বিশ্ব ভ্রমণের বিরল অর্জনের পথে নাজমুন নাহার

'পুরো পৃথিবীটাই একটা দেশ, পৃথিবীর সব মানুষই সুন্দর', সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক ভিডিও ইন্টারভিউতে নাজমুন নাহারের এই চমৎকার উক্তি আলোড়িত করেছে নেটিজেনদের।
ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বাইরে গিয়ে এই বিশাল পৃথিবীটাকে দেখার। সেই স্বপ্নপূরণে লাল-সবুজের পতাকা আর বিশ্ব ঐক্যের বার্তা নিয়ে তিনি যাচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে। বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি তার লক্ষ্যে অটল থেকেছেন। ফলে দীর্ঘ ২৫ বছর পর, আজ তিনি তার স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে।
দাদা থেকে শুরু
পৃথিবীর পথে পথে বিচরণকারী একজন সাহসী মানুষ নাজমুন নাহার। স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে চলা এক সংগ্রামী মানুষ। বংশ পরম্পরায় ভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল ১৯২৬ সালে। সেটা ছিল নাজমুন নাহারের দাদার আমল।
দাদা আহাম্মদ উল্লাহ গিয়েছিলেন হজে—পায়ে হেঁটে, জাহাজে চড়ে আরব পেনিনসুলা ঘুরে বেড়িয়েছেন ১৯৩১ সাল অবধি। দাদাকে দেখেননি নাজমুন। তবে বাবার কাছে তার গল্প শুনেছেন। দাদা ১৮ বছর পড়াশোনা করেছেন ভারতের রামপুরে। তারপর ফিকহ শাস্ত্রের ওপর পাণ্ডিত্য লাভ করেন। পড়া শেষ করে দেশেই থিতু হয়েছিলেন।
আহাম্মদ উল্লাহ ছিলেন একজন জনপ্রিয় ধর্মীয় বক্তা। ঘোড়ায় চড়ে তিনি ওয়াজ করতে যেতেন।
নানা বজলুল হক পাটোয়ারীও নাজমুনকে অনুপ্রাণিত করেছেন। খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যরক্ষা সবকিছুতেই তিনি ছিলেন নিয়মানুবর্তী। তিনি নিজেকে জনহিতকর কাজে আজীবন যুক্ত রেখেছিলেন। বেঁচে ছিলেন ১১৪ বছর।
বাবার সঙ্গে নাজমুনের খুব ভাব ছিল। তিনি বলতেন, 'পৃথিবীটা অনেক বড় আর এর সবটাই তোমার যদি তুমি ভয় না পাও।'
পরিবারের সবার ছোট বলে সবারই আদর আহ্লাদ পেয়েছিলেন নাজমুন। তার মেঝো ভাই নবুওয়ত ছোট্টবেলায় তাকে সাইকেল চালাতে শিখিয়েছিলেন। আরেক ভাই দৌলত ছিলেন তার খেলার সাথী। বড় ভাই মুরাদ কিনে দিতেন তাকে গল্পের বই।
পাঠ্যবইতে ভ্রমণের কোনো কিছু থাকলে মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়তেন নাজমুন। মাসুদ রানা পড়েও তার ভ্রমণের আগ্রহ বেড়েছে। ভালোবাসতেন মানচিত্র দেখতেন। ম্যাপে কোন দেশের সঙ্গে কোন কোন দেশের সীমানা আছে, তা বারবার দেখতে পছন্দ করতেন নাজমুন।
নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে গর্বিত ও আশাবাদী হতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ তাকে সাহস যুগিয়েছে। বইয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছ থেকেও তিনি শুনতেন একাত্তরের কথা। আর তখনই স্থির করেন দেশের পতাকা নিয়ে যাবেন পৃথিবীর দেশে-দেশে।

গার্লস গাইডের সদস্য হয়েছিলেন স্কুলে থাকতেই। ক্যাম্পিং, ক্লাইম্বিং তার পছন্দের বিষয় ছিল। স্কুল ও কলেজ শেষ করে নাজমুন ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।
নাজমুন নাহারের প্রথম বিশ্ব ভ্রমণ শুরু হয় ২০০০ সালে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সেটি ছিল ভোপালে। ভারত সেবার গার্লস গাইড স্কাউটদের নিয়ে আয়োজন করেছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রাম। পৃথিবীর ৮০টি দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। নাজমুন বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের মধ্যে নাজমুন নেপাল আর সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন।
লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেলেন
পৃথিবী ভ্রমণের বিরাট স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হবে তার জন্য কখনোই নাজমুন সংকোচ বা সংকট অনুভব করেননি। অর্থ জোগাড় হবে কীভাবে তা নিয়েও ভাবেননি কখনও। অদম্য চেষ্টা আর ইচ্ছে শক্তি দিয়ে শুরু করেছেন পথ চলা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিদেশের কোথাও পড়তে গেলে ভ্রমণের পথটা বেশি উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তাই আবেদন করেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সুযোগ আসে সুইডেনর বিখ্যাত লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার।
নাজমুন ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। স্কুলে তার রোল নম্বর এক থেকে তিনের মধ্যে থাকত সবসময়। তবে কেবল মুখ গুজে পড়ার টেবিলে বসে থাকতেন না। খেলাধুলা ও সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিজ্ঞান মেলা, রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ শিক্ষা সপ্তাহের বিভিন্ন আয়োজনে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন নাজমুন।
২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে নাজমুন পাড়ি জমিয়েছিলেন সুইডেনে। পড়াশোনা আর রাতের ঘুমের বাইরে যেটুকু সময় থাকতো একটি মুহূর্তও তিনি নষ্ট করতেন না। কঠিন পরিশ্রম করে পয়সা উপার্জন করতেন। কখনো ১৭- ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন। প্রতি সামারে টানা তিন মাস কাজ করতেন তিনি। সে পয়সা জমাতেন ভ্রমণের জন্য।
ইউরোপ দিয়ে শুরু
ফুরসত পেলে নাজমুন পৃথিবীর মানচিত্র খুলে বসতেন। পরিকল্পনা করতেন কোন দেশ থেকে কোন দেশে যাওয়া যায় কত কম খরচে। ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগ পড়েছেন অনেক। নাজমুন সুইডেনের আশেপাশের দেশগুলো যেমন—নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক দিয়েই ইউরোপ অভিযাত্রা শুরু করেন।
প্রথম বেছে নিলেন ফিনল্যান্ডকে। বহুতল বিশিষ্ট জাহাজে করে সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত পুরোটাই ছিল বিস্ময়কর অভিযাত্রা। এভাবে জাহাজে করে তিনি ফিনল্যান্ড থেকে যান রাশিয়া, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া। এরপর ভ্রমণ করেন জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও স্পেন।

তারপর সার্বিয়া থেকে আলবানিয়া, মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া পর্যন্ত ভ্রমণ করেন নাজমুন।
তারপর ইতালি, স্পেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো ভ্রমণের মাধ্যমে পুরো ইউরোপ ভ্রমণ সম্পন্ন করেন।
পরে পূর্ব আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, ওশেনিয়া, সাউথ আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চল ভাগ করে ভ্রমণ করেছেন তিনি।
কখনো ১০ দেশ, কখনো ১২ দেশ, কখনো ১৫ দেশ একই সময়ে ভ্রমণ করেছেন নাজমুন। সড়কপথে ভ্রমণ করার উদ্দেশ্য ছিল বাজেট ট্রাভেল এবং পথে পথে অধিকাংশ শহর, নগর, গ্রাম প্রাকৃতিক অঞ্চল ও মানুষের জীবন বৈচিত্র্য দেখা।
২০১৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া থেকে ব্রাজিলের আমাজন পর্যন্ত টানা ভ্রমণ করেছেন চার মাসে ১১ দেশ। ২০১৮ সালে নাজমুন পশ্চিম আফ্রিকায় চার মাসে মৌরিতানিয়া থেকে নাইজেরিয়া পর্যন্ত ১৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এছাড়া, একই বছরে পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে মোজাম্বিক পর্যন্ত ১২ দেশ ভ্রমণ করেছিলেন তিন মাসে।

খরচ যেভাবে কমানো যায়
খরচ কমাতে নাজমুন ল্যান্ড লকড দেশগুলোর একেকটি অঞ্চল নির্বাচন করেন। তারপর প্রথম দেশটিতে বিমানে যান আর বাকি দেশগুলো স্থলপথে ভ্রমণ করেন।
খরচ কমানোর আরেকটি উপায় তিনি বের করেছেন। সেটি হলো নির্দিষ্ট দেশের আশেপাশে সেই দেশের নিকটস্থ ভূখণ্ডের ফ্লাইট কিংবা সমুদ্রপথে যাওয়ার পথ অনুসন্ধান করা। কোনো একটি দেশে বিমানে গিয়ে তারপর সেই দেশ থেকে পরবর্তী দেশগুলো সড়কপথে যাত্রা করেন তিনি।
সুইডেন থেকে মৌরিতানিয়া যেতে তিনি এ পরীক্ষাটি করে সফল হয়েছিলেন। এতে ৬০০ ডলারের খরচ তিনি ২০০ ডলারে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন। তিনি ম্যাপে দেখতে পেয়েছিলেন মৌরিতানিয়ার পাশে স্পেনের একটি দ্বীপ আছে, নাম গ্র্যান্ড ক্যানারিয়া। সুইডেন থেকে মাত্র ৪০ ডলারে সেখানে গিয়ে পরে আরেকটি লোকাল ফ্লাইটে গিয়েছিলেন মৌরিতানিয়া।
নাজমুন নাহার সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে। পড়া শেষ হলে গবেষক হিসাবে কাজ করতে থাকেন। এছাড়া, বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবেও কাজ করেছেন।

নাজমুন ২০১৫ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া বিষয়ে শর্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রামে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন। সেখানে ছিলেন ৪৬ দেশের প্রতিনিধি। তাদের অনেকের সঙ্গেই নাজমুনের ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের দেশে ভ্রমণের সময় গাইড হিসেবে সহযোগিতা করেছেন। যেমন– ইথিওপিয়াতে লোলা নামের এক ক্লাসমেটকে, ইকুয়েডরে পেয়েছিলেন আন্দ্রেয়াসকে। কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং থাইল্যান্ড ও কোরিয়ার বন্ধুরাও তাদের শহরে নামার পর থেকে গাইড হিসেবে সহযোগিতা করেছেন।
কম খরচে বেড়ানোর তিনটি মন্ত্র দিলেন নাজমুন— ১. স্থলপথে বেড়ানো ২. ব্যাকপ্যাক ৭-১০ কেজির মধ্যে রাখা ৩. ইয়ুথ হোস্টেলে থাকা।
ইয়ুথ হোস্টেলে ভাড়া ৩০ ডলারের মধ্যে হয়ে থাকে। তবে সব দেশে ইয়ুথ হোস্টেল নেই; সেসব দেশে কাউচসার্ফিংয়ের মাধ্যমে থাকার সুযোগ আছে। কাউচসার্ফিং ডটকম নামের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এ সংগঠনের সদস্য হওয়া যায়। এটা একটা হোমস্টে পদ্ধতি। স্থানীয় ট্রাভেল হোস্টরা ভিন্ন দেশ থেকে আসা ট্রাভেলার গেস্টদের আমন্ত্রিত করে থাকেন। কোনো দেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে এটি একটি উত্তম মাধ্যম। এক্ষেত্রে অনেক সময় টাকাও নেন না হোস্টরা। একটি গিফট বা স্যুভেনিয়র দিলেই হোস্টরা অনেক খুশি হন।
দুর্গম গিরি, দুস্তর পারাবার
নাজমুন দেশে দেশে গিয়ে সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে ভালোবাসেন; স্থানীয় খাবার খান; স্থানীয় পোশাকও পরে থাকেন। তিনি পায়ে হেঁটে, বাইকে কিংবা লোকাল বাসে চড়ে, মানে যেটা যেখানে সহজলভ্য সেটাতে করেই ভ্রমণ করেছেন। নজরুলের কবিতার মতো দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার তিনি পাড়ি দিয়েছেন দিনে বা রাতে।
কিরগিজস্থানের আলা আরচা মাউন্ট সামিট থেকে ফেরার পথে তার পা পিছলে যায়, একটি গাছের ডাল ধরে ঝুলে থাকতে হয়েছিল, নইলে শত শত ফুট নিচে গিয়ে পড়তে হতো। পরে একজন সহযাত্রী তাকে উদ্ধার করেন।

কোস্টারিকার গোয়ান ক্যাসেল ব্রাজিলিতো নদীর স্রোতে আটকা পড়ে স্রোতের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যেতে যেতে আবার স্রোতের বিপরীতে তিনি সাঁতরাতে থাকলেন। চিৎকার করছিলেন, আর উল্টোদিকে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে এক লোক এসে তাকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যায়। নাজমুন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তুমি কে ভাই?' লোকটি উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমি এখানকার স্থানীয় একজন, প্রার্থনা করছিলাম সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে, তোমার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলাম।'
পেরুর ১৪ হাজার ২০০ ফুট উঁচু রেইনবো মাউন্ট সামিটে যাওয়ার সময় অলটিচিউডের প্রব্লেম হয়েও সেখানে উড়িয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে রক্ষা পেয়েছেন।
তিনি সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিয়েছিলেন বালু ঝড়ের মধ্যে। হাঁটতে-হাঁটতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সারাদিন পর একটু পানি পেয়ে যেন জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। তাইওয়ান থেকে ফিলিপাইন যাওয়ার পথে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হচ্ছিল, চীন সমুদ্র পার হওয়ার সময় বিমানে ভয়াবহ ঝাঁকি অনুভব করেছিলেন।
আফগানিস্তান ও আফ্রিকা যেমন
আফগানিস্তানের খাইবার পাস প্রকৃতির এক অদ্ভুত সুন্দর গিরিখাত। কিন্তু দুর্গম সেই গিরিপথ অতিক্রমের সময় রাস্তায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
তালেবানরা আপনাকে কেমন আতিথেয়তা দিয়েছিল? জানতে চাইলে তিনি বললেন, "আফগানিরা মানুষ হিসাবে খুবই অতিথিপরায়ণ। ভিসা, ইমিগ্রেশন এবং ভ্রমণের সময় আফগানিস্তানের পথে পথে তালেবান আর্মিকে অনেক জায়গায় ফেস করতে হয়েছে, সব জায়গায় তালেবানরা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছেন।"
নাজমুন বলেন, "আমি মনে করি, স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে ভ্রমণ সহজ হয়। ল্যান্ড বর্ডার ইমিগ্রেশনে তালেবানরা যখন দেখলেন আমি একজন ট্রাভেলার এবং আমাকে বোরকা পরা দেখে তারা খুশি হয়ে বললেন, 'তুমি আমাদের দেশের কালচারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেছ, তোমাকে অভিনন্দন'।"
এই সূত্র ধরেই আরেকটি প্রশ্ন করলাম, আমরা যে ভাবি আফ্রিকা ডার্ক ওয়ার্ল্ড, সেটা কতটা সত্য?

নাজমুন বললেন, "আফ্রিকার কথা শুনলেই মানুষ ভয় পায়–এটা একটা প্রোপাগান্ডা। টুরিস্টদের প্রতি আফ্রিকানরা খুবই সহনশীল এবং তারা মনে করে, টুরিস্টরা তাদের দেশে এঞ্জেলের মত মেহমান হয়ে এসেছেন।"
"সড়কপথে আমি আফ্রিকার ল্যান্ড–লকড ৪৬টি দেশ ভ্রমণ করেছি, সেক্ষেত্রে দুর্গম পথের বৈরীতা থাকলেও প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ ছিল খুবই ওয়েলকামিং," যোগ করেন তিনি।
শুধুমাত্র মালির বর্ডারে কাছাকাছি, সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ কিংবা কঙ্গোর বিশেষ দুই-একটি প্রদেশ ছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় ওখানকার লোকাল মানুষ কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করেনি। সমস্যা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় হতে পারে যদি সেটা দুর্ভাগ্য হয়, সেটা শুধু আফ্রিকা নয়—এমনটাই জানালেন নাজমুন
আফ্রিকার রুয়ান্ডা, জাম্বিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, মিশর, সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া, অ্যাঙ্গোলা মোটামুটি উন্নত দেশ। সেখানকার মানুষগুলো সাদাসিধা, এখানকার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি খুবই অপূর্ব।
অপূর্ব এ পৃথিবী
পৃথিবীর সব দেশেই কোনো না কোনো বিশেষ সৌন্দর্য রয়েছে। তবে নাজমুনের কাছে সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে আইসল্যান্ড, নামিবিয়া, পেরু, চিলি, রুয়ান্ডা, গ্রেনাডা। আইসল্যান্ডে একসাথে অনেক বিস্তৃত সুন্দর প্রকৃতি রয়েছে।

আইসল্যান্ড দেখতে ভিন্ন প্ল্যানেটের মত। সেখানকার ল্যান্ডমান্নালুগার পর্বত ভ্যালিতে যাওয়ার সময় বিভিন্ন ধরনের পাহাড়ের ভ্যালির গায়ে প্রাকৃতিক রং, গ্লেসিয়ার, মাউন্ট স্টোন ভ্যালি, জলপ্রপাত, হট স্প্রিং দেখেছেন নাজমুন–সব মিলিয়ে আইসল্যান্ড অপূর্ব বলে জানান।
এছাড়া, দারুণ রোমাঞ্চিত হয়েছেন টোঙ্গার আনাহুলু গুহায় গিয়ে। মনে হয়েছিল, ইন্ডিয়ানা জোনসের ছবির সেটে ঢুকে পড়েছেন। একই অনুভূতি হয়েছিল পেরুর মাচু পিচ্চুতে গিয়েও। নাজমুন সেনেগালে দেখেছেন রোজ রিভার, মৌরিতানিয়ার মরুভূমির মধ্যে ওয়াটার লেকও তার ভালো লেগেছে।
"নামিবিয়াতে সোসাসভ্লেইয়ের মরু মিশেছে আটলান্টিকের নীল পানিতে। সেখানে ক্যাম্পিং করে রাতের তারার নিচে ঘুমিয়েছি, আর সূর্যাস্ত দেখেছি সেই ডেজার্টের মধ্যে। সেটা ছিল এক অসাধারণ মনোমুগ্ধকর অনুভূতি," বলেন নাজমুন।
'নো ওয়ার, ওনলি পিস'
নাজমুনের মতে, পৃথিবীর সেরা রুটি রাশিয়ান, সেরা ব্রেকফাস্ট তুরস্ক ও ইরানের, সেরা খাবার লেবাননের। তিনি গান শুনতে পছন্দ করেন, বিশেষ করে জীবনমুখী গান। পাহাড় ভেদ করে সূর্য ওঠা শহরগুলোর সৌন্দর্য তাকে বেশি মুগ্ধ করে।

তার মতে, মাতৃভূমির মতো শান্তির জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন, পরিবারের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখেন। একেক দফার ভ্রমণ শেষে যখন দেশে ফেরেন, তখন নিজের পছন্দের দেশীয় খাবারগুলো খান। দেশের ৪৭টি জেলায় তিনি গেছেন। মাকে নিয়ে গেছেন পৃথিবীর ১৪টি দেশে।
নাজমুন পৃথিবী বেড়ান বাংলাদেশের পতাকা ও তিনটি প্ল্যাকার্ড সঙ্গে করে, সেগুলোতে লেখা থাকে– নো ওয়ার, ওনলি পিস; সেইভ দ্য প্লানেট; স্টপ চাইল্ড ম্যারেজ।
২০১৮ সালের ১ জুন নাহার ১০০তম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ে সীমান্তের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ওপর।
২০২১ সালের ৬ অক্টোবর নাজমুন নাহার ১৫০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক অর্জন করেন আফ্রিকার দ্বীপ দেশ সাওটোমে অ্যান্ড প্রিন্সিপ ভ্রমণের মাধ্যমে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৭৫ দেশ ভ্রমণের আরেকটি রেকর্ড সৃষ্টি করেন ওশেনিয়া মহাদেশের দেশ ভানুয়াতু'তে।
১৭৮তম দেশ ভ্রমণের রেকর্ড করেন পাপুয়া নিউগিনিতে।

ওশেনিয়ার সলোমন আইল্যান্ড ভ্রমণের সময় সেখানকার জনপ্রিয় তাভুলি নিউজে নামকরা সাংবাদিক জর্জিনা কেকেয়া তাকে নিয়ে ফিচার লেখেন। এছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশের সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন নাজমুন। অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে। গেস্ট স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন দেশ-বিদেশে। বিশ্ব-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তরুণদের মাঝে।
এ পর্যন্ত তিনি ৫৬টি অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা লাভ করেছেন। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পিস টর্চ বিয়ারার সম্মাননা খুবই গুরুত্বপূর্ণ— যেটি মাদার তেরেসা, গর্বাচভের মতো ব্যক্তিরা লাভ করেছিলেন। জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে পেয়েছেন ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি, সেন্ট লুশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ব্রেভ গার্ল উপাধি।
নাজমুনের ঘোরা বাকি আছে বিশ্বের আর মাত্র ২৩টি দেশ। এগুলো ভ্রমণ হলেই তিনি বিশ্বের প্রথম পতাকাবাহী মুসলিম নারী ও প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে বিরল গৌরব অর্জন করবেন।
ছবি সৌজন্য : নাজমুন নাহার