ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাব আইএসডিবির
বাংলাদেশের দীর্ঘ বিলম্বিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের সম্প্রসারণ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি)। ইআরএল-২ প্রকল্পে ব্যাংকটি ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
ইআরএল-২ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের একমাত্র তেল শোধনাগারটির সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এর মূল লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ জ্বালানি পরিশোধন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদন নিশ্চিত করা, যা দেশের আমদানি নির্ভরতা কমাবে।
সংস্থাটি গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দেওয়া এক চিঠিতে ইআরএল-২ নির্মাণে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রাথমিক প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশও এতে সম্মতি জানিয়েছে।
প্রস্তাবটি নিয়ে গত বুধবার আইএসডিবির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব এবং মধ্যপ্রাচ্য অনুবিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আগামী জুনের মধ্যে ঋণ চুক্তি সই করার বিষয়ে বৈঠকে ঐকমত্য হয়েছে।
'তবে তার আগে জানুয়ারিতে আইএসডিবির টেকনিক্যাল কমিটির সফর রয়েছে। ওই সফরে ঋণের শর্তাবলি নির্ধারণ হবে,' বলেন তিনি।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, আইএসডিবি প্রাথমিকভাবে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব দিলেও প্রয়োজনে তারা আরও অর্থায়ন করতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের জন্য এই প্রস্তাব ভালো খবর। ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য সরকার অনেক দিন থেকে বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এই ঋণ নিতে সরকারও আগ্রহী।'
একনেকে ইতিমধ্যে ইআরএল-২ অনুমোদিত
আইএসডিবির প্রস্তাব পাওয়ার পরদিন, গত মঙ্গলবার সরকার ইআরএল-২ প্রকল্প অনুমোদন করে। বিদেশি অর্থায়ন তখনো নিশ্চিত না থাকায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আপাতত সরকারি অর্থায়নেই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
একনেক ৩৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে ২১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ও ১৪ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা ইস্টার্ন রিফাইনারির নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তবে পরিকল্পনা কমিশন ও ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, একনেক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে আইএসডিবির ঋণ আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হলে অর্থায়নের কাঠামো সংশোধন করা হবে।
তারা বলেন, আপাতত সরকারি ও নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। আইএসডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি হওয়ার পর অর্থায়নের কাঠামো হালনাগাদ করে তা ফের একনেকে উপস্থাপন করা হবে।
আইএসডিবির সবচেয়ে বড় ঋণ প্রস্তাবগুলোর একটি
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, আইএসডিবির ঢাকা ও মালদ্বীপের আঞ্চলিক প্রধান মুহাম্মদ নসি বুলাইমান ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীকে এই ঋণের প্রস্তাব সংবলিত চিঠিটি পাঠিয়েছেন।
আইএসডিবির প্রাক্কলন অনুযায়ী, প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে প্রায় ২.৮৯৪ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকার সমান।
আইএসডিবির ঢাকা আঞ্চলিক হাব প্রকল্প ব্যয়ের একটি অংশে, প্রাথমিকভাবে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত কো-ফাইন্যান্সিংয়ের সুযোগও রাখা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এই আগ্রহ প্রকাশটি নন-বাইন্ডিং। এটি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ, যথাযথ যাচাই-বাছাই, প্রকল্পের প্রস্তুতি ও অর্থায়নের শর্তাবলি সম্মতির ওপর নির্ভরশীল।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলেন, চূড়ান্ত হলে এটি হবে আইএসডিবির দেওয়া সর্বকালের বৃহত্তম ঋণগুলোর একটি—শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, যেকোনো দেশের জন্যই।
দীর্ঘ বিলম্বিত প্রকল্প
ফ্রান্সের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেকনিপ-এর অধীনে ১৯৬৮ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো এর দ্বিতীয় ইউনিটের (ইআরএল-২) পরিকল্পনা করা হয়; ২০১৩ সালে সরকার এ প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেয়।
তবে এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়; তখন প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। কিন্তু তারপরও কাজ শুরু হয়নি।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইআরএল-২ নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করে; ৯ জুলাই জ্বালানি বিভাগ সেই প্রস্তাব অনুমোদন করে। তবে আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়।
দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করে। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৫ হাজার ৫০০.৭৭ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এবং ১০ হাজার ৯০৯.৩২ কোটি টাকা বিপিসির নিজস্ব তহবিল থেকে জোগানের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
বিদেশি ঋণ নিশ্চিত না হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সংশোধিত পরিকল্পনা নেয়। পরিকল্পনা কমিশন ব্যয় কমানোর আগে প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার ৯৭৩.৭০ কোটি টাকা—যার মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩০ হাজার ৪৯৯.৮০ কোটি টাকা ও বিপিসির ১২ হাজার ৪৭৩.৯০ কোটি টাকা।
অপরিশোধিত তেল পরিবহন বৃদ্ধি ও আমদানি কমাবে ইআরএল-২
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারে ইস্টার্ন রিফাইনারি। বাকি চাহিদা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত ইআরএল-২ ইউনিটে পরিবেশবান্ধব ইউরো-৫ মানের গ্যাসোলিন ও ডিজেল উৎপাদিত হবে। একইসঙ্গে এটি বিদ্যমান রিফাইনারির ডিজেল, মোটর স্পিরিট ও অকটেনকে ইউরো-৫ মানে উন্নীত করবে।
ইতিমধ্যে বিপিসি 'ইনস্টলেশন অভ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন' শীর্ষক একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার মাধ্যমে বছরে ৪৫ লাখ টন পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহন করা সম্ভব যাবে।
আমদানিকৃত পরিশোধিত জ্বালানির ওপর অতি-নির্ভরতার কারণে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়। প্রস্তাবিত 'মডার্নাইজেশন অ্যান্ড এক্সপ্যানশন অভ ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড' প্রকল্পের আওতায় বছরে ৩০ লাখ টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা হবে, যা জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে।
কর্মকর্তারা বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে ৪ লাখ টন ফার্নেস অয়েল, ৬০ হাজার টন এলপিজি, ৬ লাখ টন ইউরো-৫ পেট্রোল, ১১ লাখ টন ইউরো-৫ ডিজেল, ২ লাখ টন লুব বেজ অয়েল ও ৫ লাখ টন জেট ফুয়েল উৎপাদন করা যাবে।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবহার ছিল ৬৭.৩ লাখ টন। এর মধ্যে ইআরএল উৎপাদন করেছে মাত্র ১২.৫ লাখ টন, ফলে বাকি প্রায় ৫০.৫ লাখ টন জ্বালানি আমদানি করতে হয়েছে।
গত কয়েক বছরে জ্বালানির চাহিদা বছরে গড়ে ৫.৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। বিপিসির প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ চাহিদা ১ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার টনে পৌঁছাতে পারে, যেখানে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টনে সীমাবদ্ধ থাকবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, যদি ইআরএল সম্প্রসারণ না করা হয়, তবে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে ৯২.৯ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। এতে আমদানি ব্যয়ের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হবে এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
