কর ফাঁকি: ১৫০ প্রকৌশলী, বিচারক ও পাসপোর্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর ফাঁকির বিরুদ্ধে নেওয়া দৃঢ় এক উদ্যোগের অংশ হিসেবে, সরকারি প্রকৌশলী, বিচারক এবং পাসপোর্ট অফিসারসহ ১৫০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আয় ও সম্পদ গোপনের মাধ্যমে কর ফাঁকির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট (আইটিআইআইইউ)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কর বিভাগের গোয়েন্দা শাখা আইটিআইআইইউ- এর কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রাকিব টিবিএসকে বলেন, "আমরা বিভিন্ন সরকারি অফিসের ইঞ্জিনিয়ার, জজ, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাসহ নতুন করে প্রায় ১৫০ জনের ট্যাক্স ফাইল অনুসন্ধান শুরু করেছি। প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় সবার ফাইলেই কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে।"
তিনি বলেন, "এর মধ্যে ছয় জন তাদের কর ফাঁকি স্বীকার করে ইতোমধ্যে ট্যাক্স পরিশোধ করেছেন, যার পরিমাণএকেক জনের কমপক্ষে এক কোটি টাকা।"
এই তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের পদ-পদবী বেশ ক্ষমতাধর, প্রায় ১০০ জন রয়েছেন যারা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত।
তাদের সঙ্গে রয়েছেন ২৫ জন বিচারক, ১০ জন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট কর্মকর্তা এবং ওয়াসা, রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা।
গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই তদন্ত শুরু হয় বলে জানিয়েছে আয়কর গোয়েন্দা বিভাগের অভ্যন্তরীণ সূত্র। এরপরই শুরু হয় সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের কর ফাইলের বিস্তৃত অনুসন্ধান, যেখানে কর ফাইলে অঘোষিত আয়, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ ঘোষণা এবং অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে দুটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায়, যারমধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা এবং এলজিইডির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায় ১০ কোটি টাকার অঘোষিত সম্পদের অধিকারী তারা। এদের মধ্যে একজন ইতোমধ্যেই ১ কোটি টাকা করফাঁকি স্বীকার করে তা পরিশোধ করেছেন।
আয়কর গোয়েন্দার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় সবার ফাইলেই কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয় কর্মকর্তা তাদের করফাঁকি স্বীকার করে ইতিমধ্যে কর পরিশোধ করেছেন, বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে।
কর কর্মকর্তারা বলছেন, এই শুধু তদন্তে ব্যক্তি পর্যায়ের নয়, বরং আরও গভীর ও কাঠামোগত ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অনৈতিকতায় জড়ানো উদঘাটিত হতে পারে।
ফলে এই তদন্ত নিছক করদাতার হিসাব খতিয়ে দেখার বিষয় না। গত ছয় মাসে আইটিআইআইইউ প্রায় ৩০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর ফাইল পর্যালোচনা করে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার কর ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে। এর মধ্যে ১১৮ কোটি টাকা ইতোমধ্যে আদায় করা হয়েছে, যা ক্ষমতাবানদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার দৃঢ় পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আয়কর গোয়েন্দা অফিসের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৫০ ব্যক্তির ঘোষিত ও অঘোষিত স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আয় গোপনের উৎস চিহ্নিত করতে তদন্তকারীরা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার, বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (রিহ্যাব), ভূমি অফিস, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য চেয়েছেন।
কর ফাইলের অনুসন্ধানে যে চিত্র উঠে আসছে
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, যাঁরা কর ফাঁকির দায় স্বীকার করে পরিশোধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী। যিনি নিজের ও স্ত্রীর অঘোষিত আয় মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি টাকার কর গোপনের কথা স্বীকার করে ইতিমধ্যে সেই অর্থ পরিশোধ করেছেন।
অবশ্য যোগাযোগ করা হলে ওই প্রকৌশলী টিবিএসকে বলেন, 'আমার ট্যাক্স ফাইলের বাইরে কোন অ্যাসেট নেই বা অবৈধ ইনকাম নেই।'
এপ্রসঙ্গে আয়কর গোয়েন্দার সেই কর্মকর্তা বলেন, "যদি ফাঁকি না থাকবে, তাহলে টাকা পরিশোধ করলেন কেন?"
তালিকায় রয়েছেন সিলেট এলজিইডির এক নির্বাহী প্রকৌশলীও। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি ফরিদপুরে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন, যখন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে কুমিল্লায় তিনি দায়িত্ব পালন করেন তাজুল ইসলাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রী থাকাকালে।
আয়কর গোয়েন্দার ওই কর্মকর্তা জানান– ওই কর্মকর্তা, তার স্ত্রী ও মেয়ে'র নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৮০টির বেশি এফডিআর পাওয়া গেছে। তাঁর স্ত্রী ২০২৯-২০ অর্থবছরে দেড় কোটি কালো টাকা সাদা করেছেন। ভুয়া মৎস্য খামার এর আয় দেখিয়েছেন।
"তার তিন কোটি টাকার বেশি কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে"– বলেন তিনি।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও তার পরিবারের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। এই সংক্রান্ত নথিপত্রের একটি অনুলিপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।
যোগাযোগ করা হলে ওই এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী অবৈধ আয় বা কর ফাঁকির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, "আমার ট্যাক্স ফাইলে কোনো সমস্যা নেই।"
অবশ্য তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবং তার ট্যাক্স ফাইল ট্যাক্স ইন্টেলিজেন্স অফিস কর্তৃক অ্যাসেস করা হচ্ছে বলেও জানান।
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে এবং তার কর ফাইল বর্তমানে আয়কর গোয়েন্দা অফিস খতিয়ে দেখছে। তিনি বলেন, "তারা ট্যাক্স ফাইল অ্যাসেস করছে, আশা করছি সহসা অ্যাকাউন্ট ওপেন করে দেবে।"
আয়কর গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রকৌশলীর আইনজীবী রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইটিআইআইইউ অফিসে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। আগামী সপ্তাহেও তিনি আসবেন।
এছাড়া, ২৫ জন বিচারকের কর ফাইল তদন্তাধীন রয়েছে, যাদের মধ্যে ১৮ জন বিচারককে গত ১০ জুলাই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ জন জেলা জজ, দুইজন অতিরিক্ত জেলা জজ ও এক জন যুগ্ম জেলা জজ রয়েছেন।
এই অভিযানের আগেই, আইটিআইআইইউ ৩০০ জনের বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল, যার মধ্যে রয়েছেন পুলিশ, বিচারক, শিল্পী, সাংবাদিক ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা এবং গত সংসদের ৫০ জন নারী সাংসদ।
প্রসঙ্গত, আয়কর বিভাগ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবৈধ আয়ের বিষয়টি অনুসন্ধান করে না বা এর জন্য শাস্তির বিধানও নেই। তবে আয়কর ফাইলে দেখানো আয়ের বাইরে কোন সম্পদ বা আয়ের সন্ধান পেলে এর উপর করারোপ করতে পারে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবৈধ আয় অনুসন্ধান করা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে কর ফাঁকি সংক্রান্ত তদন্তে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) ও আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট (আইটিআইআইইউ) কাজ করে।
এছাড়া ভ্যাট সংক্রান্ত ফাঁকি তদন্তে, ভ্যাট গোয়েন্দা ইউনিট এবং কাস্টমসের ফাঁকি তদন্তে কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট নামে আলাদা দুটি ইউনিট কাজ করে।