বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেনযাত্রা, কিন্তু শেষ করতে পারেনি কেউই

উত্তর লাওসের পাহাড়ি পথ যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনই দুর্গম। দৃষ্টিনন্দন এসব পথ দিয়ে চলা যাত্রীদের কাছে বেশ কষ্টসাধ্যের ব্যাপারও বটে। দেশটির রাজধানী ভিয়েনতিয়েন থেকে চীনা সীমান্তবর্তী শহর বোতেন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কিমি দীর্ঘ আঁকাবাঁকা সড়কগুলো পাড়ি দিতে গাড়িতেই সময় লাগে প্রায় ১৫ ঘণ্টা!
তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে লাওস ও চীনের মধ্যে চালু হওয়া রেলপথ বদলে দিয়েছে দীর্ঘ যাত্রার এই অভিজ্ঞতা। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে ভিয়েনতিয়েন থেকে বোতেনে পৌঁছাতে এখন সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা।
প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তৈরি হওয়া এই রেললাইন প্রকৌশলের এক অনন্য কীর্তি। যার প্রায় অর্ধেক জুড়েই রয়েছে সুড়ঙ্গপথ—সেই সাথে আছে ১৬৭টি সেতু।
যাত্রাপথের বেশিরভাগ সময় কাটে পাহাড়ের ভেতর। তবে সুড়ঙ্গ থেকে বেরোলেই চোখে পড়ে অপূর্ব সব দৃশ্য—সবুজে মোড়া উপত্যকা, ছায়াঘেরা জঙ্গল আর পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা ছিমছাম গ্রাম।
শুধু সময় বাঁচানোই নয়, এ রেলপথ বদলে দিচ্ছে লাওসের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পর্যটনের চিত্রও। এক সময় যে পথ ছিল পাহাড়ঘেরা বিচ্ছিন্নতা, এখন তা হয়ে উঠেছে এক গতিশীল করিডর।
চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের অংশ হলেও, ট্রেনপ্রেমীদের কাছে লাওস-চীন রেলপথের গুরুত্ব আরেকটু বেশি—কারণ এই রেললাইনকে এখন বিশ্বের দীর্ঘতম সম্ভাব্য ট্রেনযাত্রার অংশ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
লাওস-চীন রেলপথ চালু হওয়ার পর আপনি চাইলে এখন পর্তুগালের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রঘেঁষা ছোট্ট নিরিবিলি শহর লাগোস থেকে ট্রেনে চেপে সোজা পৌঁছে যেতে পারেন সিঙ্গাপুর!
এই পুরো ট্রেনযাত্রায় পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১১ হাজার ৬৫৪ মাইল। আর এই দূরত্ব অতিক্রম করতে পাড়ি দিতে হতে হবে ১৩টি দেশ ও আটটি সময় অঞ্চল। যদি সময়মতো সব ট্রেন ধরতে পারেন, তাহলে প্রায় ১৪ দিনে এই দীর্ঘ যাত্রা শেষ করা সম্ভব।
ট্রেনে বসেই রেলগাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যাবে নানা দেশের দৃশ্য ও সবুজে ঘেরা জনপদ। ভাগ্য ভালো থাকলে কোনো ধানক্ষেতে চোখে পড়ে যেতে পারে হাতির পালও।
ব্যতিক্রমী এই ট্রেনভ্রমণে প্রতিটি স্টেশন যেন একেকটি গল্প এবং প্রতিটি জানালার বাইরে নতুন এক অভিজ্ঞতা।
এই ট্রেনযাত্রার চেয়ে আরও রোমাঞ্চকর কিছু কল্পনা করা কঠিন। এমনকি একসময় যে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসকে বিশ্বের সবচেয়ে কিংবদন্তিতুল্য ট্রেনযাত্রা বলা হতো—যা প্যারিস ও ইস্তাম্বুলের মধ্যে চলাচল করত এবং এ পথের দূরত্ব ছিল প্রায় ২ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার—সেই যাত্রাও এই বিশাল রুটের কাছে যেন অনেকটাই ম্লান।
বরং পর্তুগাল থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত এই ট্রেনযাত্রা অনেকটা কল্পকাহিনির সেই 'স্নোপিয়ারসার' ট্রেনের মতো—হাজারটি বগি নিয়ে যে ট্রেন পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় একটানা, নিরবচ্ছিন্নভাবে।
এই ট্রেনযাত্রার ধারণা শুধু ট্রেনপ্রেমীদের নয়, বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের কল্পনাকে আলোড়িত করেছে— হোক তারা বাস্তব পর্যটক, কিংবা ঘরে বসে মানচিত্রের পাতায় ঘুরে বেড়ানো মন। তাই ইন্টারনেটজুড়ে গত কয়েক বছর ধরে এই ট্রেনরুটের মানচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে, আলোচনার জন্মও দিয়েছে নানা প্ল্যাটফর্মে।
রয়েছে কিছু অদ্ভুত সমস্যাও
এই রেলপথ এত মনমুগ্ধকর হলেও এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সত্য হলো—এখন পর্যন্ত কেউই এই পুরো যাত্রা একবারে শেষ করতে পারেননি।
এই দীর্ঘ ট্রেনযাত্রাকে ঘিরে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে ওঠে।
প্রথম সমস্যা হলো সংজ্ঞা নিয়ে। 'বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেনযাত্রা' বলতে আসলে কী বোঝায়?
ধরা যাক, আপনি ফ্রান্সের দুটি শহর—প্যারিস থেকে মার্সেই ঘুরে আবার ফিরে এলেন—তাহলে তো সেই যাত্রাটিকে দীর্ঘযাত্রা তো বলাই যায়, আবার সেই যাত্রাপথের সাথে ভিয়েতনামের রুটও যোগ করা হলো—-একসময় বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ট্রেনযাত্রা হিসেবে গণ্য হতো, কিন্তু লাওস-চীন রেলপথ এই যাত্রাকে সংক্ষিপ্ত করে দেয়। তাই এই ধরনের রেকর্ড নির্ধারণ করতে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ট্রেনযাত্রা বলতে বোঝানো হয়—'দুটি সবচেয়ে দূরের স্টেশনের মধ্যে সবচেয়ে সরল এবং সংক্ষিপ্ত পথ'।
দ্বিতীয় সমস্যাটি আরও দার্শনিক। কারণ আপনি পর্তুগালের লাগোস থেকে যে ট্রেনে চড়বেন, সেটা কিন্তু সিঙ্গাপুরে গিয়ে আপনাকে নামিয়ে দেবে না। এই যাত্রায় ট্রেন বদল করতে হবে প্রায় ২০ বার!
এমনকি এক টিকিটেও আপনি পুরো পথ যেতে পারবেন না—প্রত্যেক অংশের জন্য আলাদা রিজার্ভেশন দরকার। তাহলে এটাকে কীভাবে একটানা দীর্ঘতম ট্রেনযাত্রা বলা যায়?
এটা অনেকটা সেই থিসিয়াসের জাহাজ নিয়ে গ্রিক দার্শনিকদের পুরনো বিতর্কের মতো। কিংবদন্তি থিসিয়াসের জাহাজের সব অংশ বদলে দিলে কি জাহাজ আগের মত থাকে? ঠিক তেমনি, একটার পর একটা ট্রেন বদলালেও কি এটিকে আর একই যাত্রা বলা যায়?
তৃতীয় সমস্যা বাস্তবধর্মী। আপনি হয়তো ভেবেছেন, লিসবন থেকে ফ্রান্সের হেনদায়ে যাবেন। তবে সেই রেলসেবা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও বিকল্প রুটে লিসবন থেকে মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও লিওঁ হয়ে প্যারিস পৌঁছানো যায়।
কিন্তু বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে প্যারিস থেকে মস্কো রুটে। কোভিডের সময় সেই যে এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ হয়েছিল, আর চালু হয়নি। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর ২০২২ সালে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ইউরোপ, রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রেন চলাচল পুরোপুরি থেমে যায়। ফলে সেই রুট আর ব্যবহারযোগ্য নেই।
মস্কো থেকে আপনি চাইলে বেইজিং পর্যন্ত ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রুটে যেতে পারেন—যদিও তাত্ত্বিকভাবে এই যাত্রাটি হবে পুরো ভ্রমণের সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ। প্রায় ৭ হাজার ৬২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে টানা পাঁচ দিন। তার চেয়ে বড় সমস্যা—-টিকিট পাওয়া বেশ মুশকিল। নিষেধাজ্ঞার কারণে এই রুটে যাত্রী চলাচল এখন অনেকটাই সীমিত।
বিকল্প হিসেবে রয়েছে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান রুট, যা মঙ্গোলিয়া এড়িয়ে সরাসরি মস্কো ও বেইজিংকে যুক্ত করেছে। বেইজিং থেকে এরপর আপনি উঠে পড়বেন কুনমিংগামী বুলেট ট্রেনে। প্রায় ২ হাজার ৭৬০ কিলোমিটার দূরত্বের এই যাত্রা মাত্র ১১ ঘণ্টারও কম সময়ের পাড়ি দেওয়া যায়। এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ উচ্চগতির রেলপথ। যেখানে ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান ট্রেন চলে ঘণ্টায় গড়ে ৬১ কিমি গতিতে, সেখানে বেইজিং-কুনমিং বুলেট ট্রেনের গতি গড়ে ২৫১ কিমি—চারগুণেরও বেশি।
চীনের কুনমিং থেকে লাওসের রাজধানী ভিয়েনতিয়ান পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫ কিমি রেলপথ এখন চালু, যা আধুনিক এলসিআর ট্রেনে মাত্র সাড়ে ৯ ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া যায়। এটিই কুনমিং থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত প্রস্তাবিত প্যান-এশিয়ান হাই-স্পিড রেলের একমাত্র সম্পূর্ণ অংশ।
এরপর ভিয়েনতিয়ান থেকে ব্যাংকক (৬৮৩ কিমি পথ) এখন একটি ধীরগতির স্লিপার ট্রেনে পাড়ি দিতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা। তবে হাই-স্পিড লাইনের কাজ চলমান। চালু হলে এই যাত্রায় সময় লাগবে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা।
ব্যাংকক থেকে কুয়ালালামপুর যেতে এখন লাগে প্রায় ২৪ ঘণ্টা—প্রায় ১,৫০০ কিমি পথ, যেখানে সীমান্তে ট্রেন বদল করতে হয়। প্রস্তাবিত হাই-স্পিড লাইনে সময় কমে দাঁড়াবে ছয় থেকে আট ঘণ্টায়।
শেষ ধাপ, কুয়ালালামপুর থেকে সিঙ্গাপুর—৩৫০ কিমি পথ, যা বর্তমানে গড়ে ৬৩ কিমি বেগে চলা ট্রেনে পাড়ি দিতে লাগে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। করোনাকালে উচ্চগতির রেলপথ নির্মাণের কাজটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটি পুনরায় শুরু হয়েছে। এ পথ নির্মাণ শেষ হলে কুয়ালালামপুর থেকে সিঙ্গাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ৯০ মিনিট।
সবকিছু ঠিকঠাক সম্পন্ন হয়ে গেলে এ পথে কুনমিং থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৭৪ কিমি পথ পাড়ি দিতে সময় মাত্র ১৫-২০ ঘণ্টা, যেখানে এখন লাগে ৮০ থেকে ৯০ ঘণ্টা।
যাত্রার শেষ অংশে, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মাঝে জোহর-সিঙ্গাপুর কজওয়ে—এক কিমি দীর্ঘ একটি সেতু—দিয়ে পৌঁছাতে হয় সিঙ্গাপুরের উডল্যান্ডস স্টেশনে। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন এই ব্যস্ত সীমান্তে। আর এখানেই শেষ হয় এই দীর্ঘ, দুরূহ অথচ চমকপ্রদ রেলযাত্রা, যার শুরু হয়েছিল ইউরোপের লাগোস শহর থেকে।
রেলপথটিকে ঘিরে বেশ কিছু সমালোচনা-বিতর্ক থাকলেও, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো— লাগোস থেকে এই দীর্ঘতম রেলযাত্রার সূচনা হওয়া উচিতই ছিল না।
ট্রেনভিত্তিক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট 'দ্য ম্যান ইন সিট ৬১'-এর মতে, লাগোস থেকে লিসবন নয়, বরং ভিয়া রিয়াল দে সান্তো আন্তোনিও থেকে লিসবনের দূরত্ব আরও বেশি—সুতরাং সেটিই হওয়া উচিত প্রকৃত সূচনা।
তাছাড়া এই ধারণার ভেতরেও অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। দীর্ঘতম রুটে অনেক সময় দ্রুতগামী ট্রেনের বদলে আঞ্চলিক ধীরগতির ট্রেন ব্যবহার করা হয়, যেগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি কম এবং সংযোগ দুর্বল। কোথাও কোথাও ট্রেন বদলাতে গিয়ে স্টেশন বদলাতে হয়, যা একধরনের বাড়তি ঝামেলা।
সিট ৬১–এর পরামর্শ, যুদ্ধশেষে এমন যাত্রা আবার সম্ভব হলেও পর্তুগাল থেকে শুরু করার দরকার নেই। যাত্রা শুরু হোক নিজের ঘরের কাছের স্টেশন থেকেই—এই ত্রুটিপূর্ণ ও বাস্তবায়ন-অযোগ্য ধারণার পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করার মানে নেই।
তার চেয়ে বরং 'দীর্ঘতম একটানা ট্রেনযাত্রা' ধারণাটি বেশি বাস্তব—-এই ক্যাটাগরিতে স্পষ্ট বিজয়ী মস্কো–পিয়ংইয়ং রুট। প্রতি সপ্তাহে একবার চলা ট্রেনটি ১০ হাজার ২১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় আট দিন সময় নিয়ে। এই যাত্রা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান লাইনের অংশ—-যেটিকে মাঝে মাঝে ভুলবশত 'বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রেনরুট' বলা হয়—যদিও একটানা না হওয়ায় বিষয়টি ঠিক তেমন নয়।
তবে সব হিসাব-নিকাশ, তর্ক-বিতর্কের পরও যে কথায় সবাই হাত মেলে—গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, ট্রেনযাত্রার আসল রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকে যাত্রাপথে।