বকেয়ার ৩ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বিপিডিবি, বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখল আদানি
বকেয়ার আংশিক অর্থ পরিশোধ করায় ভারতীয় বিদ্যুৎ জায়ান্ট আদানি পাওয়ার বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখতে, আদানি পাওয়ারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার শেষ দিন গতকাল (১০ নভেম্বর) বিপিডিবি ৩০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করলে আজ (১১ নভেম্বর) বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখে আদানি। এর আগে ৪৯৫ মিলিয়ন ডলার বকেয়ার জেরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) রিয়েল-টাইম তথ্য অনুযায়ী, আজ ভোর ১টায় আদানি ১,১৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে, যদিও ওই সময়ে উৎপাদন পূর্বাভাস ছিল ১,৪৩৬ মেগাওয়াট।
এর ফলে বিদ্যুৎ আমদানি বিল বকেয়া নিয়ে ভারতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদক জায়ান্টটির পক্ষ থেকে দেওয়া সরবরাহ বন্ধের হুমকি আপাতত ঠেকানো গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিপিডিবি গতকাল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ কোটি ডলারের একটি লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খুলে অর্থ পাঠিয়েছে। আদানির দাবিকৃত ৪৯৬ মিলিয়ন (৪৯.৬০ কোটি) ডলারের মধ্যে আংশিক অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে বিপিডিবি ১,৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ভারতের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধের ঝুঁকি এড়াতে সক্ষম হয়েছে।
পিজিসিবির তথ্য আরও দেখাচ্ছে, ভোর ২টার দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়ে ১,১৩৯ মেগাওয়াটে পৌঁছায়। এরপর থেকে সরবরাহ কমতে শুরু করে। ভোর ৩টায় তা দাঁড়ায় ১,০৩৫ মেগাওয়াট এবং সকাল ৭টায় আরও কমে ৮৪২ মেগাওয়াটে নামে।
বিপিডিবির অন্তত তিনজন কর্মকর্তা এর আগে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছিলেন, অর্থপ্রদানের ফলে আজ (মঙ্গলবার) থেকে আদানির পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। "আমরা আদানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি এবং বকেয়ার যে অর্থ নিয়ে বিতর্ক নেই– তা পর্যায়ক্রমে পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা চলছে," বলেন ঘটনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
আদানির বিদ্যুৎ গ্রহণ ও বিতরণকারী পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিবি) জানিয়েছে, আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটলে গ্রিডের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কাছে কোনো জরুরি বিকল্প পরিকল্পনা নেই।
গতকাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর সঙ্গে কথা বলার সময় পিজিবির সিস্টেম অপারেশন বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী বিএম মিজানুল হাসান বলেন,"আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত আদানির পক্ষ থেকে আগামীকাল (মঙ্গলবার) কোনো সরবরাহ বন্ধের তথ্য আসেনি। যদি এমন কিছু ঘটে, আগে থেকেই আমাদের জানানো হবে।"
পিজিবির রিয়েল-টাইম ডেটা অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় আদানি বাংলাদেশে ১,১১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে।
এর আগে, আদানি পাওয়ারের এনার্জি রেগুলেটরি অ্যান্ড কমার্শিয়াল বিভাগের প্রধান অবিনাশ অনুরাগ গত অক্টোবরের শেষদিকে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে হুমকি দেন, যদি বিপিডিবি ১০ নভেম্বরের মধ্যে "দীর্ঘদিনের বকেয়া" নিষ্পত্তি না করে, তবে ১১ নভেম্বর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থগিত করা হবে।
চিঠিতে আদানি দাবি করে, বারবার যোগাযোগ ও তাগাদা দেওয়ার পরও বিপিডিবি তাদের ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে বিপিডিবির নিজস্ব স্বীকৃত বকেয়া ২৬২ মিলিয়ন ডলার এখনো পরিশোধ হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। তবে বিপিডিবির কর্মকর্তারা টিবিএস–কে জানিয়েছেন, প্রকৃত বকেয়া প্রায় ২৫৬ মিলিয়ন ডলার।
অর্থ না পাওয়ার ধারাবাহিকতার কারণ উল্লেখ করে, আদানি চিঠিতে ২০১৭ সালের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ)–এর ধারা ১৩.২ (১), (২) এবং (৩) উদ্ধৃত করে জানায়, ক্রেতা (বিপিডিবি) অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার অধিকার রাখে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, সরবরাহ বন্ধ থাকলেও আদানি নির্ভরযোগ্য সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পাওয়ার অধিকার তাদের থাকবে।
চুক্তি অনুযায়ী, বিপিডিবিকে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ— স্থায়ী ব্যয় যেমন ঋণ পরিশোধের খরচ, কর্মচারীদের বেতন ও অবচয়—পরিশোধ করতে হবে, বিদ্যুৎ সরবরাহ হোক বা না হোক।
এটাই আদানি ও বিপিডিবির মধ্যে প্রথম সংকটের ঘটনা নয়।
২০২৪ সালের নভেম্বরের শুরুতেও— আদানি পাওয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেয়, বকেয়া বিলের অংক ৮০০ মিলিয়ন ডলার (৮০ কোটি) দাবি করে। বিপিডিবি তখন জানায়, আদানির নিজস্ব পদ্ধতিতে অর্থের পরিমাণ একতরফাভাবে হিসাব করা হয়েছে।
বিপিডিবির ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আদানি প্রতি মাসে গড়ে ৯৩২.৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করেছে। যদিও ১,৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই কেন্দ্রটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্যই নির্মিত।
গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, ভারত সরকার ২০১৮ সালের সেই নির্দেশিকায় সংশোধনী আনে, যার অধীনে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরা কাজ করে। এই পরিবর্তনের ফলে আদানি পাওয়ার এখন চাইলে স্থানীয় ভারতীয় বাজারেও গোড্ডা প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারে।
