তাপসের সঙ্গে ফোনালাপ: আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

আল জাজিরার হাতে আসা গোপন ফোন রেকর্ডিংয়ে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর তার সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের ওপর 'প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার' এবং 'যেখানে তাদের পাওয়া যাবে, সেখানেই গুলি করার' জন্য একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়নের মধ্যে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে, আন্দোলনে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত এবং ২০,০০০ জন আহত হন।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট (আই-ইউনিট) শেখ হাসিনার বেশ কয়েকটি গোপন ফোনালাপের অডিও রেকর্ডিং হাতে পেয়েছে, যেগুলোতে এই নির্দেশের প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ১৮ জুলাই একটি ফোনালাপ রেকর্ড করে। ওই ফোনকলে শেখ হাসিনা তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে বলেন, 'আমার নির্দেশ ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে। আমি সরাসরি নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এটাই আমি বলেছি। আমি এতদিন তাদের থামিয়ে রেখেছিলাম … আমি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছিলাম।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং শেখ হাসিনার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনালাপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করা হচ্ছে।
'যেখানেই তারা কোনো সমাবেশ দেখবে, সেটা উপর থেকে – এখন উপর থেকে করা হচ্ছে – এটা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি জায়গায় শুরু হয়ে গেছে। এটা শুরু হয়েছে। কিছু [বিক্ষোভকারী] সরে গেছে।'
যদিও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছিল, তবে রাজধানীর পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরীফ আল জাজিরাকে জানান, তাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, আহত শিক্ষার্থীদের শরীরে অস্বাভাবিক ধরনের গুলির ক্ষত ছিল।
তিনি বলেন, 'গুলিগুলো কাঁধ বা বুকে ঢুকেছিল এবং শরীরের ভেতরেই থেকে গিয়েছিল। তখন এমন অনেক ধরনের রোগী পাচ্ছিলাম। যখন এক্স-রে করতাম, দেখে অবাক হতাম, কারণ গুলিগুলো ছিল খুব বড়।'
কী ধরনের বুলেট ব্যবহার করা হয়েছিল তা যাচাই করতে পারেনি আল জাজিরা।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এই ফোনালাপগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা, তার কয়েকজন মন্ত্রী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। হাসিনা ও আরও দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়। আগামী আগস্টে বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা আছে।
আগে থেকেই অভিযোগ ছিল যে, শেখ হাসিনার গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত এনটিএমসি শুধু বিরোধীদলীয় নেতাদের নয়, তার মিত্রদেরও নজরদারিতে রাখতো।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানতেন যে তার কথোপকথন রেকর্ড করা হচ্ছে।'
"কখনও কখনও অপরপক্ষ বলত, 'এই কথা ফোনে না বলাই ভালো।' তখন প্রধানমন্ত্রী বলতেন, 'হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি, এটা রেকর্ড হচ্ছে, সমস্যা নেই।'"
তিনি বলেন, 'তিনি অন্যদের জন্য গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন তিনি নিজেই সেই গর্তে।'
২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য পুনরায় কোটা ব্যবস্থা চালু করলে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন যে এই ব্যবস্থা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সমর্থকদের অনুকূলে ছিল এবং এতে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ ক্ষুণ্ন হয়।
এই আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় ১৬ জুলাই, যখন রংপুরে পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন। তার মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।
আল জাজিরার হাতে পাওয়া একটি গোপন ফোনালাপে শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে শোনা যায় আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রশ্ন করেন, 'ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসতে এত দেরি কেন হচ্ছে? লুকোচুরি করছে কে? রংপুর মেডিকেল?'
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম আল জাজিরাকে জানান, পুলিশ তাকে পাঁচবার রিপোর্ট পরিবর্তন করতে বাধ্য করে যাতে একাধিক গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি না থাকে।
'তারা চেয়েছিল রিপোর্টে লেখা হোক যে আবু সাঈদ ভাই পাথর ছোড়ার আঘাতে মারা গেছেন … অথচ তিনি পুলিশের গুলিতেই মারা যান,' বলেন তিনি।
সাঈদের মৃত্যুর ১২ দিন পর তার পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হাজির করানোর জন্য। সেখানে প্রায় ৪০টি পরিবার ছিল, যাদের স্বজনরা আন্দোলনে নিহত হয়েছেন।
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, 'আমাদের জোর করে গণভবনে আনা হয়েছিল। না আসলে হয়তো অন্যভাবে নির্যাতন করত।'
টিভি ক্যামেরার সামনে শেখ হাসিনা প্রত্যেক পরিবারকে টাকা দেন। সাঈদের বোন সুমি খাতুনকে তিনি বলেন, 'তোমাদের পরিবারকে ন্যায়বিচার দেওয়া হবে।'
জবাবে সুমি খাতুন বলেন, 'ভিডিওতে তো দেখা গেছে পুলিশ গুলি করেছে। এখানে তদন্ত করার কী আছে? এখানে আসাটাই ভুল ছিল।'
আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো 'প্রাণঘাতী অস্ত্র' ব্যবহারের নির্দেশ দেননি, এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর জন্য সুনির্দিষ্টভাবে অনুমোদনও দেননি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'এই ফোনালাপ হয় আংশিকভাবে কাটা, অথবা বিকৃত, অথবা উভয়ই।' বিবৃতিতে তারা বলেন, আবু সাঈদের মৃত্যুর তদন্ত নিয়ে সরকার 'গুরুত্বসহকারে চেষ্টা চালিয়েছে'।