মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমেছে ব্যাপকভাবে, বাড়ছে আর্থিক ক্ষতি
মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি গুরুতর প্রযুক্তিগত ও পরিচালনগত সংকটে ভুগছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনা সভায় উঠে এসেছে, এসব সমস্যার কারণে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে; পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে।
চলমান কারিগরি বিরোধ ও মেরামতের কাজ আটকে থাকায় সংকট আরও গভীর হয়েছে। বর্তমানে ইউনিট-১-এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নেমে এসেছে ৪৭ শতাংশে এবং ইউনিট-২-এর ক্ষেত্রে তা ৫৩.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিকে কর্মকর্তারা 'বিপুল আর্থিক ক্ষতি' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের শুরু থেকেই বয়লারের ভেতর ছাই জমে শক্ত হয়ে যাওয়া ও ময়লা জমার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কার্যক্রমে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। এতে পরিচালন সক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। প্রকৌশল, ক্রয় ও নির্মাণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুমিতোমো-তোশিবা-আইএইচআই কনসোর্টিয়ামকে (এসটিআইসি) বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বয়লার সচল ও পূর্ণ কার্যক্ষম করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
পর্যালোচনা সভায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের অক্সিলিয়ারি সিস্টেমের দুর্বলতার দিকটিও চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা গেছে, কমিশনিং শুরুর পর থেকেই উভয় ইউনিটের কুলিং-ওয়াটার পাম্পগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। অন্যদিকে আর্থিক বিষয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এসটিআইসির প্রস্তাবিত ১৫.৬৯ শতাংশ মূল্য সমন্বয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত ১১ নভেম্বর ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের পর্যালোচনা সভায় এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানায়, সমস্যাগুলোর বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। তবে সরকারি কর্মকর্তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম স্থিতিশীল করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন।
ব্যর্থতার মূল কারণ নিয়ে মতবিরোধের ফলে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসটিআইসি বয়লার নষ্ট হওয়ার জন্য নিম্নমানের কয়লাকে দায়ী করেছে। অন্যদিকে মাতারবাড়ি জয়েন্ট ভেঞ্চার কনসালট্যান্টের পরীক্ষায় কয়লার গুণমানে বড় কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সংস্কার পরিকল্পনা জমা দিয়েছে, যা বাস্তবায়নে ২১.৫ মাস সময় লাগবে। তবে চুক্তির বিধি অনুযায়ী এই বিপুল অর্থের জোগান কে দেবে, তা এখনও অস্পষ্ট।
সমস্যাটির বিশদ রুট-কজ অ্যানালাইসিস এবং বিষয়টি ডিফেক্ট নোটিফিকেশন পিরিয়ড-এর আওতায় বিবেচনার দাবি জানিয়েছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। ২০২৫ সালের অক্টোবরে এসটিআইসি এই বিশ্লেষণ করতে সম্মত হলেও তবে এরপর কোনো ফলো-আপ করা হয়নি।
জানতে চাইলে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, সমস্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নির্ধারণে ঠিকাদার, বয়লার নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিদর্শন করবেন। আশা করা হচ্ছে, মেরামতের সম্পূর্ণ ব্যয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই বহন করবে। জাইকার সহায়তায় সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে, যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উভয় ইউনিটের মেরামত কাজ সম্পন্ন করা যায়।
৫৬ হাজার ৬৯৩.৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৪ সালে। মোট ব্যয়ের মধ্যে ৪৭ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা জাইকার ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
জাইকার অর্থায়নে পরিচালিত অন্যান্য প্রকল্পেও চ্যালেঞ্জ
সভায় জাইকার অর্থায়নে পরিচালিত অন্যান্য বড় প্রকল্পের অগ্রগতিও পর্যালোচনা করা হয়, যার মধ্যে যমুনা রেল সেতু ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল সম্প্রসারণ প্রকল্প অন্যতম। ইআরডি সূত্রমতে, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সেতুর জন্য নির্দিষ্ট কোনো রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা না থাকায় জাপানি প্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এটি দীর্ঘমেয়াদে সেতুর নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া যমুনা রেল সেতু নির্মাণের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রেলসচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও জাপানি যৌথ উদ্যোগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম-এর মধ্যে বিরোধের জের ধরে থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পে অর্থ পরিশোধ ও বাস্তবায়নে বিলম্ব অব্যাহত রয়েছে। ঠিকাদারের পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া সচল করার জন্য ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে একটি 'ডিসপিউট বোর্ড গঠন করা হলেও বোর্ডটি এখনও প্রয়োজনীয় কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি।
সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুমোদনে বিলম্বের কারণে গত দুই বছর ধরে পরামর্শকদের বিল বকেয়া থাকায় জাইকা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
২০১৬ সালে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা (১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা জাইকার ঋণসহ) প্রাক্কলিত ব্যয়ে শুরু হওয়া বিমানবন্দর প্রকল্পটি এখনও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এছাড়া অপারেটর নিয়োগে ব্যর্থতার কারণে থার্ড টার্মিনাল চালু করা সম্ভব হয়নি।
