ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না এমন ব্যাংকগুলোকে মার্জারের আওতায় আনা হবে: আহসান এইচ মনসুর

দুর্বল যেসব ব্যাংক একা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না— তাদের একীভূতকরণের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। এছাড়া, ইসলামী ব্যাংকের ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এটি ভালো করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন গভর্নর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএসের স্পেশাল করেসপনডেন্ট জেবুন নেসা আলো ও স্টাফ করেসপনডেন্ট সাখাওয়াত প্রিন্স।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের আর্থিকখাতে যেসব ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে— তার প্রেক্ষাপটে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দায়িত্ব নিতে হয় আহসান এইচ মনসুরকে।
তার নেতৃত্বে এক বছরের কাছাকাছি সময়ে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে কতটা অগ্রগতি হয়েছে— সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নেওয়া হয় এই সাক্ষাৎকার। যার নির্বাচিত অংশ এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
ব্যাংকের সম্পদমান যাচাইয়ে ছয়টি ব্যাংক নিয়ে কাজ হয়েছে। কিছু ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করার কথা বলা হয়েছে। এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, "আমরা দেখেছি, যারা একলা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না—তাদের মার্জারের আওতায় নিয়ে আসব। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমরা দেখছি কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যেমন ইসলামী ব্যাংক—এটা ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশাবাদী, এটি ভালো করবে। এছাড়া ইউসিবি ব্যাংকও ঘুরে দাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক আছে, যাদের এনপিএল (মন্দ বা খেলাপি ঋণ) ৭০ -৯০ শতাংশ এমনকি ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। জনগণের আমানতের নিরাপত্তার স্বার্থে, আমরা তাদেরকে মার্জারের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছি, এই ব্যাংকগুলোকে আপাতত সরকারিকরণ করা হবে।
"এই ব্যাংকগুলোকে মার্জার করার পর কিছুদিন সরকারি ব্যাংক হিসেবে চালানো হবে। পরে সেটিকে বেসরকারি খাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী সেখানে অংশ নেবেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার কিনতে পারবেন। এভাবে ব্যাংকগুলো পুনর্গঠন হবে"- যোগ করেন তিনি।
মার্জার প্রক্রিয়ায় সরকারের কত টাকা বিনিয়োগ হতে পারে— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঠিক কত টাকা লাগবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা হিসাব করছি। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ব্যাংকের পুনর্গঠন করতে গেলে প্রথম দফায় ১৫ - ২০ হাজার কোটি টাকা লেগে যাবে। পরে ধাপে ধাপে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। সরকার প্রথমে বিনিয়োগ করবে, পরে বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যাংকটি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
গভর্নর জানান, "এজন্য ফান্ড বা তহবিলটা প্রধানত সরকারের দিক থেকে আসবে। বাজেট থেকে আসতে পারে। হয়তো এটা বন্ড আকারে আসবে, রিক্যাপিটালাইজেশন ফান্ড হিসেবে। প্রথম দিকে সরকার ইন্টারেস্ট দেবে, আর আসল টাকা থাকবে বন্ড আকারে। এই ফান্ড ব্যাংকের ক্যাপিটাল বেসকে (মূলধন ভিত্তিকে) শক্তিশালী করবে।
পরবর্তীতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেবো, তখন কিছুটা শেয়ার আমরা পুঁজিবাজারে ছেড়ে দেব। সেখান থেকে যে অর্থ আসবে, তা আবার ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটালাইজেশনে ব্যবহার হবে।"
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী এসে ১০০ শতাংশ মালিকানা নিতে চায়, আমি ব্যক্তিগতভাবে সেক্ষেত্রে কোনো আপত্তি দেখি না। আমরা চাই তারা যেন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে আসে। তাদের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, এবং আন্তর্জাতিক ভালো প্র্যাকটিসগুলো আমাদের ব্যাংকে চালু করতে হবে। এ ধরনের বিনিয়োগ আমরা স্বাগত জানাই।
আপনারা কি নিশ্চিত যে এই শেয়ারগুলো বিক্রি করা সম্ভব হবে? বা আসলেই কি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসবেন? এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, আমরা এখনো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। কংক্রিট কোনো প্রস্তাব অবশ্য এখনও আসেনি, কারণ আমাদের মার্জার প্রক্রিয়া তো শেষ হয়নি।
"মার্জার হয়ে যাওয়ার পর, হয়তো ছয় মাস পরে এগুলোকে বাজারে নেওয়া হবে। আমরা ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগের কথা ভাবছি—যারা এই ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রেজেন্ট করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই অ্যাডভাইজার সিলেক্ট করবে।"
মনসুর বলেন, আমরা প্রতিটি ব্যাংকের জন্য আলাদা করে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিতে পারি। উদাহরণ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের কথা বলি—ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের একটি বড় অংশ এস আলম গ্রুপের কাছে। তাদের কাছে সরকারের দাবির বিপরীতে যদি ১০– ২০ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যায় (শেয়ারমুল্যের ওপর নির্ভর করে), তবে সেই শেয়ারগুলোও অফলোড করা হবে। এভাবে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার পাওয়া সহজ হবে। ইতিমধ্যে কিছু ইন্টারেস্টও আমরা দেখতে পাচ্ছি।