অমিয়শঙ্কর, ঘরে ফিরে যা

'অমিয়শঙ্কর, ঘরে ফিরে যা।'
'বইয়ের নাম?'
'জি।'
'এই নামে কবিতা আছে?'
'জি না। বইয়ের কোনো পঙ্ক্তিতে অমিয়শঙ্করের উল্লেখমাত্র নাই।'
'উল্লেখমাত্র নাই? অ।'
'আমি কি কিছু কবিতা আপনাকে পাঠাব?'
'পাঠাতে পারেন।'
'প্রচ্ছদ কি এই মাসে করে দিতে পারবেন?'
'এই মাসে না। সামনের মাসের বারো তারিখে পাবেন। ষোল দিন আর।'
হেসে ফেলল।
মফস্বলের কবি। তরুণ অধ্যাপক। যে শহরের গার্লস কলেজে পড়ায়, সে শহরে আমি গেছি দুইবার। জলরঙের স্কেচের মতো শহর। শহরের উত্তরে নদী। দূরে নীল রঙের পাহাড় দেখা যায়। 'বুড়ো আংলা'র সুবচনীর হাঁস উড়ে গেছে এই শহরের উপর দিয়ে। বেচারা কবি সেটা জানত না। 'বুড়ো আংলা' পড়ে নাই সে।
'কী বই এটা? পাখিদের নিয়ে?'
'বুড়ো আংলা বইয়ের পিডিএফ পাবেন গুগলে।'
'ধন্যবাদ, আমি পড়ে নেব।'
দুইদিন পর কল দিল সে, 'বুড়ো আংলা পড়ে কিছু ঝিলমিল আমার মাথায় ঢুকে পড়েছে। এই বই আমি এত দিন পড়ি নাই!'
তাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়েছেন রসুল ভাই। সেই শহরের মানুষ রসুল ভাই কবি ও ক্রিকেটার। পৈতৃক প্রেসের ব্যবসা নামমাত্র দেখাশোনা করেন। ভালো মানুষ। গত বছর রসুল ভাইয়ের বই 'জল জোছনায় আয়নাবাজি'-এর প্রচ্ছদ করেছি।
কবি মেইলে কবিতা পাঠাল। কিছু কবিতা পাঠাবে বলেছিল, সম্পূর্ণ পা-ুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছে। দৈবচয়ণ ভিত্তিতে তেরোটা কবিতা পড়লাম। 'বুড়ো আংলা' আগে পড়ে নাই, দোষের না সেটা, কবি ভালো কবিতা লেখে। দুই দিনে তার বইয়ের প্রচ্ছদটা বানালাম।
'অমিয়শঙ্কর কি আপনার বন্ধু?'
'না।'
'তাকে কেন ঘরে ফিরে যেতে বলেন?'
'কারণ, সে অমিয়শঙ্কর।'
'কী?'
'তার বউ অপেক্ষা করে।'
'বউ ছাড়া তার আর কেউ নাই?'
'ছেলেমেয়ে আছে। এক ছেলে এক মেয়ে।'
'কী করে সে?'
'সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।'
চমকালাম। শুভঙ্কর, তুষার, অমিয়শঙ্কর, আমি-আমরা আবাল্য বন্ধু। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমাদের অমিয়শঙ্কর। তার এক ছেলে এক মেয়ে। আরেক টাউনের বাসিন্দা কবি কখনো আমাদের টাউনে যায় নাই। অমিয়শঙ্করকে চেনার কথা না তার। নাকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে যেকোনো মানুষ এখন যেকোনো মানুষের চেনা হতেই পারে।
'আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাই।' কবি বলল।
'কেন?'
'দিশেহারা লাগে।'
'অ। আপনার অমিয়শঙ্করের বউয়ের নাম মিত্রা?'
'মিত্রা। হ্যাঁ। আমি আপনাকে বলি নাই, সরি। অমিয়শঙ্করের ছেলের নাম অর্ণব। মেয়ের নাম পারমিতা।'
'আপনি কেন অমিয়শঙ্করকে বানাচ্ছেন?'
'আমার কোনো বন্ধু নাই।'
আমাদের অমিয়শঙ্করের ধর্মসাক্ষী বউ মিত্রা। ছেলে অনু, মেয়ে মিতি।
কল দিলাম।
'অনু মিতির ভালো নাম কী রে?'
'এই তো অনুর অর্ণব।'
'মিতি পারমিতা?'
'হ্যাঁ। তুই তো জানিসই।'
সহ্য করা মুশকিল।
কবির নাম বললাম।–অমিয়শঙ্কর গল্প কবিতা পড়ে না। কবির নাম ইহজনমে শোনে নাই। বলল, 'আধুনিক কবি?'
'উত্তরোত্তর আধুনিক কবি।'
'এ আবার কী? খায় না পরে?'
'খায়, পরে।'
'লজ্জা নিবারণ হয়?'
'নিবারণ হয়।'
'নিবারণ হইলেই হইল।'
'হ্যাঁ হইল। তুই এখন কই?'
'এই তো, ময়না-দুলালের দোকানে বসে চা খাই।'
'শীত করে না? ঘরে ফিরে যা।'
অমিয়শঙ্কর, ঘরে ফিরে যা।
বারো তারিখে প্রচ্ছদের ইপিএস ফাইল পাঠালাম কবিকে।
মেসেজ দিলাম: পছন্দ না হলে বাদ দিয়ে দিতে পারেন।
রিপ্লাই: তখন আপনি কি আরেকটা ডিজাইন করবেন?
রিপ্লাই: না।
রিপ্লাই: এটাই চলবে। পছন্দ হয়েছে। অমিয়শঙ্কর নাই; কিন্তু তাকে দেখা যায়। ধন্যবাদ। আপনার পেমেন্ট কি বিকাশে করব?
বিকাশ নাম্বার দিলাম। টাকা পাঠাল।
লেনদেন শেষ।
কবির নাম্বার ব্লক করে দিলাম। তার যাবতীয় মেইল ডিলিট করে দিলাম। আমাদের একটা রক্ত-মাংসের অমিয়শঙ্কর আছে বর্তমান, কবি একটা একই রকম অমিয়শঙ্করকে বানিয়ে নিয়েছে, সেই অমিয়শঙ্করের রক্ত-মাংস নাই, ক্যামনে কী?–এই জাতীয় জটিলতার মধ্যে থাকতে থাকতে, থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না। বরং আঁখি মুঞ্জিয়া বসে থাকি কিছু অজটিল জোনাকি মাথায় নিয়ে।
অমিয়শঙ্কর, ঘরে ফিরে যা।
১৫.৫.২৫