সিআইএ-এর গোপন ঘাঁটি ছিল এ রানওয়ে; পরিচিত ছিল বিশ্বের ‘সবচেয়ে গোপন স্থান’ হিসেবে

লাওসের মধ্যাঞ্চলের ঘন ও উত্তপ্ত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সাড়ে চার হাজার ফুট দৈর্ঘ্যের ফাটল ধরা একটি রানওয়ে। কিন্তু এর নেই কোনো বিমানবন্দর। আর রানওয়েটি এমন এক গ্রামে যেখানে অনেকে কখনোই প্লেনে ওঠেনি।
কিন্তু ভাঙাচোরা কন্ট্রোল টাওয়ার ও বোমায় ক্ষতবিক্ষত রানওয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে আমেরিকার স্নায়ু যুদ্ধের ইতিহাসের এক গোপন অধ্যায়। এটি এমন এক স্থান, যাকে একসময় বলা হতো 'পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন স্থান'।
লং টিয়েং নামের গ্রামটি লাওসের মধ্যভাগে, রাজধানী ভিয়েনতিয়ানের প্রায় ৮০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। আজ এটি একটি নিস্তেজ ছোট্ট জনপদ, যেখানে কয়েক হাজার মানুষ প্রধানত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
গ্রামটিতে রয়েছে দুটি রেস্তোরাঁ, দুটি অতিথিশালা এবং কয়েকটি বহুমুখী দোকান, যেখানে চাল থেকে শুরু করে পুরোনো বোমার খোলস দিয়ে তৈরি কৃষি সরঞ্জাম পর্যন্ত সবকিছুই বিক্রি হয়। গ্রামটি এখনও কৃষিভিত্তিক জীবনধারা এবং যুদ্ধকালীন অতীতের ইঙ্গিত বহন করে চলছে।
গ্রামের কেন্দ্রে থাকা রানওয়েটি আর বিমান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয় না। এখন এটি এক ধরনের উন্মুক্ত কমিউনিটি সেন্টারের মতো। এখানে শিশুরা স্কুটার চালায়, কৃষকরা গবাদিপশু নিয়ে যায়, আর প্রবীণরা ভোরের শুরুর দিকে হাঁটাহাঁটি করেন।
তবে ৫০ বছর আগে দৃশ্যপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিজমের বিস্তার রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় লাওস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। লং টিয়েং ছিল একটি গোপন ঘাঁটি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত হমং জাতিগোষ্ঠীর একটি অ্যান্টি-কমিউনিস্ট বাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারা যুদ্ধ করছিল কমিউনিস্ট পাতেত লাও বাহিনীর বিরুদ্ধে, যাদেরকে সহায়তা দিচ্ছিল উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী।
এই ঘাঁটির সর্বোচ্চ কার্যকলাপের সময়, এখানে বসবাস করতেন হাজারে হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন— হমং সেনারা, তাদের পরিবার, লাওসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা, থাই সেনারা এবং কিছু সংখ্যক মার্কিন সিআইএ কর্মকর্তা ও গোপন মার্কিন বিমানবাহিনীর পাইলট, যাদের 'রেভেন' নামে ডাকা হতো। এটি ছিল সিআইএ পরিচালিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আধাসামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু।
একসময় এই ছোট রানওয়েতে প্রতিদিন ৯০০ বার বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করতো, যা এটিকে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বিমানঘাঁটিতে পরিণত করেছিল। কার্গো বিমানগুলো গোলাবারুদ ও খাবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম নামিয়ে দিত, যা পরবর্তীতে ছোট ছোট বিমানে তুলে দেশের আরও দূরবর্তী ও গোপন রানওয়েগুলোতে পাঠানো হতো।
ঘাঁটিটির ব্যাপকতা সত্ত্বেও, এটি এতটাই গোপন ছিল যে যুদ্ধের অন্য অংশে জড়িত অনেকেই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন না, বলছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দা এবং 'লাওস সিক্রেট ওয়ার'-এর বিশেষজ্ঞ পল কার্টার।

'লাওসে যুদ্ধ এতটাই ভাগ করা ছিল... আমি এমন অনেক লোককে চিনি, যারা ওই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তারা লং টিয়েং-এর অস্তিত্ব পর্যন্ত জানতেন না। তিনি সিএনএনকে জানান ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেওয়ার পরেই তারা এর সম্পর্কে জানতে পারেন।
এই দূরবর্তী পার্বত্য গ্রাম থেকেই সিআইএ-সমর্থিত হমং বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যারিশমাটিক জেনারেল ভ্যাং পাও। তিনি শুধু কমিউনিস্ট পাতেত লাও-দের সঙ্গেই যুদ্ধ করেননি বরং উত্তর ভিয়েতনামের সরবরাহ কেন্দ্র ধ্বংস, গুরুত্বপূর্ণ রুট উড়িয়ে দেওয়া এবং সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট বাহিনীকে উত্ত্যক্ত করার মতো গেরিলা অভিযানও পরিচালনা করেছিলেন।
এই গোপন যুদ্ধের অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র লাওসে একটি নৃশংস বোমাবর্ষণ অভিযান শুরু করে, যা ভিয়েতনামে তাদের বৃহত্তর সামরিক অভিযানের মতোই ছিল। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো লাওসে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করায়, প্রায় পুরো দায়িত্বটাই এসে পড়ে সিআইএ'র ওপর।
লং টিয়েং-এর রানওয়ে থেকে হাজার হাজার মিশনে অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন পাইলটরা। এই ঘাঁটিকে 'লিমা সাইট ৯৮' এবং 'লিমা সাইট ২০এ' — এই কোডনামগুলোতে ডাকা হতো।

লং টিয়েং-এ যাত্রা
লং টিয়েং-এর পতনের ৫০ বছর পর, ১৯৭৫-এর সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের অর্ধশতক পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির নিঃশেষিত চিহ্নগুলোর খোঁজে বেরিয়েছিলেন সিএনএন-এর সাংবাদিক।
সাংবাদিক বলেন, 'আমার আগ্রহ জন্মায় জোশুয়া কারলান্টজিক-এর লেখা "অ্য গ্রেট প্লেস টু হ্যাভ আ ওয়ার" বইটি পড়ে। বইটি আমাকে এমন এক জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যার কথা আগে কখনো শুনিনি — ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছায়ায় ঢাকা একটি গোপন সস্নায়ু যুদ্ধের রণক্ষেত্র।
তিনি বলতে থাকেন, 'পুরোনো, দানাদার ভিডিওতে দেখা যেত কীভাবে সাংবাদিকরা ঘাঁটির ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন — এসব দৃশ্য আমার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে তোলে। এক সময় মনে হলো, আমাকে নিজ চোখে লং টিয়েং দেখতে হবেই।'
'কিছুদিনের মধ্যেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই লাওসের রাজধানী ভিয়েনতিয়ানে — সঙ্গে আছেন আমার এক পুরোনো কলেজ বন্ধু, যাকে আমি এই অভিযানে সঙ্গী হওয়ার জন্য রাজি করিয়েছি, এবং মি. পাও — একমাত্র ড্রাইভার যিনি এই পথ পাড়ি দেওয়ার মতো গাড়ি নিয়ে আসতে রাজি হয়েছেন।'
পাও জানান, তিনি একসময় লং টিয়েং-এর কাছে একটি খনিতে কাজ করতেন এবং এলাকাটি তার কিছুটা চেনা। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, জীবনে মাত্র একবারই ওই গ্রামে গিয়েছেন।

কয়েকটি ট্যুর কোম্পানি লং টিয়েং ভ্রমণের আয়োজন করে, তবে লুয়াং প্রাবাং কিংবা ভ্যাং ভিয়েং-এর মতো লাওসের জনপ্রিয় পর্যটনস্থলগুলোর তুলনায় এখানকার দর্শনার্থীর সংখ্যা এখনও অতি সামান্য।
লাওস অ্যাডভ ট্যুরস অ্যান্ড রেন্টালস-এর মালিক ক্রিস করবেট সিএনএনকে বলেন, তার কোম্পানি প্রতিবছর প্রায় ১০টি মোটরবাইক ট্যুর পরিচালনা করে, যার মাধ্যমে প্রায় ৪০ জন পর্যটক লং টিয়েং-এ যান। তিনি জানান, তার অতিথিদের বেশিরভাগই আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপ থেকে।
আজও লং টিয়েং মূলত দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্নই রয়ে গেছে। ভিয়েনতিয়ান থেকে মাত্র ৮০ মাইল দূরত্ব হলেও, পথচারী গাড়িতে যাত্রায় আট ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
রাজধানীর সীমানা পেরিয়ে রাস্তা দ্রুত খারাপ হতে থাকে — প্রথমে পিচঢালা থেকে মেঠোপথ, এরপর পাথুরে খনির রাস্তা, যা ভূমিধস ও গর্তের কারণে এব্রো-থেব্রো হয়ে আছে।
তাছাড়া প্রাকৃতিক দৃশ্যও দেখার মতো নয়। কারণ খনির ট্রাক চলার কারণে ধুলো এবং কৃষিকাজে কাটা-কুটি ও ধুলা মিশে সেখানকার বাতাসও অন্ধকার হয়ে আছে। এ পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় গাড়ি গতি প্রতি ঘণ্টায় ৫ মাইলেরও নিচে নেমে আসে।

রাস্তাটির একটি অংশ পাহাড়ের খাড়া পথ দিয়ে উঠতে হয়। এ রাস্তায় কোনো গার্ডরেল নেই। গাড়ির পিছনের আসনে বসে আমি সামনের সিট ধরে আছি, যখন ড্রাইভার সাবধানে গাড়িটিকে পাহাড়ের ধারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, টায়ার গুঁড়ো পাথরের ওপর ছুঁয়ে চলছে।
এক মুহূর্তে ড্রাইভার পিছনে তাকিয়ে আমাদের সতর্ক করেন, এখানে টায়ার পাংচার হলে হয়ত অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হবে — সম্ভবত কয়েক ঘণ্টা। তাছাড়া ফোনে ফোন সিগন্যাল নেই। আমরা চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সড়ক ধরে এগিয়ে যাই।
লং টিয়েং-র কাছে পৌঁছানোর পর, খাঁড়া মেঠোপথ হঠাৎ করে মসৃণ পিচ ঢালা পথে পরিণত হয়। শেষ পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়, আমরা আশা করছিলাম রানওয়ের দেখা পাবো — কিন্তু ঘন ধোঁয়ায় উপত্যকা ঢেকে গেছে। যার কারণে কয়েকশ মিটারের মধ্যে কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে নামার সময়, এখানে একসময় ৩০ হাজার মানুষের বসবাসের কোনো স্পষ্ট চিহ্ন চোখে পড়ে না। পরিবারগুলোর খামার এখন সেই জমিতে গড়ে উঠেছে যেখানে আগে ব্যারাক ও কমান্ড সেন্টার ছিল। সামরিক দলবলগুলোর বদলে এখন স্কুটার আর গবাদি পশু সেখানে স্থান গেড়েছে।
আমরা রানওয়ের পাশের একটি গেস্টহাউসে থাকি। সেখানে খুবই সাধারণ ব্যবস্থা—একটি কাঠের বিছানা এবং একটিমাত্র কাঁপতে থাকা পাখা, যার বাতাসে তেমন কোনো প্রভাব নেই। সেখানে কোনো এয়ার কন্ডিশনার নেই, এবং আর্দ্র বাতাস ভারী ও স্থির। ঘুমানো কঠিন, শুধু গরমের কারণে নয়, বরং এই জায়গাটির অতীত ভাবনার কারণেও মন ঘুমাতে যাচ্ছে না।
পরেদিন সকালে, আমরা সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে উপত্যকার ওপর দিয়ে রানওয়ের মাঝ বরাবর হাঁটতে শুরু করি। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত রানওয়েগুলোর মধ্যে একটি এখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। আর্টিলারি আঘাতের কারণে পড়ে থাকা গর্ত থেকে লম্বা ঘাস গজিয়ে উঠেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত কন্ট্রোল টাওয়ার তার মূল উচ্চতার অর্ধেক বেঁচে আছে, এবং দূরবর্তী হ্যাঙ্গারগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ না থাকায় তাতে মরিচা পড়ে গেছে।

রানওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার নজরে পড়ে, এখানে কোনো সাইনবোর্ড, ভাস্কর্য বা স্মৃতিচিহ্ন নেই। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, এ জায়গাটিকে চিহ্নিত করার জন্য কিছুই রাখা হয়নি।
পাইলটরা যারা লং টিয়েং-কে নিজের বাড়ি-ঘর বলতো
যুদ্ধ চলাকালীন লং টিয়েং থেকে অপারেশন চালানো গোপন একটি দল ছিল 'রেভেনস'। দলটিতে একদল সক্রিয় আর্মি এয়ার ফোর্সের পাইলটরা স্বেচ্ছায় লাওসে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল ফরওয়ার্ড এয়ার কন্ট্রোলার (এফএসি) হিসেবে কাজ করা, শত্রুর পেছনে নিচু করে উড়ে গিয়ে লক্ষ্য চিহ্নিত করা এবং মার্ক করা যাতে মার্কিন এয়ার ফোর্সের বোমাবাজেরা সেগুলোকে টার্গেট করতে পারে।
পল কার্টার বলেন, 'তাদের কার্যত অফিসিয়াল তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তারা অন্য একটি কভারের অধীনে কাজ করত।'
রেভেনসরা সাধারণ বেসামরিক পোশাক পরতেন এবং মার্কিন দূতাবাসের পরিচয়পত্র ধারণ করতেন। কার্টার আরও বলেন, কিছু ক্ষেত্রে পাইলটদের মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) পরিচয়পত্রও দেওয়া হতো।
রেভেনসরা সাধারণত এক সঙ্গে দুজন থাকেন। সামনের আসনে একজন আমেরিকান পাইলট আর পেছনের আসনে একজন স্থানীয় হমং 'ব্যাকসিটার', যিনি স্থল বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
কিন্তু লাওসের আকাশে তারা কিন্তু একা ছিলেন না। এয়ার আমেরিকা নামক গোপন সিআইএ-অধিকৃত একটি বিমান সংস্থার পাইলটরাও লং টিয়েং-এ কাজ করতেন; তারা গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পৌঁছে দিতেন এবং শত্রুর পেছনে গভীরে পড়ে যাওয়া পাইলটদের উদ্ধার করার জন্য সাহসী অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান চালাতেন।
যুদ্ধের কিছু সময় লাওসে থাকা পাইলট নীল হ্যানসেন সিএনএন-কে বলেন, "আমি প্রায় প্রতিদিন সেখানে কয়েকবার অবতরণ করতাম।"
হ্যানসেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে এয়ার আমেরিকার জন্য কাজ করেছেন এবং তার অভিজ্ঞতা 'ফ্লাইট: এন এয়ার আমেরিকা পাইলট'স স্টোরি অব অ্যাডভেঞ্চার, ডিসেন্ট অ্যান্ড রিডেম্পশ' বইয়ে বর্ণনা করেছেন।
"আমি একটি সি-১২৩ মডেলের বিমান চালাতাম, যা 'লিটল বার্ডস'দের জন্য গোলাবারুদ, সরবরাহ এবং জ্বালানি নিয়ে যেতো, যেগুলো পরে অন্য সাইটগুলোতে বিতরণ করা হতো," হ্যানসেন স্মরণ করেন। তার মিশনের অংশ হিসেবে তিনি 'সিআইএ কাস্টমারদের'ও পরিবহন করতেন।
১৯৭২ সালের এক ফ্লাইটে, হ্যানসেনের বিমান লাওসের দক্ষিণাঞ্চলের প্লাটো দে বোলেভানে গুলি করে বিধ্বস্ত করা হয়।
তিনি বলেন, "আমি আমার ক্রুকে বের করে নিয়ে পালিয়ে গেলাম, আর তারপর দেখলাম সি-১২৩ আকাশ থেকে পড়ে বিস্ফোরিত হলো। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ার আমেরিকার হেলিকপ্টারগুলো আমাদের উদ্ধার করে।
জেনারেল ভাং পাও'র সদর দফতর
রানওয়ে থেকে প্রায় ১০০ মিটার পশ্চিমে একটি দুইতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, যা একসময় সিআইএ-সমর্থিত হমং সেনাদের নেতা জেনারেল ভাং পাও'র সদর দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই দূরবর্তী ক্যাম্প থেকে পাও আমেরিকান এজেন্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন, একটি গোপন যুদ্ধ সমন্বয় করতেন এবং হাজার হাজার হমং যোদ্ধাকে সংগঠিত করতেন, পাশাপাশি মার্কিন সামরিক বিমান সহায়তা, অস্ত্র ও মানবিক সাহায্য পাচ্ছিলেন।
একটি উঁচু বেড়ার এবং ঘন জঙ্গলের আড়ালে সেট করা এই বাড়িটা গ্রামের বাকি অংশ থেকে আলাদা, দূরবর্তী এবং রক্ষিত মনে হয়। সামনের দরজায় ইংরেজিতে লেখা একটি সাইন রয়েছে: 'অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।' পুরো গ্রামে এটি একমাত্র ইংরেজি সাইন, যা আমাদের পথ আটকে দেয়। সেখানে কেউ না থাকায় আমরা বাড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে ধুলোয় মোড়া জানালা দিয়ে ভিতরে নজর দিতে থাকি, নিশ্চিত নই ভিতরে ঢোকা যাবে কিনা।
পরে সামরিক পোশাক পড়া একজন বয়স্ক ব্যক্তি কাছে এসে উপস্থিত হন। কিছু বলার বদলে ধীরে ধীরে আমাদের সামনে একটি চাবি ঝুলিয়ে দেখান। তিনি ইংরেজি বলতে পারেন না, তবে ফোনে একটি নম্বর টাইপ করে দেখান। আমরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই এবং টাকা দিয়ে দিই। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা ভিতরে প্রবেশ করি।

সাংবাদিক বলেন, "বাড়িটা আমার প্রত্যাশার মতো ছিল না। আমি ভেবেছিলাম এটি একটি সংরক্ষিত কক্ষের মতো হবে, যেখানে স্মৃতিচিহ্ন বা ভুলে যাওয়া পুরনো জিনিসপত্র জমে থাকবে—কিন্তু ঘরগুলো অদ্ভুতভাবে ফাঁকা ছিল। কোনো আসবাবপত্র নেই, কোনো সাজসজ্জা নেই, না কোনো পোস্টার বা জেনারেলের প্রতিকৃতি। প্রবেশদ্বারের, একটি কোণে সুসজ্জিতভাবে একগাদা আর্টিলারি শেল স্তূপ করা আছে, আর কিছু মর্টার গোলা পাশেই রাখা। যুদ্ধের এসব অস্ত্রশস্ত্র এত নিখুঁতভাবে সাজানো দেখতে অদ্ভুত লেগেছিল। একটি অনুবাদ অ্যাপ ব্যবহার করে সেই ব্যক্তিটি আমাদের সতর্ক করে বলল কিছু স্পর্শ না করার জন্য — কারণ কিছু শেল এখনও জীবন্ত থাকতে পারে।"
উপরের তলায়, একটি বড় জানালার পাশে একটি কাঠের টেবিল ও চেয়ারের ব্যবস্থা করা আছে যেখান থেকে রানওয়েটি দেখা যায়। আমি সেখানে বসে ভাবছি, কীভাবে জেনারেল ভাং পাও ও সিআইএ কর্মকর্তা একই জায়গা থেকে বি-৫২ বোমাবর্ষণের নির্দেশনা দিতেন কমিউনিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে। যুদ্ধটা—যেমন বিশাল এবং বিধ্বংসী—সেটা মূলত এই ছোট, সাধারণ ঘর থেকেই সমন্বয় করা হতো। যুদ্ধের বিশালতা আর এই সরল পরিবেশের মিল পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
আমরা ছাদে উঠি। সেখান থেকে দেখা যায় পুরনো রানওয়ে আর পাহাড়গুলো, যা একসময় লং তিয়েনগকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করতো। এখন গ্রামটা শান্ত। কয়েকজন মানুষ ধীর গতিতে প্রধান রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। কুকুরগুলো রোদে শুয়ে আছে। বিশ্বাস করাই কঠিন যে একসময় এখানে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করত।
আজকের লাওস
আজও লাওসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারী বোমাবর্ষণের প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। মাইনস অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (এমএজি) অনুযায়ী, দেশজুড়ে ফেলা ২৭০ মিলিয়ন সাব-মিউনিশনের মধ্যে আনুমানিক ৩০ শতাংশ বিস্ফোরিত হয়নি। এসব অ-বিস্ফোরিত বোমা এখনও দেশজুড়ে মানুষের প্রাণহানি, আহত এবং উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
লং তিয়েনগ পাহাড়ের আশেপাশে গ্রামবাসীরা এখনও রাস্তাঘাট ও স্থাপিত পথের বাইরে তেমন যাওয়ার চেষ্টা করেন না।
১৯৯২ সালে মার্কিন-লাওস সম্পর্ক পূর্ণরূপে পুনঃস্থাপিত হয় এবং ১৯৯৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের বাকি অস্ত্র ধ্বংস প্রোগ্রামে ৩৯০ মিলিয়নের বেশি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যাপক বিদেশি সাহায্য স্থগিতের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্ফোরক অপসারণের জন্য ভবিষ্যতে মার্কিন তহবিলের বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
হ্যানসেন বলেন, "আমি লাওসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার সময়কে আমি উত্তেজনাপূর্ণ মনে করি, এমন একটি জায়গা যেখানে আমি সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে পারতাম। আমি এমন একটি কাজ করছিলাম যার মাধ্যমে আমি বুঝতে পারতাম আমি কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করছি।"
লং তিয়েনগে ফিরে, বাচ্চারা স্কুটারে চড়ে আমার বন্ধু আর আমার পাশ দিয়ে দ্রুত চলে যায়, তাদের টায়ার ভাঙা কংক্রিটের ওপর থেকে বেঁকে বেঁকে যায়, যেখানে একসময় যুদ্ধবিমান উড়ত।
এখন আমি বুঝতে পারছি কেন কমিউনিটি যখনই পারে, ওই এয়ারস্ট্রিপের দিকে আকৃষ্ট হয়: এটি কয়েকটি মুক্ত খোলা জায়গার মধ্যে একটি, যা অ-বিস্ফোরিত বোমামুক্ত।
একটি বিরল স্থান যেখানে বাচ্চারা ভয় ছাড়াই খেলতে পারে, ৫০ বছর আগে শেষ হওয়া এক যুদ্ধে আরেকজন হতাহত হওয়ার আশঙ্কা ছাড়াই।
একটি গোপন যুদ্ধে সৃষ্ট ঐতিহ্য — যা আমেরিকা প্রায় ভুলতে বসেছে।