বিমান যাত্রায় ঝাঁকুনি কেন আগের চেয়ে বেশি? কেন তীব্রতা বাড়ছে?

অ্যান্ড্রু ডেভিস নিউজিল্যান্ডে যাচ্ছিলেন 'ডক্টর হু' প্রদর্শনীর কাজ করতে। তিনি ছিলেন প্রজেক্ট ম্যানেজার। লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত তার ফ্লাইটের প্রথম অংশটা বেশ স্বাভাবিকই ছিল। হঠাৎ করেই শুরু হলো ভয়াবহ ঝাঁকুনি। খবর বিবিসির।
"মনে হচ্ছিলো যেন একটা রোলার কোস্টারে উঠেছিলাম," স্মৃতিচারণ করলেন ডেভিস। "প্রথমে মনে হলো কেউ আমাকে চেয়ারে ঠেলে দিল। তারপর হঠাৎ করেই বিমানটা নিচে পড়তে লাগল। আমার আইপ্যাড মাথায় এসে লাগল, কফি ছিটকে পড়ে গেল আমার গায়ে। কেবিনজুড়ে যেন তাণ্ডব, মানুষ ছিটকে পড়েছে, জিনিসপত্র উলটপালট হয়ে গেছে।"
"মানুষ কাঁদছিল, চারপাশে একটা হতবাক অবস্থা," বললেন তিনি।
তবে ডেভিস বলছেন, তিনি "ভাগ্যবানদের একজন" ছিলেন।
অন্যান্য যাত্রীরা কাটা-ছেঁড়া ও হাড়ভাঙার মতো গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। ৭৩ বছর বয়সী জিওফ কিচেন হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
তবে ঝাঁকুনির কারণে মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত বিরল। অফিসিয়াল কোনো সংখ্যা নেই, তবে ১৯৮১ সালের পর থেকে এমন মৃত্যু হয়েছে আনুমানিক মাত্র চারটি। তবে আঘাতের পরিসংখ্যান একেবারে ভিন্ন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২০০৯ সালের পর থেকে ২০৭টি গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১৬৬ জনই ছিলেন কেবিন ক্রু (অনেকে হয়তো তখন বসে ছিলেন না)।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বায়ুমণ্ডলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। ফলে আগামী দিনে বিমান ভ্রমণ আরও বেশি অস্থির ও ঝাঁকুনিময় হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। উপরের বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা ও বাতাসের গতিপথে বড় পরিবর্তন আসছে, যা ঝাঁকুনির মাত্রা ও ঘনত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
রিডিং ইউনিভার্সিটির আবহাওয়াবিদ অধ্যাপক পল উইলিয়ামস বলছেন, "বর্তমানে আপনি যদি ১০ মিনিট ভয়াবহ ঝাঁকুনি অনুভব করেন, আগামী দিনে সেটা ২০ থেকে ৩০ মিনিটে পৌঁছাতে পারে।"
"পরবর্তী কয়েক দশকে ঝাঁকুনির পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে।"

তবে প্রশ্ন হলো, ঝাঁকুনি যদি আরও তীব্র হয়, তাহলে কি ঝুঁকিও বাড়বে? না কি বিমানের কাঠামো ও প্রযুক্তিতে কিছু পরিবর্তন এনে এগুলো ঠেকানো সম্ভব?
উত্তর আটলান্টিকের 'ঝাঁকুনি-পথ'
ভয়াবহ ঝাঁকুনি বলতে বোঝায়, যখন বিমানের ওঠানামা এতটাই বেশি হয় যে যাত্রীর শরীরে ১.৫ জি-ফোর্সের মতো চাপ পড়ে, যার ফলে আপনি যদি সিটবেল্ট না পরে থাকেন, তাহলে আসন থেকে ছিটকে উঠতে পারেন।
প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ফ্লাইটের মধ্যে আনুমানিক ৫ হাজার ফ্লাইটে ভয়াবহ ঝাঁকুনির ঘটনা ঘটে।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (ICAO) বার্ষিক নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিমানে যাত্রীদের গুরুতর আঘাতের প্রায় ৪০ শতাংশই হয়েছিল ঝাঁকুনির কারণে।
যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের পথে ঝাঁকুনি বিশেষভাবে বেড়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পর গত ৪০ বছরে উত্তর আটলান্টিকে ভয়াবহ ঝাঁকুনির পরিমাণ বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু উত্তর আটলান্টিক নয়, পূর্ব এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও ঝাঁকুনি বাড়তে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত
ঝাঁকুনির প্রধানত তিনটি ধরন আছে, কনভেকটিভ (বজ্রপাত বা মেঘঘন এলাকায়), অরোগ্রাফিক (পাহাড়ি এলাকার বাতাসে), ও ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স (পরিষ্কার আকাশে হঠাৎ বাতাসের গতিবদল)।
প্রথম দুই ধরনের ঝাঁকুনি কিছুটা আগে থেকে বোঝা যায় ও এড়িয়ে চলা যায়। তবে ক্লিয়ার-এয়ার ঝাঁকুনি দেখা যায় না, আর অনেক সময় হঠাৎ করেই শুরু হয়। এই ঝাঁকুনিগুলো এখন বাড়ছে, যার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।
উষ্ণ বায়ুমণ্ডল বেশি জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে। এই অতিরিক্ত তাপ ও আর্দ্রতা বজ্রঝড়কে আরও ভয়াবহ করে তোলে। বজ্রঝড় তৈরি করে ভয়ংকর উর্ধ্ব-অধঃগতির বাতাস, যা থেকেই তৈরি হয় কনভেকটিভ ঝাঁকুনি।
২০২৪ সালে অ্যান্ড্রু ডেভিসের বিমানে যে ভয়াবহ ঝাঁকুনি হয়েছিল, সেটাও ছিল এ রকম এক বজ্রঝড়ের ফল। সিঙ্গাপুরের ট্রান্সপোর্ট সেফটি ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানটি মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলে এক 'বিকাশমান ঝড়ের' উপর দিয়ে যাচ্ছিল, যার ফলে মাত্র পাঁচ সেকেন্ডেই এটি ১৭৮ ফুট নিচে নেমে গিয়েছিল।
আকাশে বজ্রপাত বাড়ার প্রমাণও রয়েছে।
২০১৪ সালে সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, গড় তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে, বজ্রপাতের পরিমাণ ১২% পর্যন্ত বাড়ে।
বাণিজ্যিক বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন নাথান ডেভিস জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি অনেক বড় বজ্রঝড় লক্ষ্য করেছেন, ৮০ মাইল ব্যাসের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এসব ঝড়। তবে তিনি বলেন, "এগুলো চোখে দেখা যায়, তাই আমরা চারদিক ঘুরিয়ে উড়ে যেতে পারি।"
তবে সমস্যার জায়গা হলো ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স। এটি সৃষ্টি হয় জেট স্ট্রিমে, অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের প্রায় ছয় মাইল উচ্চতায় প্রবাহিত দ্রুতগামী বায়ুপ্রবাহে।

জেট স্ট্রিমের উত্তর দিকে থাকে ঠান্ডা বাতাস, আর দক্ষিণে গরম। এই তাপমাত্রার পার্থক্য একদিকে যেমন বিমানের জন্য সহায়ক টেইলউইন্ড তৈরি করে, অন্যদিকে ঝাঁকুনির পরিবেশও তৈরি করে।
রিডিং ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পল উইলিয়ামস বলছেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জেট স্ট্রিমের দক্ষিণ দিকটা আরও বেশি উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে, এতে করে তাপমাত্রার ব্যবধান আরও বাড়ছে, ফলে বায়ুপ্রবাহ আরও অস্থির হয়ে উঠছে।"
সবাইকে ভাবায় এই পরিবর্তন
এমন ভয়াবহ ঝাঁকুনি, যেটা মানুষকে আসন থেকে ছিটকে ফেলতে পারে, ভবিষ্যতে আরও আঘাত বা মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।
অ্যান্ড্রু ডেভিস বলেন, "আমি শুধু নিজের জন্য নয়, আমার সন্তানদের জন্যও ভয় পাই।"
ইউগভের এক জরিপ বলছে, যুক্তরাজ্যের প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন বিমানে চড়তে ভয় পান। ওয়েন্ডি বার্কার নামে এক নার্ভাস ফ্লায়ার বলেন, "ঝাঁকুনি মানেই আমার কাছে বিপদের আশঙ্কা। আমি মনে করি তখন বাঁচার সম্ভাবনা কমে যায়।"
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক বিমান অনেক মজবুতভাবে তৈরি।
সাবেক পাইলট ও প্রশিক্ষক ক্রিস কিয়ান বলেন, "৭৪৭ বিমানের পাখা 'ডেস্ট্রাকটিভ টেস্ট'-এ ২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেঁকে গেলেও ভাঙে না, এটা সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে হয় না।"
তবে বিমান সংস্থাগুলোর জন্য নতুন চিন্তার জায়গা তৈরি হচ্ছে, তীব্র ঝাঁকুনির গোপন ব্যয়।
ব্রিটেনের মেট অফিসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এভিটেক-এর হিসাব অনুযায়ী, একেকটি বিমানসংস্থার বছরে £১.৮ লাখ থেকে £১৫ লাখ পর্যন্ত খরচ হয়ে যেতে পারে ঝাঁকুনির কারণে।
এই খরচের মধ্যে পড়ে বিমান মেরামত, যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ, ফ্লাইট ডাইভার্ট বা দেরির খরচ, এমনকি ভুল জায়গায় পৌঁছানোর খরচও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ এমন পরিস্থিতি আরও বাড়বে।
বিমানকে ঝাঁকুনি-মুক্ত করতে কী হচ্ছে?
ঝাঁকুনি আগেভাগে জানার প্রযুক্তি আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। অধ্যাপক উইলিয়ামস বলছেন, "২০ বছর আগে আমরা হয়তো ৬০% ক্লিয়ার-এয়ার ঝাঁকুনি পূর্বাভাস দিতে পারতাম। এখন সেটা বেড়ে ৭৫%।"

পাইলটদের হাতে থাকে আধুনিক রাডার, যা সামনে ঝড় শনাক্ত করে। ক্যাপ্টেন ডেভিস জানান, "ফ্লাইট শুরুর আগে আমরা রুট অনুযায়ী ঝাঁকুনির পূর্বাভাসসহ পরিকল্পনা পাই।"
আমেরিকার সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স এখন কেবিন সার্ভিস বন্ধ করছে আরও উচ্চতায়, যাতে ক্রু ও যাত্রীরা আগেভাগেই সিটবেল্ট বেঁধে বসে থাকেন। এতে ২০% আঘাত কমবে বলে তারা দাবি করছে।
এমনকি কোরিয়ান এয়ার এখন অর্থনীতি শ্রেণির যাত্রীদের কাছে নুডলস পরিবেশন বন্ধ করেছে, কারণ ঝাঁকুনিতে গরম নুডলস ছিটকে যাত্রীরা পুড়ে যেতে পারেন।
উত্তর খুঁজছে গবেষকরা, পেঁচা থেকে এআই পর্যন্ত
গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, পেঁচা ঝড়ো বাতাসেও ধীরে-নিরবচ্ছিন্নভাবে উড়তে পারে, কারণ তার ডানার গঠন ঝাঁকুনিকে শোষণ করে নেয়। এই ধারণা থেকে 'হিংড উইং' ডিজাইন ছোট বিমানে প্রয়োগের চেষ্টা চলছে।
অস্ট্রিয়ার এক কোম্পানি 'টার্বুলেন্স সল্যুশনস' দাবি করছে, তাদের সেন্সরযুক্ত উইং ফ্ল্যাপ হালকা বিমানে ৮০% পর্যন্ত ঝাঁকুনি কমাতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় চালু হয়েছে এআই প্রযুক্তি, 'FALCON', যা বাতাসের গতিপথ বুঝে উইং ফ্ল্যাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে বিমান প্রকৌশলী ফিনলে অ্যাশার বলছেন, "এই প্রযুক্তি বাণিজ্যিক বিমানে আসতে আরও কয়েক দশক লাগবে।"
ঝাঁকুনি বাড়লেও এটি সাধারণত উত্তেজনাকর হলেও ভয়ংকর নয়, বলছেন ক্যাপ্টেন ডেভিস।
অ্যান্ড্রু ডেভিস এখন প্রতিটি ফ্লাইটেই একেবারে সতর্ক থাকেন, "সিটে বসেই বেল্ট বেঁধে ফেলি। কোথাও উঠলে সময় বুঝে উঠি, আবার দ্রুত বসে পড়ি।"
তবে তিনি বলেন, "ভ্রমণের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি। তারপরও, আমি এই অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজের জীবনকে আটকাব না।"
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা