সরকারের কাছে বকেয়া পাওনা ২৭,০০০ কোটি টাকার বেশি; চাপে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা
সরকারের কাছে পাওনা অর্থ পেতে দীর্ঘ বিলম্বের কারণে হিমশিম খাচ্ছে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) প্রতিষ্ঠানগুলো। আইপিপিগুলো বলছে, এ বিলম্বের ফলে তাদের জ্বালানি ক্রয় ও আর্থিক দায় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে তারা সতর্ক করেছে যে, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে খাতটির বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা ব্যাহত হতে পারে।
আইপিপি ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-এর (বিপিডিবি) কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বিপিডিবির কাছে ৭০টির বেশি দেশি-বিদেশি আইপিপির বকেয়া পাওনা এখন ২৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদনকারীদের পাওনা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা, বাকি অর্থ বিদেশি উদ্যোগে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর।
আইপিপি মালিকরা বলেন, নির্ধারিত তারিখের পর ৬ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত বিল বকেয়া থাকছে। ফলে পুরো খাতজুড়ে তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে যে, এই দীর্ঘসূত্রতা পুরো খাতের টেকসই সক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান মো. শামীম মিয়া টিবিএসকে বলেন, বকেয়া পরিশোধ না করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, 'আমাদের কিছু বিল ৬-৭ মাস ধরে বকেয়া হয়ে আছে। ফলে ঋণদাতারা আমাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। বিদ্যুৎ খাতের এই দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে আমরা নীতিনির্ধারকদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।'
কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস লিমিটেডের অধীনে চারটি আইপিপি (মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩৯৩.৩৬ মেগাওয়াট) পরিচালনাকারী কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বলেন, বিল পরিশোধে বিলম্ব কখনো কখনো নয় মাসও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ, জ্বালানি সংগ্রহ ও উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বকেয়া বিদ্যুৎ বিল সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আইপিপিগুলোর বিল পরিশোধ করছি। তবে অর্থ প্রদান প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে আমরা অর্থ বিভাগের কাছে তহবিল চেয়েছি, অন্যান্য উৎস থেকেও অর্থের সংস্থান করছি।'
আইপিপি মালিকরা বলেন, বকেয়া বিলের জন্য তিতাস গ্যাস আনুষ্ঠানিক নোটিশ দিতে শুরু করেছে, যেখানে সুদের বিষয়টিও উল্লেখ করা হচ্ছে। তারা আরও বলেন, বিপিডিবি একদিকে তাদের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করছে না, অন্যদিকে তারল্য সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানিতে দেরি হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যর্থতার জন্য উল্টো ক্ষতিপূরণ আরোপ করছে।
বিপিডিবিকে আইপিপিগুলোর চিঠি
আইপিপিগুলোর পক্ষ থেকে বিপিডিবিকে দেওয়া বেশ কয়েকটি চিঠি পর্যালোচনা করেছে টিবিএস। ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (মোট সক্ষমতা ২,২৫৫ মেগাওয়াট) পরিচালনাকারী দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড গত ৯ নভেম্বর বিপিডিবি চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেয়। সেখানে সতর্ক করে বলা হয়, বিল পরিশোধে দীর্ঘ বিলম্ব কোম্পানিটিকে চরম আর্থিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, 'আমাদের ঋণদাতারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অবিলম্বে বকেয়া অর্থ না পেলে তারা আমাদেরকে খেলাপি ঘোষণা করতে পারেন।'
চিঠিতে আরও বলা হয়, 'ওঅ্যান্ডএম [অপারেশন ও ম্যানেজমেন্ট] ঠিকাদার দেশি-বিদেশি কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে জেনারেল ইলেকট্রনিকসের সাথে দীর্ঘমেয়াদি পরিষেবা চুক্তির আওতায় পাওনা অর্থও বকেয়া রয়ে গেছে।'
ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তাদের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা বাড়ছে, হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) ও যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা সম্ভব হচ্ছে না, মেয়াদোত্তীর্ণ এলসি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না, ব্যাংকগুলো ফোর্সড লোন তৈরি করছে এবং জ্বালানি আমদানির শুল্ক পরিশোধেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
ডরিন পাওয়ারের সিইও মোস্তফা মঈন বলেন, 'আমাদের বিলগুলো অন্তত ৪-৫ মাস ধরে বকেয়া রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখার জন্য আমাদের হাতে থাকা সমস্ত রিসোর্স আমরা ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছি।'
টিবিএসের দেখা চিঠিগুলোর তথ্যানুসারে, শুধু সামিট পাওয়ারেরই পাওনা রয়েছে ৪ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। ইউনাইটেড পাওয়ার জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তাদের বকেয়ার পরিমাণ ৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।
এছাড়া ডরিন পাওয়ারের ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ও কনফিডেন্স পাওয়ারের প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
বিপিডিবি কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) অনুযায়ী, বকেয়া বিলের ওপর সুদ দিতে বাধ্য বিপিডিবি। এই সুদের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি নোটের মুনাফার হারের সঙ্গে বাড়তি ৪ শতাংশ যোগ করে হিসাব করা হয়।
তারা আরও বলেন, এভাবে বিলম্ব চলতে থাকলে সুদে-আসলে মোট বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা বিপিডিবির আর্থিক বোঝা আরও বাড়িয়ে দেবে।
বিপিডিবির সংকট
খাতসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মতে, বিপিডিবির এই বিশাল বকেয়া পরিশোধের অক্ষমতার পেছনে বেশ কিছু দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা দায়ী।
বিশেষ করে আমদানি করা জ্বালানির কারণে চড়া উৎপাদন খরচ বিপিডিবির ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। সংস্থাটি ভর্তুকির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যার পরিমাণ এখন বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এটি সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ওপরও বাড়তি চাপ ফেলছে।
উৎপাদন খরচ ও খুচরা বিদ্যুৎ মূল্যের (ট্যারিফ) মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান বিশাল আর্থিক ঘাটতি তৈরি করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল প্রায় ১২ টাকা, বিপরীতে গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ৮.৫০ টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতির কারণে জ্বালানি আমদানিতে দেরি হচ্ছে। এতে বিপিডিবির যথাসময়ে বিল পরিশোধের সক্ষমতা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া অতিরিক্ত স্থাপিত সক্ষমতার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুরোপুরি ব্যবহার না হলেও বিপিডিবিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে, যা তাদের দেনার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
খাতভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা
বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৫টি, যাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৬৩টি কেন্দ্র সরকারি মালিকানাধীন, যারা ১১ হাজার ৭৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এটি দেশের মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৪২ শতাংশ।
এছাড়া যৌথ উদ্যোগের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ২ হাজার ৪৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা মোট সক্ষমতার ৯ শতাংশ।
বেসরকারি খাতও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ৭০টিরও বেশি আইপিপি ১১ হাজার ৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, যা মোট সক্ষমতার ৪০ শতাংশ।
বাকি ২ হাজার ৬৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে আমদানি থেকে।
