাজ তিমির দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। তিনটি হাম্পব্যাক কোনো এক দুর্বোধ্য খেলায় মত্ত। জাহাজটাকে তারা আর এক খণ্ড ভাসমান বরফের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বস্তু বলে মনে করল না। জাহাজের দশ হাতের মধ্যে এসে বারবার ভেসে ওঠে আর ডুবসাঁতার দিয়ে জাহাজের এপাশ থেকে ওপাশ গিয়ে মহাসমুদ্রের এই তিন দৈত্য আমাদের তাদের খেলার সঙ্গী করে নিল। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে তিমির গোল্লাছুট খেলা, সাঁতার আর ঝাঁপ দেবার প্রতিযোগিতা দর্শক হিসাবে দেখার ভাগ্য এর আগে এই জাহাজের কোনো নাবিকেরও নাকি হয়নি। ভাবতেও অবাক লাগে যে এই অতিকায় ও নিরীহ প্রাণীকে আমাদের কারখানার চাকায় তেল দেবার উদ্দেশ্য একসময় বধ করা হতো। দীর্ঘ সময় আমাদের নাগালের মধ্যে থাকার পর তিমিত্রয় হঠাৎ গহিন সাগরে উধাও হয়ে গেল।
'গেরলাশ' প্রণালি থেকে বেলা একটায় জাহাজ 'এরেরা' চ্যানেলে প্রবেশ করল। জাহাজ অতিকায় হিমবাহগুলো এড়িয়ে চললেও অন্য সব বরফের আঘাত এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই জাহাজের গায়ে হাতুড়ি পেটাবার মতো দমাদম আওয়াজ হয় সারাক্ষণ। বেলা তিনটার সময়ে আমরা যে উপকূলে পৌঁছালাম, তার নাম 'প্যারাডাইস বে' বা 'স্বর্গোপকূল'। প্রায় চারিদিকে পাহাড়ঘেরা এই নিরাপদ পোতাশ্রয়কে ঝড়ের সময় নাবিকের কাছে স্বর্গপুরী বলেই মনে হবে। জাহাজ থেকে 'জোডিয়াকে' নেমে আমরা ডাঙার দিকে রওনা হলাম। এটাই হবে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের মূল ভূমিতে আমাদের প্রথম পদার্পণ। বরফে ঢাকা একটা খাড়া পাহাড়ের পদদেশে জোডিয়াক থেকে নামলাম। এখানে সমদ্রের পাড়ে একটা বরফহীন টিলার ওপর লাল রংয়ের দুটো কাঠের ঘর বসানো রয়েছে। এই ঘর দুটোই হলো আর্জেন্টিনার গবেষণা কেন্দ্র, 'আলমিরান্টে ব্রাউন'। শুধু গ্রীষ্মকালে এই কেন্দ্রে কয়েকজন গবেষক থাকেন। কেন্দ্রটি দেখার পর আমরা নরম পুরু বরফের মধ্যে হেঁটে পাহাড়ের শীর্ষে উঠে গেলাম।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের সবটুকুই হিমবাহ আর হিমেল বরফে ঢাকা। কোটি কোটি বছর ধরে এই বরফ জমা হচ্ছে। জমাট বরফ কোথাও কোথাও তিন কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়েছে। সারা মহাদেশে জমা বরফের উচ্চতা গড় করলে প্রায় দুই কিলোমিটার হয়। এই কারণে অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সর্বোচ্চ মহাদেশ। সমস্ত পৃথিবীর সব বরফের ৯০ শতাংশ রয়েছে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে, আর তাই পৃথিবীর সুপেয় পানির ৭০ শতাংশ আছে এই মহাদেশেই।
অ্যান্টার্কটিকা অবশ্য চিরদিনই এমন বরফাচ্ছাদিত ছিল না। মাত্র ২০ কোটি বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা ছিল 'গন্ডোয়ানাল্যান্ড' নামের এক বিশাল ভূমিখণ্ডের অংশ। বিশ কোটি বছর আগে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের ভাঙা টুকরা থেকেই হয়েছে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা আর দক্ষিণ আফ্রিকা। উষ্ণ অক্ষাংশে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ থাকার সময় অ্যান্টার্কটিকার জমিতে গাছপালা ও পশুপাখি ছিল। অ্যান্টার্কটিকার ভূতাত্ত্বিক গঠন, জীবাশ্ম আর কয়লাখনি পরীক্ষা করে এই বিষয়গুলো জানা গেছে। ২০ কোটি বছর আগে গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর অ্যান্টার্কটিকা দক্ষিণ মেরুতে সরে গিয়ে ক্রমান্বয়ে পুরু বরফের আচ্ছাদনে সমাধিস্থ হয়েছে। অ্যান্টার্কটিকা এখন পৃথিবীর শীতলতম মহাদেশ। উষ্ণ উপকূলীয় অঞ্চল বাদ দিলে অ্যান্টার্কটিকার গড় তাপ শূন্যের নিচে ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়।
আলমিরান্টের ব্রাউন ছেড়ে আমরা জাহাজে ফেরত এলে জাহাজ আবার দক্ষিণ দিকে রওনা হলো। সারা রাত দক্ষিণমুখী চলার পর জাহাজ পিটারম্যান দ্বীপে পৌঁছাবে।
জানুয়ারি ২৬, ১৯৯৭: সকালে আমাদের জাহাজ পিটারম্যান দ্বীপের কাছে পৌঁছে গেল। দ্বীপটি পৃথিবীর ৬৫.১১ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থিত। এই দ্বীপের আবহাওয়া আমাদের প্রতি খুব সদয় বলে মনে হয় না। চারদিকে অন্তহীন সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, বাতাসের বেগ রেকর্ড করা হয়েছে। এখানকার 'এ্যাডেলি' উপক'লে প্রায় সর্বক্ষণ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইতে থাকে এবং মাঝে মাঝে বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এই শতাব্দীর প্রথম দশকে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কেন্দ্রে ভৌগলিক দক্ষিণ মেরু বিজয়ের অনেক উদ্যোগ আর প্রতিযোগিতা হয়েছিল। এই উদ্যোগের নেতৃত্বদানকারী বহু বীর ক্যাটাব্যাটিক উইন্ড নামের এই উত্তাল বাতাসের কবলে পড়ে নিহত হয়েছিলেন। অ্যান্টার্কটিকায় সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নরওয়ের নাবিক রোঅল্ড অ্যামান্ডসেন আর যুক্তরাজ্যের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফালকন স্কট। দুজনেই তাঁদের দল নিয়ে এই দুর্গমতম মহাদেশের কেন্দ্রে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। দুজনেরই লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ মেরুতে 'প্রথম মানুষ' হবার। বহু বিপর্যয়, সঙ্গীদের মৃত্যু ও অন্যান্য দুর্ঘটনা মোকাবিলার করার পর ক্যাপ্টেন স্কট মেরুতে পৌঁছে দেখলেন, সেখানে নরওয়ের পতাকা উড়ছে। অ্যামান্ডসেন তাঁর কয়েক দিন আগেই দক্ষিণ মেরু বিজয় করেছেন। দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে স্কট একটি চিঠি পেলেন। মেরু বিজয় করার পর অ্যামান্ডসেন চিঠিটি লিখেছিলেন স্কটের উদ্দেশে। মেরু বিজয় করতে পারলেও সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবেন, এমনটা তো নিশ্চিত ছিল না। প্রত্যাবর্তনের পথে মৃত্যুবরণ করলে পৃথিবীতে কেউ তাঁর মেরু বিজয়ের কথা জানতে পারত না। তাই অ্যামান্ডসেন তাঁর চিঠিতে স্কটকে সে সংবাদ পৃথিবীতে পৌঁছে দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আশা ছিল তাঁদের দুজনের একজন অন্তত মরু বিজয় করে জীবিত ফিরতে পারবেন।

ক্যাপ্টেন স্কট দক্ষিণ মেরুতে যুক্তরাজ্যের পতাকা রেখে অ্যামান্ডসেনের চিঠি সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রত্যাবর্তন শুরু করেন। প্রত্যাবর্তনের পথে ভয়াবহ 'ক্যাটাব্যাটিক উইন্ড'-এর কবলে পড়েন এবং প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষিণ মেরু বিজয়ী হয়ে জীবিত ফিরলেও অ্যামান্ডসেনও বরফের কোলেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২৮ সালে উত্তর মেরুতে একটি অভিযাত্রী দলের দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের উদ্ধারকাজে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন।
আমরা সকল নয়টায় ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে পিটারম্যান দ্বীপে নেমে আমাদের খুদে অভিযান শুরু করলাম। আমাদের উদ্দেশ্য হলো এই দ্বীপের লক্ষ লক্ষ পেঙ্গুইনের প্রজনন-কলোনি দেখা। আরও দক্ষিণে অবস্থিত বলে পিটারম্যান দ্বীপের পেঙ্গুইন আর আইচো দ্বীপের পেঙ্গুইনের প্রজননকালের পার্থক্য রয়েছে। পিটারম্যান দ্বীপের পেঙ্গুইন-কলোনি অপেক্ষাকৃত কম সময় বরফমুক্ত থাকে। এখানকার পেঙ্গুইনদের তাই সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতাটা প্রখরতর।
বেলা বারোটায় আমরা অভিযান শেষ করে দুপুরের আহারের জন্য জাহাজে ফিরে এলাম। পিটারম্যান দ্বীপেই আমাদের দীর্ঘ দক্ষিণমুখী যাত্রার সমাপ্তি হলো। এখান থেকে জাহাজ উত্তর-পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করবে। আমাদের গন্তব্যস্থল হলো পোর্ট লকরয়।
বেলা পাঁচটায় পোর্ট লকরয়-এ এসে আবার আমরা পেঙ্গুইন-কলোনি দেখতে বরফে নামলাম। পেঙ্গুইনের ব্যস্ততার শেষ নেই; ওদের দেখার জন্য আমাদের আগ্রহেরও শেষ নেই। কিন্তু একসময় আমাদের জাহাজে ফিরতেই হলো। আমাদের জাহাজ চলল উত্তর-পূর্ব দিকে।
জানুয়ারি ২৭, ১৯৯৭: সকাল আটটায় জাহাজ দক্ষিণ শেটল্যান্ডের 'লিভিংস্টোন' দ্বীপের কাছে নোঙর করল। জীববৈচিত্র্যের জন্য লিভিংস্টোন দ্বীপটি বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এখানে আমরা প্রথম 'ম্যাকারনি' পেঙ্গুইন দেখতে পেলাম। অনেক জায়ান্ট পেট্রেল এখানে নুড়ি দিয়ে বাসা বানিয়ে ফুটফুটে বাচ্চা লালনপালন করছে। অগুনতি এলিফ্যান্ট সিল বরফমুক্ত সমুদ্রসৈকতে দিবানিদ্রা দিচ্ছে। অকিঞ্চিৎকর বালুকাবেলায় ডিম পেড়ে তা দিচ্ছে 'অ্যান্টার্কটিক টার্ন'।
বেলা একটায় লিভিংস্টোন দ্বীপ ত্যাগ করে আমাদের জাহাজ দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের অন্য আরেকটি দ্বীপের দিকে যাত্রা করল। এই দ্বীপটির নাম 'ডিসেপশন আইল্যান্ড' বা 'প্রবঞ্চনা দ্বীপ'। বেলা তিনটার দিকে জাহাজ ওই দ্বীপের কাছে পৌঁছাল। দ্বীপটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। গোলাকার শৃঙ্গের একটা ছোট ফাটল দিয়ে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে ঢুকে গেছে সমুদ্রের পানি। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে নিস্তরঙ্গ পানির চমৎকার একটা গোলাকার পোতাশ্রয়। কিন্তু অগ্নিগিরির ভেতরের এই হ্রদে প্রবেশের পথটা বাইরের সমুদ্র থেকে দৃষ্টিগোচর নয়। এর ফলে বহুদিন ধরে এটা নাবিকদের অজানা ছিল। তাই এর নাম 'প্রবঞ্চনা দ্বীপ'। আমাদের জাহাজ অগ্নিগিরির ভেতরে ঢুকে এর গোলাকার হৃদের স্থির পানিতে নোঙর করল। আমরা জোডিয়াকে চড়ে তীরে গিয়ে শৃঙ্গের গায়ে জমা শুকনো লাভার ভেতর দিয়ে আরোহণ শুরু করলাম। আরোহণের উদ্দেশ্য ছিল শৃঙ্গের গায়ে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে 'পেইন্টেড পেট্রেল' আর 'উইলসন্স স্টর্ম-পেট্রেলের' বাসা দেখা।
জাহাজ প্রবঞ্চনা দ্বীপের এই গুপ্ত সাগর থেকে বারিয়ে এসে ব্রান্সফিল্ড প্রণালি দিয়ে পূর্ব দিকে যাত্রা করল। সারা রাত চলার পর আগামীকাল জাহাজ অ্যান্টার্কটিক সাউন্ড নামের প্রণালিতে প্রবেশ করবে।
জানুয়ারি ২৮, ১৯৯৭: আমাদের জাহাজ 'ঈরেবাস অ্যান্ড টেরর গালফ' নামের উপসাগরে এল। বেলা নয়টার সময় ঈরেবাস অ্যান্ড টেরর উপসাগরের একটা দ্বীপের কাছে জাহাজ নোঙর করল। দ্বীপটির নাম 'ডেভিল আইল্যান্ড', অর্থাৎ শয়তান দ্বীপ। দ্বীপের পাহাড়ে আরোহণ শুরু করলাম। পাহাড়ের গায়ে দুই লাখ এ্যাডেলি পেঙ্গুইনের প্রজনন-কলোনি দেখার জন্যই এই অভিযান।
চমৎকার আবহাওয়া এই শয়তান দ্বীপে। আকাশ থেকে ঝরঝর ধারায় বরফ পড়ছে। বাতাস নেই, তাই ঠান্ডাও তেমন নেই। সদ্য জমা বরফের ভেতর পাহাড়ে আরোহণ করাটা আমাদের জন্য উদ্দীপনাময় এক অভিজ্ঞতা। খুদে খুদে পা ফেলে আমাদের পাশাপাশি পাহাড়ে আরোহণ করছে পেঙ্গুইনের দল। এদের প্রজননের কাজ শেষ হয়েছে। ছানারা বড় হয়ে সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। পেঙ্গুইন পিতামাতা এখন পাহাড়ে উঠে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নিরম্বু শুয়ে থাকবে। সেখানে তাদের পুরোনো পালক ঝরে গিয়ে নতুন পালক গজিয়ে উঠলে তবে তারা সমুদ্রে ফিরতে পারবে।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আমার ঈরেবাস অ্যান্ড টেরর উপসাগরে নোঙর করা আমাদের জাহাজটিকে কোথাও দেখতে পেলাম না। এতে অবশ্য আমাদের মধ্যে কোনো আশঙ্কা দেখা দিল না। সর্বক্ষণ বরফ পড়ছে বলে চারদিক হোয়াইট আউট হয়ে গেছে। দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। সবকিছু সাদা পর্দার আড়ালে। বেলা এগারোটায় আমরা শয়তান দ্বীপ ত্যাগ করে জাহাজে ফিরে এলাম। দ্বীপে কেউ শয়তানের দেখা পেয়েছে এমন কথা শোনা গেল না। একজন যাত্রী রসিকতা করে বললেন, 'শয়তান অ্যান্টার্কটিকার চেয়ে জনবহুল মহাদেশগুলোতে ব্যস্ত আছে।'
জাহাজ উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জাহাজ বেশি দূর এগোতে পারল না। 'প্যাক আইসে' জাহাজের এগোনোর পথ বন্ধ। অ্যান্টার্কটিকার প্যাক আইসের সাথে কোনো ভদ্র জাহাজ লড়াই করবে না। আমাদের জাহাজ সামনে এগোবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে ঘুরে পূর্ব দিকে রওনা হলো।
অ্যান্টার্কটিকায় সবকিছু পরিকল্পনামতো চলে না। হিমবাহ আর ভাসমান বরফ প্রায়ই পরিকল্পনা বানচাল করে। নতুন পথে এসে আমাদের অবশ্য লাভই হলো। আমাদের তিন তিনটা 'কিলার হোয়েলের' দুটো দলের সাক্ষাৎ পেলাম। কিলার হোয়েল বা খুনি তিমি, এই অসম্মানজনক নামটা দেওয়া হয়েছে হয়তো এর খাদ্যাভাসের কারণে। অন্যান্য প্রজাতির তিমির মতো খুদে চিংড়ি খেয়ে এরা জীবনধারণ করে না। এরা সিল ও পেঙ্গুইনের মতো বড় বড় জীব আহার করতে অভ্যস্ত। তবে কখনো মানুষখেকো কিলার হোয়েলের কথা শোনা যায়নি।
জানুয়ারি ২৯, ১৯৯৭: সকালে জাহাজ 'অ্যান্টার্কটিক-সাইন্ডে' প্রবেশ করে 'ব্রাউন-ব্লাফ' উপকূলে এল। সকাল ছয়টায় আমরা ডাঙায় নামলাম। দশ লাখ সদ্য বেড়ে ওঠা পেঙ্গুইনের বাসস্থান কলকাকলিময় এক উপক'ল। দেখলাম শত শত সদ্য বেড়ে ওঠা পেঙ্গুইনছানা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের পাড়ে। ছানাদের ভিড় তীরে বেড়েই চলছে। একসময় সমুদ্রের অপ্রতিরোধ্য আহ্বানে সাড়া দিয়ে কয়েকটি তরুণ হঠাৎ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অমনি পাড় ভেঙে পড়ার মতো বাকি সব নবীন পেঙ্গুইন পানিতে পড়তে থাকল।
জাহাজ পূর্ব দিকে 'পলেট' দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হলো। প্রত্যেকে একটা বিশাল ব্রেকফাস্ট খেয়ে সারা দিন পলেট দ্বীপে হাঁটার জন্য প্রস্তুত হলাম। বেলা এগারোটায় জাহাজ পলেট দ্বীপে পৌঁছাল। পলেট উপক'ল ভাসমান বরফের টুকরোয় সম্পূর্ণ আবৃত। এখানকার সৈকতে পানি নয়, বরং সহস্র বরফের টুকরো আছড়ে পড়ে। বরফে-ভ'মিতে এই সংঘর্ষের মধ্যে একটুও আঘাত না পেয়ে শত শত পেঙ্গুইন অবিশ্বাস্য দক্ষতার সঙ্গে সমুদ্রে ওঠানামা করছে। পলেট উপকূলে ভাসমান বরফের বিশাল ভাস্কর্যকর্ম রয়েছে। ভাসমান হিমবাহ কেটে, বায়ু আর স্রোতের যৌথ প্রচেষ্টায় এই ভাস্কর্য সৃষ্টি হয়েছে।
দিন শেষে আমরা জাহাজে ফিরলাম। জাহাজ চলবে সারা রাত; যাবে 'এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড' অর্থাৎ ঐরাবতী দ্বীপে; অ্যান্টার্কটিকার সব চেয়ে উত্তরের দ্বীপ।
জানুয়ারি ৩০, ১৯৯৭: সকাল ছয়টায় জাহাজ এলিফ্যান্ট দ্বীপের উত্তরে নোঙর করল। দ্বীপের এই অঞ্চলের নাম 'পয়েন্ট ওয়াইল্ড'। এখানে সমুদ্র খুব অশান্ত। আমরা জাহাজ ছেড়ে জোডিয়াকে চড়ে দ্বীপের দিকে এগিয়ে গেলাম। খাড়া পাহাড় সমুদ্র থেকে উঠে গেছে। ১৯১৫ সালে অ্যান্টার্কটিকায় অভিযানকারী ক্যাপ্টেন শ্যাকলটনের জাহাজ 'এনডিউরেন্স' বিধ্বস্ত হবার পর ভাসমান বরফে চড়ে অভিযাত্রীরা এই সাগরে ভেসে বেড়িয়েছেন বহুদিন। কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ৮০০ মাইল উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে ক্যাপ্টেন শ্যাকলটন পৌঁছে যান দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে। এই ব্যর্থ অভিযানের পর শ্যাকলটন আবার অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে আসেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অভিযানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ঐতিহাসিক 'পয়েন্ট ওয়াইল্ড' দেখে আমরা জাহাজে ফিরে এলাম। সকাল সাতটায় জাহাজ অ্যান্টার্কটিকা পিছনে ফেলে ড্রেক-প্যাসেজ দিয়ে উত্তর দিকে যাত্রা করল। কয়েক দিনে অ্যান্টার্কটিকার সাথে আমাদের অনেক সখ্য গড়ে উঠেছে। বিদায়টা তাই কিছুটা বেদনাদায়ক হলো।
এরপর দুদিন-দুরাত্রি ধরে জাহাজ ড্রেক-প্যাসেজ অতিক্রম করেছে। ড্রেক-প্যাসেজে আবার আমাদের অতি আকাক্সিক্ষত ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মিলল। পানির কাছাকাছি অনেক প্রায়ন পাখির আনাগোনা চলছে। পাখি দর্শকদের জন্য ড্রেক-প্যাসেজ কোনো দিনই একঘেয়ে হবে না। তবে আমাদের তিমিপ্রেমী বন্ধুদের ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। দুরবিন দিয়ে আদিগন্ত তালাশ চালানোর পর অনেকেই মলিন মুখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন; তিমির দেখা মিলল না।
রাত্রে সমুদ্র ভয়ংকর হয়ে উঠল। কিন্তু সাহস করে শুয়ে পড়লাম। সারা দিন ডেকে পাখির জন্য ছুটোছুটির ক্লান্তিটা সমুদ্রপীড়ার ভয়কে হার মানাল। হাতড়ে দেখলাম সমুদ্রপীড়া প্রতিরোধের বড়ি এখনো রয়েছে পকেটে। নিঃসন্দেহে খুব কার্যকর ওষুধ; পকেটে থেকেও দিব্বি কাজ দিচ্ছে। আমার সৌভাগ্য, জীবনের প্রথম সমুদ্রভ্রমণে এসে একমুহূর্তের জন্যও অসুস্থ হইনি।
শোয়ার সাথে সাথেই জাহাজের উদ্দামতাকে তুচ্ছ করে এল গভীর ঘুম। তবে জাহাজও এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। মাঝরাতে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে জেগে গেলাম। দেখি মেঝেতে পড়ে আছি। জাহাজ আগের মতোই মাতাল হয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। হার না মেনে তখনই আবার বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পড়লাম।
জানুয়ারি ১, ১৯৯৭: সকাল সাতটায় জাহাজ 'ফকল্যান্ড' দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমে নোঙর করল। আমরা নিউ আইল্যান্ড নামের একটা দ্বীপের দিকে জোডিয়াকে চড়ে রওনা হলাম। দ্বীপের বালুময় সৈকতে শত শত ম্যাজেলানিক পেঙ্গুইন দাঁড়িয়ে আছে; যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। দ্বীপের বিশাল প্রান্তর লম্বা ঘাসে ঢাকা। দশ দিন পর এই প্রথম আমাদের সবুজ কিছু চোখে পড়ল। ঘাস যে চোখে এত সুন্দর লাগে, তা এই প্রথম বুঝতে পারলাম। সৈকতে ডানাহীন হাঁসের দল উত্তাপহীন রোদে বসে আছে। এই শত্রুহীন জগতে কোটি বছর ধরে ডানার ব্যবহার না করার ফলেই এদের এখন ডানা নেই।
পাহাড় বেয়ে কিছু দূর যাবার পর বসলাম একটু জিরিয়ে নিতে। অমনি একটা 'টাসোক-পাখি' এসে বসল আমাদের পায়ের ওপর। দেখতে থাকল আমাদের মনোযোগ দিয়ে। আমি যেন তার অনেক দিনের চেনা মানুষ। মানুষের হাতে কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মানুষকে শত্রু ভেবে এড়িয়ে চলতে শেখেনি এরা এখনো।
নিউ আইল্যান্ড দ্বীপের মালিক এবং বাসিন্দা হলেন মাত্র দুজন মানুষ। টনি চ্যাটার এবং ইয়েন স্ট্রেঞ্জ। এই দুজন প্রকৃতিপ্রেমী এই দ্বীপে বাস করেন; ফকল্যান্ড নিয়ে বই লেখেন আর ছবি আঁকেন। দুই মাস পরপর হেলিকপ্টার আসে এবং তাঁদের জন্যে রসদ দিয়ে যায়। দ্বীপের লাখ লাখ বন্য প্রাণীই তাঁদের প্রতিবেশী। টনি হাত নেড়ে ও শিস দিয়ে বিশাল বুনো স্কুয়া পাখি আমাদের সামনে এনে হাজির করলেন। আমাদের পাখিপ্রেমী বন্ধুরা এটা ভালো চোখে দেখলেন না। বন্য প্রাণীকে তাঁরা কোনো মানুষের তাঁবেদার হতে দেখতে চান না।
ফকল্যান্ড দ্বীপে আসার দুদিন আগেই আমরা অ্যান্টার্কটিকা ছেড়ে এসেছি। কিন্তু চারদিকে একই পরিবেশ আর একই ধরনের প্রাণী ছিল। তাই অ্যান্টার্কটিকা থেকে যে আমরা দূরে চলে এসেছি, সেটা বোঝা যায়নি। ফকল্যান্ড ছেড়ে যাবার আয়োজন করতে গিয়ে বারবার মন বলতে লাগল–বিদায় অ্যান্টার্কটিকা, বিদায়। মন খারাপ হয়ে গেল। বিদায় নিচ্ছি, কিন্তু পৃথিবীর শেষ প্রান্তে নীরবে অপেক্ষমাণ এই শুভ্র, সুন্দর, ভয়ংকর মহাদেশটা যেমন অজ্ঞাত ছিল, তেমন অজ্ঞতাই থেকে গেল। সেখানে কয়েক দিনের পদচারণ আর কয়েক শ রঙিন ছবি এই অপরূপ, অবিশ্বাস্য মহাদেশের রহস্যময় আবরণের সহস্রাংশও উন্মোচিত করতে পারবে না। আমার জন্য অ্যান্টার্কটিকার আকর্ষণ এখানে আসার আগে যেমন শক্তিশালী ছিল, তেমনই রয়ে গেছে।
ল্যারি বিদায় জানাতে এলেন। তিনি এখন থেকে জাহাজে করে দক্ষিণ আমেরিকা যাবেন। জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনাকে এত বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন?' বললাম, 'মনে হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকায় অতি প্রিয়জন কাউকে যেন চিরতরে ছেড়ে যাচ্ছি। আপনি বারবার অ্যান্টার্কটিকায় ফিরে আসেন তো, আপনি আমার এখানকার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারবেন না।' ল্যারি বললেন, 'চিয়ার আপ ইনাম, অ্যান্টার্কটিকার সাথে কোনো মানুষের সম্পর্কই স্থায়ী নয়। আমরা তার শুভ্র আচ্ছাদনের প্রান্তটুকু শুধু ছুঁয়ে যেতে পারি দু-একবার।'
ছবি: লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত