মাতারবাড়ীর হারকে মানদণ্ড ধরে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণে সরকার
মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতের দামকে ভিত্তি বা মানদণ্ড হিসেবে ধরে অন্তর্বর্তী সরকার রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম পুনরায় আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের সরকারের সময়ে এই দুই কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল, এতে করে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকেই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সরকার চলতি বছরের এপ্রিলে ১,২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ নির্ধারণ করে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। সে তুলনায়, ১,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১৩ টাকা ৫৭ পয়সা এবং একই সক্ষমতার পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা ১২ টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, দামের এই ব্যবধান কমাতে সরকার রামপাল ও পায়রা প্রকল্পের প্রধান ব্যয় উপাদানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে আমদানিকৃত কয়লার দাম, জ্বালানি ব্যবস্থাপনা ও লজিস্টিক ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, কেন্দ্রের দক্ষতা, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, ঋণ পরিশোধ এবং গ্রিড সংযোগ ব্যয় পুনঃনির্ধারণ।
২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের সময় স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ বিভাগ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনায় ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
পর্যালোচনা কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রামপাল ও পায়রার চুক্তিগুলোতে এমন কিছু পয়েন্ট রয়েছে যা রাষ্ট্রের অনুকূলে নয়। কোম্পানিগুলোর অনুকূলে শর্ত যুক্ত করে চুক্তি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন এসব শর্ত পুনর্বিবেচনার জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে, এবং নতুন করে এসব শর্ত নির্ধারণের বিষয়ে কোম্পানি দুটির কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে।"
সাধারণত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয় কয়লার দাম, আমদানি ও পরিবহন ব্যয়, ঋণ পরিশোধের সময়সূচি, বিনিময় হার ধরে নেওয়া অনুমান, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা এবং গ্রিড–সম্পর্কিত খরচের ভিত্তিতে।
এপ্রিল মাসে মাতারবাড়ীর ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ সম্পন্ন হওয়ার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা এম ফাওজুল কবির খান বলেছিলেন, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দামকে বেঞ্চমার্ক (মানদণ্ড) হিসেবে ধরে, অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে বিদ্যুতের দাম নিয়ে আলোচনা হবে। যা একটি যৌক্তিক আলোচনায় সহায়ক হবে।
রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপদেষ্টা টিবিএসকে বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। যোগাযোগ করা হলে, বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ জানান, "দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে আলোচনা চলছে। নেগোসিয়েশন (আলোচক) কমিটি এ বিষয়ে কাজ করছে। এগুলো বাধ্যতামূলক চুক্তি, ফলে বিদ্যমান চুক্তির বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। তারপরও আমরা আশাবাদী যে একটি সমাধানে পৌঁছানো যাবে।"
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পুনরায় আলোচনার প্রক্রিয়ার কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় মে মাস থেকে রামপাল ও পায়রাকে দেওয়া ভর্তুকির অংশের টাকা ছাড় স্থগিত রেখেছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও কয়লা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলায় সমস্যা হচ্ছে।
সম্প্রতি অর্থ বিভাগের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ–চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড পরিচালিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২,৪৪০ কোটি টাকা। একই সময়ে বাংলাদেশ–ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড পরিচালিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বকেয়া পড়েছে ১,৫৫৪ কোটি টাকা।
কর্মকর্তারা আরও নিশ্চিত করেছেন যে উভয় কোম্পানিই কয়লা আমদানির জন্য এলসি খোলার অর্থ জোগাতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানিয়েছে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশ ও চীনের সরকারের যৌথ মালিকানাধীন, আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতের এনটিপিসি ও বিপিডিবির যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। দুই প্রকল্পেই সরকারের মালিকানা ৫০ শতাংশ করে।
পিপিএ শর্ত একতরফা পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত করছে
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "রামপাল ও পায়রার বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) এমনভাবে করা হয়েছে যে চাইলেই এগুলো সংশোধন করা যাবে তা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, কোনো পক্ষ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে তখন চুক্তি সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। সেক্ষেত্রেও সাথে সাথে সংশোধন নয়। কয়েক ধাপে অর্থাৎ আলোচনা, মধ্যস্ততাকারী নিয়োগ, আরবিট্রেশন করার পর এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যাবে।"
"তবে সরকার কোম্পানি দুটির সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তি সংশোধন করতে পারে। কারণ চুক্তিগুলো পরিস্কার একতরফাভাবে করা হয়েছে। চুক্তিতে সব ঝুঁকি সরকারের, আর মুনাফা কোম্পানির। এই চুক্তিগুলো ক্রনি ক্যাপিটালাইজেশনের ক্লাসিক্যাল উদাহরণ। এটি যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব। ফলে কোম্পানিগুলোকে বোঝানো যে চুক্তিগুলো একতরফা, সেটি প্রমাণ হলে অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে। তার চেয়ে ভালো সমঝোতার মাধ্যমে উভয়পক্ষের জন্য সমান সুবিধা রেখে চুক্তি সংশোধন করা"- বলেন তিনি।
এই দুটি প্ল্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), আবার কোম্পানি দুটির মালিকানার সাথেও যুক্ত রয়েছে। বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সাথে এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
ট্যারিফ অনুমোদন ইস্যুতে আরও কয়েকটি কেন্দ্রের অর্থপ্রদান স্থগিত
এদিকে, আগের সরকারের সময়ে মন্ত্রিসভার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি (সিসিজিপি)-এর অনুমোদন ছাড়াই ট্যারিফ অনুমোদনের কারণে আরও কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভর্তুকির অর্থপ্রদান আটকে গেছে।
সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সিসিজিপির অনুমোদন না নিয়েই রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) চারটি এবং বিআর পাওয়ারজেন লিমিটেডের দুটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনা শুরু করেছিলেন। এসব প্ল্যান্টের বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দামও বিপু অনুমোদন করেন।
এই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে—আরপিসিএলের ময়মনসিংহ ২১০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল কেন্দ্র, গাজীপুরের ৫২ মেগাওয়াট ও রাউজানের ২৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল পাওয়ার প্ল্যান্ট, গাজীপুরের ১০৫ মেগাওয়াট এইচএফও–ভিত্তিক কেন্দ্র এবং বিআর পাওয়ারজেনের গাজীপুরের কোড্ডা ও মিরসরাইয়ে অবস্থিত ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
সিসিজিপির অনুমোদন না থাকায় অর্থ বিভাগ প্রথমে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এসব কেন্দ্রের ভর্তুকি স্থগিত করে। এরপরই ট্যারিফ পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পরও অব্যাহত রয়েছে।
যদিও পরে এপ্রিল ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ সময়ের জন্য ১,৬০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়, তবে চলমান ট্যারিফ আলোচনার কারণে মে মাস থেকে আবারও ভর্তুকি প্রদান বন্ধ রয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,০২০ কোটি টাকা—এর মধ্যে বিআর পাওয়ারজেনের পাওনা ৪৯০ কোটি এবং আরপিসিএলের ৫৩০ কোটি টাকা।
এবিষয়ে বিআর পাওয়ারজেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফ হোসেন বলেন, পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) স্বাক্ষর না হওয়ায় মিরসরাই কেন্দ্রের ভর্তুকির অর্থ ছাড় হচ্ছে না। আর গাজীপুরের কড্ডা কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম সংশোধন করা হচ্ছে। এজন্য ভর্তুকির অর্থ ছাড় হয়নি।
তিনি বলেন, "ভর্তুকির অর্থ ছাড় না হওয়ায়—ব্যাংক থেকে কমার্শিয়াল রেটে লোন নিয়ে খরচ চালাতে হচ্ছে।"
আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম রাশেদ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিদ্যুৎ বিভাগ বিষয়টি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেছে। কর্মকর্তারা জানান, এরই মধ্যে তিনটি কেন্দ্রের ট্যারিফ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং বাকি তিনটির অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
