নিদ্রাহারা রাতের এ গান

এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি:
শুনেছি ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে উপাদেয়–শিশুমনের বিশ্বাস, সরল-গভীর-নিঃসংশয়। মানুষের কাছে নিশ্চয়ই সবচেয়ে উপাদেয়–শিশুর মতো ঘুম, প্রগাঢ়-নিরবচ্ছিন্ন-অফুরন্ত। ছোট্টবেলায় ছড়ায় বাগদীদের ছেলে ঘুমাত জালমুড়ি দিয়ে, সন্ধ্যারাতেই সিলিং থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকতো ঘুম, তালে তালে পিঠে চাপড় খেতাম আর শুনতাম–ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো; বুঝতে পারতাম না অত উৎকোচ দিয়ে কেন এদের আনতে হবে। ঘুম তো আপনিই আসে, 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই' কেবল কবির কল্পনা।
তারপর একদিন স্থাপত্যের পড়ালেখা করতে গিয়ে দিবারাত্র জেগে থাকতে বাধ্য হলাম, কখনো টানা তিন-চার রাত। গ্রুপ প্রজেক্টের জমার আগের রাতে কোনো বন্ধুর বাড়িতে সদলবলে ঢুকতে ঢুকতে দেখতাম–বাড়ির দারোয়ান ভাইয়ের কেরোসিনের স্টোভে ভাত ফুটছে, রেডিওতে বাজছে সিনেমার গান, আয়োজন করে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন তিনি। আমরা সারা রাত ড্রাফটিং করে কাটাব, ভোরের আজানে সচকিত হয়ে চেয়ে দেখব নিদ্রাহারা পরিশ্রমের নিরর্থকতা। ভাবতাম পাশ করি, জীবনে আর বিনিদ্র রাত জাগব না, খোদার কসম! কিটস যখন লে হান্টের কটেজে ঘুমের প্রশস্তি রচনা করেছিলেন, আমি সহমত ছিলাম। কে জানত, নদীর জলে অগাধ বালি ঢুকবার মতো ঘুমের ভিতর ঢোকে জীবনময় দুশ্চিন্তা! 'আমার জীবনে কোনো ঘুম নাই/ মৎস্যনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি/ এই নিদ্রা?' জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সবাইকেই বলতে হয়?
বুঝতেই পারছেন, আজ আলাপ করব নিদ্রা আর অনিদ্রা এই দুই সহোদরাকে নিয়ে।
জেগে আছে যারা
আমাদের সুদূর অতীতের পূর্বপুরুষদের কাছে ঘুম ছিল রহস্যময় ব্যাপার। দশ হাজার বছর ধরে মানুষ নাগরিক হয়েছে, নগরে বিজলিবাতি ঢুকেছে, গেল শতাব্দীতে এসেছে কম্পিউটার... আমাদের ঘুমের ছাঁচ ও ছন্দ শিকারি (হান্টার-গ্যাদারার) মানুষের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে ঘুমাত গাছে, গুহায়, ভূশয়নে। প্যালিওলিথিক ডায়েটের একটা বড় অংশ ছিল মাছ-মাংস, প্রোটিন ঘুমোতে সাহায্য করত। প্রচুর দৌড়ঝাঁপের কারণেও ঘুম আসত সহজে। 'হাউ টু স্লিপ লাইক আ কেভম্যান' গ্রন্থ থেকে হদিস মেলে–ঘুমের একপর্যায়ে এখনো যে আমরা উঁচু জায়গা থেকে ধুপ করে পড়ে যাচ্ছি এমন ভয়ে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠি–সেটা নাকি ঐ বৃক্ষবিহারী মানুষের বিপন্নতার স্মৃতি। আগুন আবিষ্কৃত হলো, মানুষ গাছ থেকে নেমে এল, রাতে শিকারি জন্তুকে তফাতে রেখে ঘুমটা সহজ হয়ে গেল।

আদিমতম শয্যার বয়স দুশো হাজার বছর, গুহার ভেতর ঘাস-খড়-ডালপালা-ছাই দিয়ে গড়া সেই বিছানা–তার ওপর পতঙ্গ-তাড়ানিয়া পাতার চাদর। মিথলজির ফিনিক্স পাখির মতো এই শয্যানীড়টিতে মানুষ প্রায়ই আগুন দিত, পুড়িয়ে আবার শয্যা পাতত। বিছানায় আদিম মানুষ শুধু শুত, তা নয়, সে ওখানে বসেই পাথরের অস্ত্রে শাণ দিত, শিকার করে আনা পশুর চামড়া থেকে রোম ছাড়াত, আর খাবার তৈরি করত। বিছানাতেই সে মিলিত হতো কি? উত্তর জানা নেই। মধ্য আফ্রিকার যাযাবর গোষ্ঠীর লোকদের ভিতর আদিম মানুষের জীবনযাপনের বহু লক্ষণ আজও দৃশ্যমান, মিলিত হবার জন্য এরা চলে যায় অন্য মানুষের দৃষ্টির আড়ালে, গহিন জঙ্গলে।
প্রাচীন রোমের অর্থশালী বাসিন্দাদের জীবনে শয্যার প্রকরণ ছিল বিচিত্র। জ্ঞানসাধনার, নববিবাহিত যুগলের, একত্রে বসে খাওয়াদাওয়া করার, ঘুমের, এমনকি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্যেও বরাদ্দ ছিল আলাদা খাট। পম্পেইয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায়, কাঠের ফ্রেমে দড়ির খাটিয়ায় চাদর পেতে শুত প্রাচীন পম্পেইয়ের ক্রীতদাসরা। গত শতাব্দীতে হাওয়ার্ড কার্টার যখন তুত-আঙ্খ-আমেনের সমাধিসৌধে ঢুকলেন, সেখানে আবিষ্কার করলেন ছয়টি খাট–নলখাগড়ায় বোনা কাঠের ফ্রেমের খাট, বালিশের বদলে শক্ত হেডরেস্ট/আরাম-তাকিয়া। গরম আবহাওয়ায় পোকার উৎপাত হতো বলে মিসরীয়রা নরম গদি-তোশক-তাকিয়া ব্যবহার করত না।
স্কারাব্রেতে আবিষ্কৃত হলো বেলেপাথরের খাটের বাজু, স্টোনহেঞ্জের কাছে মিলল কাঠের বাক্স-বিছানার খুরের চিহ্ন। মধ্যযুগের ইউরোপীয়রা পাইনকাঠের ওয়ার্ডরোব বা দুই দরজা দেয়া দেরাজের ভিতর ঘুমোত–এটাকে বলা হতো দেরাজ-বিছানা বা ক্লজেট বেড। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চাষাভুষো-মেছুনি এমনকি রাজরাজড়ারাও এমন দেরাজ-বিছানায় ঘুমোতেন। পার্ল বাকের 'দ্য গুড আর্থ'-এ আর হা জিনের উপন্যাস 'ওয়েটিং'-এ উত্তর চীনের ক্যাং-বেডের কথা পড়েছিলাম, ফার্নেসের ওপর ইটের বিছানা।
যাহাদের জীবনের জ্বর ছাড়িয়াছে
মধ্যযুগের কৃষিজীবীদের গল্পে আসি। প্রতি রাতে যারা কুঁড়েঘরে নিদ যেত এই আশায়, সকালে যেন সেদ্ধ শালগমের সুরুয়াটুকু খেতে পায়। চিমনিহীন ছোট্ট কুঁড়ের ভিতর রাতটা ভাবুন একবার। আগুন জ্বালানোর কারণে শ্বাসের কষ্ট, হিমে জমে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া অঙ্গ, গায়ে চড়ানো বদবুদার উলের টিউনিক–আর ভরসা এক ছাদের তলায় একত্রে থাকা পাখপাখালি আর গবাদি পশুর গায়ের তাপ। 'গোপনীয়তার নেই মালিকানা', একে অন্যের গায়ের উত্তাপ ভাগাভাগি করে পরবর্তী সকাল অবধি বেঁচে থাকা। যাদের শরীর গরম, তারা যাবে দেয়ালের দিকে। শিশু-বুড়ো-রোগীরা থাকবে বিছানার মাঝখানটায়। কুঁড়েঘরগুলোর দেয়াল বেতের মতো আড়াআড়ি বোনা, তাতে গোবর-খড়-মাটির আস্তর, ভেতরের দেয়ালে ভেড়ার চর্বি।

বরফিলা মেঝেয় পড়শির খেত থেকে চুরি করে আনা খড় পাতা, ওপরে নলখাগড়া। পুরু শনের ছাদ এক মৌসুমেই ফুটো হয়ে যেত, মস আর ন্যাকড়ায় বোঁজানো হতো। শীতের ঝোড়ো বাতাসে সেই কুঁড়ে কাঁপত। উনুন ঘিরে মানুষগুলো তাপ পোহাত, রাঁধত, গাইত, গল্প বলত। দেশলাই তো তখনো আসেনি, আগুন নিভে গেলে চকমকি ঠুকে জেরবার হতে হবে, ফলে আগুন জিইয়ে রাখাই ছিল সব্বার কাজ।
ঘুম কেন ভেঙে গেল তার
ভাইকিংদের নিদ্রা ছিল খণ্ডিত–প্রথম ঘুম দ্বিতীয় ঘুম। যাকে বলে বাইফেজিক স্লিপ। সূর্যাস্তের পর টানা কমিউনাল হলঘরে প্রথম ঘুমের শুরু, মধ্যরাতে জেগে উঠে শুকনো মাংস-বাসি স্টু-ধুমপক্ক মাছ খেত, পাহারা দিত, খুটখাট কাজ করত সাবধানে যেন ছাগল জেগে না ওঠে, আগুনে ছুড়ে দিত জ্বালানি কাঠ, চিন্তা করত–প্রথম ঘুমের স্বপ্ন নিয়ে খোশগল্পও। অনেকে শারীরিকভাবে মিলিত হতো, প্রার্থনা করত, কেউ খুন করতে বের হত। তারপর আবার ঘুমিয়ে যেত। প্রাক্-শিল্পবিপ্লব যুগের ইংরেজ-ফরাসি-ইতালীয়-আফ্রিকান-আমেরিকান-এশীয়-আরবরাও এমন করে রাত্রির দুই ভাগে ঘুমোত।
ভাইকিংদের কথায় ফেরত আসি। ওরা জানত বিপদ ঘুমোয় না, শত্রুও বিনিদ্র–শেষ রাতে যখন মানুষের ঘুম গভীরতম–তখনি আক্রমণ করবে তারা। ভাইকিং ভদ্রাসন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, দেয়ালগুলো পাতলা কাঠের, আগুন দিতে কতক্ষণ! তাই ঘুমের শিফট ছিল ভাইকিংদের। একদল ঘুমোবে, আরেক দল পাহারায় থাকবে–পাহারায় থেকে ঝিমিয়ে পড়লে মাথায় প্রস্রাব করে দেবে অন্য পাহারাদার। ভাইকিংদের ঘুম পাতলা, সন্দেহকাতর, ঘুমন্ত হাত কুঠারের হাতলে, ঘুমের কাপড় আলাদা হলে চলবে না–যেন জেগে উঠেই শত্রুর মোকাবিলা করতে পারে তারা। ভাইকিং জাহাজেও ঘুমোতে হতো কাঠের পাটাতনের ওপরে। সদাজাগরুক থাকাই ভাইকিং জীবনের গরিমা।
মৃত্যুর মতন শান্তি
প্রস্তর যুগে পাতা একটি বিছানা দক্ষিণ আফ্রিকায় আবিষ্কৃত হয়েছে, সাতাত্তর হাজার বছর আগের সেই শয্যার আকার দেখলে মনে হয়–আদিম মানুষ একত্রে শুত। সতের শতকের স্যামুয়েল পিপসের লেখা থেকে জানা যায়–অপরিচিত অনাত্মীয় মানুষের সঙ্গেও লোকে তখন বিছানা ভাগাভাগি করত, ছারপোকার কামড় খেতে খেতে গভীর রাত অবধি আলাপ করে সুখনিদ্রা যেত।
আঠারো শতকের এক হেমন্তে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ও জন অ্যাডামস শয্যাসঙ্গী, জানালা খোলা থাকবে নাকি বন্ধ এই নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে, ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন–খোলা জানালা দিয়ে আসা হিম লেগে লোকে অসুস্থ হয় না, অসুখ হয় বদ্ধ ঘরে পুঁতিবাষ্পের চক্র থেকে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাইবোন-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়পরিজন-চাকরবাকরকে নিয়ে কমিউনাল স্লিপ রীতিমতো স্বাভাবিক ছিল।

শীতের প্রকোপেই হোক, কি নিরাপত্ততার স্বার্থে। কে কার পাশে শোবে, সেটাও নির্দিষ্ট করা ছিল। বড় কন্যাটি শোবে দেয়াল ঘেঁষে, তারপর একে একে ছোট বোনেরা, মা, বাবা, বয়সানুক্রমে ভাইয়েরা, তারপর অতিথি–সে ফেরিওয়ালা-দরজি-ফকির যেই হোক না কেন। আগন্তুক যেন বাড়ির নারী সদস্যদের কাছ থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে শোয়। স্থানাভাব থাকলে বাড়ির নারী ও পুরুষ কাজের লোককে একত্রে শুতে হতো, অঘটনও ঘটত। একসঙ্গে বাতাস চলাচলহীন কক্ষে ঘুমোবার ফলে রোগবালাই-প্লেগের সংক্রমণও দ্রুত হতো।
তবে এসব সমাজবদ্ধ নিদ্রার কারণে সমাজে গভীর সংঘবদ্ধতা আর ঐক্য পরিলক্ষিত হতো। মধ্যযুগের কোনো ছবিতে বাইবেলের তিন ম্যাজাই (জ্ঞানী) একই বিছানায় শায়িত ছিলেন বলে দেখানো হয়েছে, এরা কোনো ছবিতে নগ্ন–চামচের মতো ধারণ করে আছেন অন্যকে–কিন্তু ছবিগুলো তাদের দেহজ কামের ইঙ্গিত নয়। যারা শৈশবে একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছে বা যাদের পরিবারে একাধিক পোষ্য থাকবার চল ছিল, তারা জানে একত্রে মেঝেয় বিছানা পেতে এই গণনিদ্রার কি সুমধুর স্মৃতি শিশুর থাকতে পারে। মধুতেই থাকলাম, গরলে এখন গেলাম না।
বিলেতের রাজা-রানি (ফিলিপ ও এলিজাবেথ) চিরদিন আলাদা কক্ষে আলাদা বিছানায় ঘুমোতেন, এখনো রাজপরিবারে এই চল রয়েছে। যদিও চিরকুমারী রানি প্রথম এলিজাবেথ তাঁর চুয়াল্লিশ বছরের শাসনকালে একরাত্রির জন্যেও একা ঘুমোননি, দাসদাসী-সই-সহচরীদের নিয়ে গল্পগুজব করতে করতে ঘুমোতেন তিনি। পশ্চিমে মায়েরা নবজাত শিশুকে পার করে দেয় কট-বেডে, শিশু কোনো অজানা কারণে ঘুমের ভিতর মরে যায়–এর নাম কট ডেথ। মানুষের ঘুমের ইতিহাস খুঁজে দেখলে দেখা যাবে–একা ঘুমোনোর ব্যাপারটা রীতিমতো অস্বাভাবিক। ঘুমের পারাবারেও সে মিত্র খোঁজে, খোঁজে সখা।
ঘুমের আমি ঘুমের তুমি
সুকুমার রায়ের 'জানোয়ারের ঘুম' শুরু হয়েছিল এভাবে–শীতকালে এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত শিষ্যবাড়ি গেছিলেন–পাড়াগাঁয়ে শীতের প্রকোপ কেমন হয় তিনি জানতেন না। শিষ্য যখন লেপ দিতে চাইল, তিনি বারণ করলেন। রাত্রে প্রতি যামে ঠান্ডা বেড়েই চলেছে, গুরুর দুরবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন শিষ্য–
'প্রথম প্রহরে প্রভু ঢেঁকি অবতার,
দ্বিতীয় প্রহরে প্রভু ধনুকে টঙ্কার
তৃতীয় প্রহরে প্রভু কুকুর কুণ্ডলী
চতুর্থ প্রহরে প্রভু বেনের পুঁটুলি।'

সুকুমার রায় শুনিয়েছিলেন–কেমন করে বক এক ঠ্যাঙে ভর দিয়ে দিব্য ঘুমোয়, একরকম চন্দনা বাদুড়ের মতো ঝুলতে ঝুলতে ঘুমোতে পারে, মেঘলা দিন দেখলে কাঠবেড়ালি কোটর খুঁজে তাতে ঘুম দেয়, শ্লথ কেমন অকাতরে ঘুমিয়ে জীবন পার করে। ছোট্টবেলায় কিপলিং 'দ্য জাঙ্গল বুক'-এ শোনালেন ঘুম-ঘুম দুষ্টু ভাল্লুক বালুর কথা। সোভিয়েত সাহিত্যের রমরমা কালে আমাদের হাতে পড়ল গালিনা দেমিকিনার 'বনের গান', শিখলাম ডরমাউসের শীতনিদ্রার কথা। আর জসীমউদ্দীন শেখালেন–'কত রবি জ্বলে রে, কে বা আঁখি মেলে রে'...দুই মহা অলস লোকের কিচ্ছা।
কত ঘুম ঘ্মুায় লোকে, রেম-নিদ্রা, মাইক্রো-নিদ্রা (রাতের ঘুম ভালো না হলে দিনের নানান সময়ে হঠাৎ সামান্য সময়ের নিদ্রাভাব), দিবানিদ্রা (সিয়েস্তা), যোগনিদ্রা। ঋতুভেদেও ঘুমের প্রকার আছে, শীতকালে লোকের ঘুম দরকার বেশি–গরমে কম। তা গরমদেশের লোকের দিবানিদ্রা নেবার স্বভাব রয়েছে, তারা সে কথা মানতে না-ই পারে। রূপকথাজুড়ে নারীরা ঘুমোয়, স্লিপিং বিউটি কিংবা কঙ্কাবতী। অথচ বিজ্ঞানীরা দেখছেন–পুরুষের ঘুম নারীর তুলনায় নিরবিচ্ছিন্ন ও গাঢ়। নারীর ঘুম সামাজিক-মানসিক-হরমোনাল উৎপাতে ছারখার। পরিজনের সুরক্ষার ভার তার কাঁধে বেশি। ইনসমনিয়া/অনিদ্রার সঙ্গে ডিপ্রেশনের যোগ প্রবল, নারীর ডিপ্রেশন পুরুষের চেয়ে বেশি, তাই ইনসমনিয়াতেও সে ভোগে বেশি।
স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির
পাঠ্যবইয়ে আমরা পড়েছিলাম মোহিতলাল মজুমদারের ছড়া 'ঘুম ভাঙানি'–'ফুটফুটে জোছনায়, জেগে শুনি বিছানায়, বনে কারা গান গায়'। কবিতায় ঘুমের ছড়াছড়ি, জাগরণেরও, এই যেমন 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'। বড় ক্লাসে উঠবার পর ফ্রস্টের–'অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ'। এডগার অ্যালেন পোর 'দ্য স্লিপার' মৃত্যু–উত্তীর্ণ প্রেমের কবিতা। উইলিয়াম ব্লেকের 'ক্রেডল সং' পড়েছি কলেজ লাইব্রেরিতে–'স্লিপ, স্লিপ; ইন দাই স্লিপ/ লিটল সরোজ সিট অ্যান্ড উইপ।' রবীন্দ্রনাথে যেমন–'ঘুমের আঁধার কোটরের তলে/ স্বপ্নপাখির বাসা,/ কুড়ায়ে এনেছে মুখর দিনের/ খসে-পড়া ভাঙা ভাষা।' ডি এইচ লরেন্সের কবিতায় ঘুম মৃত্যুসমা, স্বাদু বিস্মৃতি, অস্তিত্বসংকটের আরোগ্য। এমিলি ডিকিনসন যে ঘুমকে ডেকেছিলেন সময়হীনা, অন্তবিহীন। এলিজাবেথ বিশপ 'ইনসমনিয়া'তে লিখেছিলেন–পৃথিবী কেমন উল্টে যায়। বোর্হেসের প্রশ্ন সর্বজনীন–ঘুম যদি (মনের) যুদ্ধবিরতিই হয়, মন তবে জাগিয়ে দেয় কেন? কেন জাগৃতির সকাল এত বিষণ্ন্ন?

এখানে ঘুমের পাড়া
ঘুমের কথা হবে, অথচ 'রিপ ভ্যান উইংকল' ছোটগল্পের কথা হবে না, তা কি হয়! পাহাড়ে গিয়ে নেশা করে ঘুমিয়ে গেছিল সে, জেগে দ্যাখে কুড়ি বছর পার হয়ে গেছে। উনিশ শতকে ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বিপুল হয়ে ওঠে। কেউ ঘুমোয় প্রাসাদে, বাকিরা পথে। লন্ডনের চ্যারিটি-সংস্থাগুলো এক অদ্ভুত সমাধান নিয়ে এল–এক পেনির বিনিময়ে একটি উষ্ণ হলঘরের বেঞ্চিতে বসতে পারবে কিন্তু ঘুমোতে পারবে না। দুই পেনির 'হ্যাংওভার'–ঠাসাঠাসি করে বেঞ্চে বসে একটা মোটা দড়ির ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে শুতে পারবে–সকাল হলেই ভ্যালেট এসে দড়ি কেটে সবাইকে জাগিয়ে দেবে।
স্যালভেশন আর্মি নিয়ে এল 'ফোর পেনি কফিন', সারি সারি কফিন আকারের কাঠের বাক্স–তাতে চার পেনির বদলে গৃহহীন লোকে অয়েলক্লথ গায়ে দিয়ে ঘুমোতে পারবে। চার্লস ডিকেন্সের 'দ্য পিকউইক পেপারস' ও জর্জ অরওয়েলের 'ডাউন অ্যান্ড আউট ইন লন্ডন অ্যান্ড প্যারিস'-এ এসব সমাধানের কথা লেখা আছে। ১৮৫১ সালের উপন্যাস 'মবি ডিক'-এ আছে শয্যাভাগের সরল যুগ ফুরিয়ে আসার ইন্ধন, প্রধান চরিত্র ইশমায়েল সেরাতে স্পাউটার সরাইখানার একমাত্র শয্যাটি রহস্যময় এক তিমিশিকারির সঙ্গে ভাগ করে কাটাতে বাধ্য হয়।
স্কুলের লাইব্রেরিতে পেয়েছিলাম সচিত্র–'আ গোল্ডেন মিলেট ড্রিম'। দরিদ্র ছাত্র লু শেং সন্ধ্যার সরাইখানায় এক তাও সাধুর সাক্ষাৎ পায়, সাধু তাকে একটা চিনেমাটির বালিশ দেয়। সরাইখানার রাঁধুনি তখন বাজরা সেদ্ধ করছে। বালিশ মাথায় ঠেকিয়ে লু জীবনব্যাপী ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন দ্যাখে। জেগে উঠে দ্যাখে–সোনালি বাজরা তখনো টগবগিয়ে ফুটছে। চীনা ভাষায় আকাশকুসুম কল্পনার নাম 'গোল্ডেন মিলেট ড্রিম'। সেকালে ভাবতাম, শহরজাদির কাছে নির্ঘুম রাতভর গল্প শুনে কি সুলতান শাহরিয়ার ঘুমোতে যেতেন আর? তারাপদ রায় লিখেছিলেন একটি শিশু তাকে অভিযোগ করেছিল, 'আমি যখন ঘুমোতে চাই না, তখন মা আমাকে জোর করে ঘুম পাড়ায় আবার আমি যখন ঘুমিয়ে থাকতে চাই, তখন মা আমাকে ঠেলে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে দেয়।'
হারুকি মুরাকামির 'ব্লাইন্ড উইলো, স্লিপিং উওম্যান' গল্পটিতে অন্ধ দেওদারের মাছি একটি নারীর কান ভরে দেয় রেণুতে আর সে অনন্তকাল ঘুমোয়, কিছুতেই জাগে না। ঘুম নামে একটি আস্ত উপন্যাসই আছে এই লেখকের। সাহিত্যিকের দিকে ফিরি। কাফকার গ্রেগর সামসা এক সকালে ঘুম থেকে উঠে টের পেল সে পোকা হয়ে গেছে (মেটামরফসিস), পৃথিবীবিখ্যাত এ জাগৃতি। কাফকা নিজে ভুগেছেন অনিদ্রায়। ডিকেন্স এবং নবোকভও তাই। দস্তয়েভস্কির নিদ্রাচক্রে ছিল বিভ্রাট। আশৈশব প্রুস্ত ভুগেছেন অনিদ্রারোগে, দিনে ঘুমোতেন, রাতে জাগতেন। এমিলি ব্রন্টি লিখেছিলেন–নিদ্রা তাকে বিশ্রাম দেয় না।
মনোজ বসুর 'নিশিকুটুম্ব' পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম একটা বয়সে। পাকা চোর হচ্ছে চোর-চক্রবর্তী, নিদ্রাউলি বিড়ির ঘ্রাণ শুঁকিয়ে সে ঘরের মানুষকে ঘুম পাড়ায়, শুকনো কলাই ছুড়ে অন্ধকারে টের পেতে পারে–কোথায় কোন আসবাব। মাহমুদুল হকের 'নিরাপদ তন্দ্রা'–একা নারীর বিপরীতে এক অসীম তন্দ্রাচ্ছন্ন সমাজের ছবি। মনে পড়ছে–সুমন রহমানের 'নিরপরাধ ঘুম' গল্পটা পড়েছিলাম কমনওয়েলথ শর্টলিস্টেড হবার আগেই, বাংলায় প্রকাশিত হবার কালে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে পটভূমিতে রেখে চমকপ্রদ গল্প। অকালপ্রয়াত সাহিত্যিক ফয়জুল ইসলামের 'ঘুমতৃষ্ণা'–দুটি অনিদ্রারোগী যুগলের কথা, যারা বিশ্বাস করে পাশাপাশি শুয়ে তারা ঘুমোতে পারবে।

ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে
চিত্রের জগতে তাকাই। শিল্পী ভারমিরের তুলিতে 'আ মেইড আস্লিপ'–দুষ্টা চাকরানি মাতাল হয়ে ঘুমে ঢুলছে, ক্যানভাস সন্ধ্যার আলো লাগা স্বচ্ছ কাচের মতো ঝলসাচ্ছে। বতিচেল্লির মার্স আর ভেনাস নিদ্রিত, জর্জনে আর তিশানের ভেনাস নিদ্রামগ্ন। কুর্বের দুই নিদ্রিত বন্ধু বাসনাময়, সাহসী। উনিশ শতকের ইরোটিকায় হোকুসাইয়ের উডব্লক 'জেলেনী ও তার স্বপ্ন'ও দুঃসাহসী। ভ্যান গখ নিজে অনিদ্রার জন্য ক্যাম্ফর সেবন করতেন, তিনি আঁকলেন 'দ্য সিয়েস্তা', গঁগ্যাও আঁকলেন সিয়েস্তা। কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন–ভ্যান গখের ঘরের বিছানায় দুখানা বালিশ, যেন আজন্ম নির্বাসিত-নিঃসঙ্গ মানুষটির সঙ্গবাসনার প্রতীক সেই বালিশ দুটো। 'স্টারি নাইট'-এ তিনি ঘুম রচনা করেছেন নাকি নির্ঘুম স্নায়বিক নির্যাতন? ভ্যান গখের দিবানিদ্রার দুই বছর পরে তুল্যোজ লত্রেকের 'ইন বেড', আর সাত বছর পরে অঁরি রুশোর 'দ্য স্লিপিং জিপসি'। মিলে এবং পাবলো পিকাসো ভারী বর্ণিল করে এঁকেছেন ঘুমন্ত চাষি যুগলকে, আলাদা মুডে, আলাদা সময়ে। প্রির্যাফায়ালাইট শিল্পী ওয়াটারহাউস রচনা করেছেন অ্যালিগরি–ঘুম (হিপনোস) আর মৃত্যু (থানাটোস) দুই ভাই।
বিপি পোর্ট্রেট প্রাইজ ২০১৮-এ শর্টলিস্টেড একটি পেন্টিংয়ের কথা না উল্লেখ করে পারছি না–ফেলিসিটি ফোর্টের 'নিদ্রিত টাইমট্র্যাভেলার'।
এই চাঁদের তিথিরে বরণ করি
সিনেমায় ঘুম তথা অনিদ্রা–অসময়ের ঝিমুনি-সমনাম্বুলিজম-স্লিপ প্যারালিসিস-প্যারাসমনিয়া-হাইপারসমনিয়া-হিপনোথেরাপি-ড্রিম ফ্যান্টাসি কিসব ভয়ানক কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে। ডি নিরোর 'ট্যাক্সি ড্রাইভার'কে মনে করে দেখুন। বা গ্রেগরি পেকের 'স্পেলবাউন্ড'। টম হ্যাংকসের 'স্লিপলেস ইন সিয়াটল' বা বিল মুরের 'লস্ট ইন ট্রান্সলেশন' চমৎকার। কলিন ফার্থ–নিকোল কিডম্যানের 'বিফোর আই গো টু স্লিপ' টানটান থ্রিলার। সিনেমায় ঘুম যেন স্টিক্স নদী, যেন অলটারনেট রিয়েলিটির আরশিনগরে নিয়ে যাবার টানেল। জাগৃতি আর বিস্মৃতিতে মিলে গেলে মানবমুদ্রার ওপিঠ দেখা যায়, ডক্টর জেকিলের পেছনের মিস্টার হাইড। বড় ভয়ানক।
একে একে তাহারা ঘুমায়ে পড়ে
নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার পিঠে ঘুমোতেন নাকি। মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতান সিলিং থেকে ঝুলানো দড়ির বিছানায় শুতেন, ভাইকিংদের মতো এক হাতে ছুঁয়ে থাকতেন বালিশের তলায় লুকোনো তলোয়ারের বাঁট। যা স্বপ্নে দেখতেন, তা নথিবদ্ধ করে রাখতেন। আব্রাহাম লিংকন ভুগেছিলেন অনিদ্রারোগে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, নিকোলা টেসলা, টমাস আলভা এডিসন। রাজা-মহারাজার অনিদ্রা, বড় বড় মানুষের অনিদ্রা।

ফিরে যাই একান্ত অতীতে, যেখানে ছোটবড় অসংখ্য মানুষের বসতির ওপর শেষ রাতের আকাশ ভরে ওঠে আহ্বানে–'ঘুম হইতে নামাজ উত্তম।' আমাদের বাড়িতে কে গুনগুন করে দোয়া-এ হাবিব পড়ে–'কুম কুম ইয়া হাবিবি কাম তানামু...হে বন্ধু ওঠো আর কত ঘুমাইবে, আশ্চর্য যে প্রেমিক সে কেমন করিয়া ঘুমায়!' ইস্টিশনে আর পাইকারি বাজারে ভিক্টোরীয় গৃহহীনদের স্বজনেরা জেগে ওঠে সারা রাত্রির ঘামের নুন মেখে। জবাকুসুমসঙ্কাশং সূর্য উদিত।
পরীক্ষার জন্য আধঘুমে পড়ুয়ারা পড়ে–'দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর।' হেমন্ত মুখার্জির নিদ্রালু গলায় রেডিওতে বাজে হারানো গান–'রজনীগন্ধা ঘুমাও আজ রাতে।' শচীনকর্তার আফিমপোরা গলায়–'ঘুম ভুলেছি নিঝুম এ নিশীথে।' তস্য পুত্রের তোড়ি-খামাজের মকটেল–'র্যায়না বিতি যায়'। আমরা স্কুলে কোরাস গাইব রবিঠাকুরের গান–'জাগরণে যায় বিভাবরী'। ক্লাসে কেউ ঢুলে পড়লেই ডাক দেব–'রানীক্ষেত!' ভূগোল ক্লাসে আমরা শিখব 'নাগানা' রোগের কথা, সেৎসি মাছির কারণে যে ঘুমরোগ হয়। 'ঘুড্ডি' সিনেমা টিভিতে দেখালে সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে দুলে দুলে–'ঘুম ঘুম ঘুম চোখে দেয় চুম'। চাচ্চুদের কেউ বাজাবে এভারলি ব্রাদার্স, 'ড্রিম ড্রিম ড্রিম'। রয় অরবিসনের 'ইন ড্রিম'। 'ড্রিম বেবি হাউ লং মাস্ট আই ড্রিম'। বিটলসের 'আয়াম অনলি স্লিপিং'।
অ্যাবার 'আই হ্যাভ আ ড্রিম।' মুভি অব দ্য উইকে হিচককের স্বপ্নের ব্যাখ্যামূলক মুভি 'স্পেলবাউন্ড' দেখব আব্বার সঙ্গে। হামফ্রি বোগার্টের ফিল্ম নোয়ার 'বিগ স্লিপ'–এত জটিল যে সিনেমাটা দেখবার পরে বুঝতেই পারব না–গল্পের কাহিনিসূত্র আসলে কী! সার্ক উপলক্ষে শাদাকালোর উত্তমকুমার ফিরে আসবেন পিয়ানোতে–'আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে সাতসাগর আর তেরো নদীর পারে।' আরও কত মিটিমিটি তারা আর মাধবী রাত। একে অন্যের হাতে চালান করে দেব শেরশায়েরির বই–'নিদ আয়ে তো খোয়াব আয়ে, খোয়াব আয়ে তো তুম আয়ে, লেকিন তুমহারি ইয়াদোঁ মে, না নিদ আয়ে না খোয়াব আয়ে।'
মুচকি হাসব। বসন্তোৎসবে মায়ের গেরুয়া তাঁতের শাড়ি। আব্বা ডেকে বলবে–বাঘ দেখবি? বাঘের নাম–মার্টিন লুথার কিং, হুংকারের নাম–'আই হ্যাভ আ ড্রিম', আমাদের চিরজাগরুক স্বপ্ন।...পুরো সময়টা ধরে নিয়মিত ঘুম আমাদের বড় করে তুলবে এমন এক সময়ের জন্য, যখন নিশ্ছিদ্র ঘুমের আশায় কাঁদতে হবে, স্বপ্ন ভেঙে যাবার দুঃখ আমাদের হৃদয়ে ঢুকে যাবে কিলকাকার অস্ত্রের মতো। অত্যন্ত নিকটের একটা নিবিড় বর্তমানের নাড়া খেয়ে জেগে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করব বেদনার মধ্যে, ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন।