ট্রাম্পের ৩৫ শতাংশ শুল্কে বিপন্ন বাংলাদেশের ৮৪০ কোটি ডলারের রপ্তানি লাইফলাইন

একটি পলো শার্টই যেন পুরো ঘটনা তুলে ধরে।
যখন একজন বাংলাদেশি রপ্তানিকারক মাত্র ১০ ডলারে যুক্তরাষ্ট্রে একটি পলো শার্ট পাঠান, তখন ১৬ শতাংশ আমদানি শুল্কের কারণে মার্কিন বায়ারকে সেটির জন্য দিতে হয় ১১.১৬ ডলার। কিন্তু ১ আগস্ট থেকে যদি ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়, তাহলে সেই একই শার্টের দাম দাঁড়াবে ১৫.১০ ডলার — অর্থাৎ তা ৫১ শতাংশ বাড়বে।
"যখন ভিয়েতনামের চেয়ে আমাদের পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ বেশি শুল্ক দিতে হবে, তখন আমাদের থেকে কে কিনবে?" — প্রশ্ন রাখেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, তাঁর কণ্ঠে ছিল উদ্বেগের ছাপ।
এটাই রপ্তানিকারকদের বড় শঙ্কা — ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা বায়াররা অন্য দেশে চলে যেতে পারে। ভিয়েতনাম, যে দেশটি ইতিমধ্যেই পোশাক খাতে বাংলাদেশের শক্তিশালী প্রতিযোগী, তাদের পণ্যে শুল্ক অনেক কম। যদি চীন, ভারত কিংবা পাকিস্তান এই বাড়তি শুল্কের কবল থেকে রক্ষা পায়, আর বাংলাদেশকে পুরো ৩৫ শতাংশ শুল্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়—তাহলে "এটা ভয়াবহ বিপর্যয়কেও ছাড়িয়ে যাবে," হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ফজলুল হক।
অর্থনীতিতে ঝুঁকি: বিলিয়ন ডলারের ধাক্কা
এর প্রভাব বুঝতে হলে প্রথমেই চোখ রাখতে হবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যানে।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক পণ্যবাণিজ্য দাঁড়ায় প্রায় ১০.৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের রপ্তানি, এবং মাত্র ২.২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয় সেদেশ থেকে। ফলে ৬.২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলাদেশের অনুকূলে। অথচ এই উদ্বৃত্তই এবার বাড়তি শুল্ক আরোপের অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
কিন্তু এই উদ্বৃত্ত স্রেফ কোনো সংখ্যা নয় — বাংলাদেশের জন্য এর মানে কারখানা, শ্রমিক এবং জীবন-জীবিকা।
রপ্তানিকারকরা সতর্ক করে বলছেন, মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার-ও যদি ভিয়েতনাম বা অন্য কোনো দেশে চলে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ইতোমধ্যেই নড়বড়ে রপ্তানি খাতে তা বিশাল ধাক্কা দেবে। এর প্রভাব হবে পদ্ধতিগত ও সর্বব্যাপী।
"এই ৩৫% শুল্ক কার্যকর হলে, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে," বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তাঁর মতে, "এমন উচ্চ শুল্কের পরিবেশে ব্যবসা করা, বিশেষত রপ্তানিতে— হবে ব্যাপক চ্যালেঞ্জিং।"
আর শুধু পোশাক কারখানাগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে নয়। এর ধাক্কা ছড়িয়ে পড়বে পুরো অর্থনীতিতে — ব্যাংকিং, বীমা, পরিবহন, বন্দর, প্যাকেজিং — রপ্তানি ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরেই যার ধাক্কা লাগবে। এতে করে অনেক কারখানা টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাবে, ফলে লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক, যাদের বেশিরভাগই নারী—চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি রুবানা হক একে "বিপর্যয়কর" হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, সেখানে রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, নতুন এই শুল্কের সঙ্গে বিদ্যমান ১৬ শতাংশ শুল্কও যুক্ত হবে কি না—এনিয়েও অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। যদি তা হয়, তাহলে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, "মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা না থাকার ফলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যেই আছি। এখন নতুন শুল্ক আমাদের পণ্যের প্রতিযোগী সক্ষমতা আরও হ্রাস করবে। এতে করে, অনেক কারখানাই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে, বিশেষত যেগুলো মার্কিন বাজারে রপ্তানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।"
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সতর্ক করে বলেন, শুল্কহার হঠাৎ করে এতটা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ—মূল্য প্রতিযোগিতার সুবিধা—ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে, কর্মসংস্থান হারাবে, এবং দারিদ্র্য আরও বাড়বে। তিনি বলেন, "এটা আর শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ইস্যু নয়, এটি এখন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সহনশীলতার প্রশ্ন।"
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, নতুন শুল্কহার কার্যকর হলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
"আমাদের শুল্কসংক্রান্ত ঝুঁকি অনেক প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বেশি। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী এই শুল্ক আরোপ কার্যকর হয়, তবে আমরা বৈষম্যমূলকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ব," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক হারে শুল্ক বাড়লে—দেশটির ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে; যার ফলে বাজার সংকুচিত হবে এবং প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে।
"এর প্রভাবটি সম্ভবত আমেরিকান বায়ার ও বাংলাদেশি সাপ্লায়ার উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে — আর এই বোঝা বহনের জন্য আমাদের শিল্প প্রস্তুত নয়," সতর্ক করে বলেন ড. রাজ্জাক।
স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ — যার প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয় — তুলে ধরেন এক হতাশাজনক চিত্র।
তিনি বলেন, "নতুন শুল্ক কাঠামোর আওতায় আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টিকে থাকতে পারব না। যদি এই শুল্ক বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বায়াররা তাদের অর্ডার ভারত, ভিয়েতনামসহ আরও যেসব দেশ ভালো শর্ত দিচ্ছে, সেদিকে সরিয়ে নেবে।"
তিনি আরও বলেন, "এরপর আমি মনে করি না সেসব অর্ডার আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে। বাংলাদেশ দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারাতে শুরু করবে।"
বেসরকারি খাতকে "অন্ধকারে" রেখে আলোচনা
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের প্রধান চালিকা শক্তি বেসরকারি খাত। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক নিয়ে ৯০ দিনের আলোচনাকালে এই খাতকে আলোচনা থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে—এমন বক্তব্য উঠে আসায় শিল্পখাতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, "বাংলাদেশ যেটুকু রপ্তানি করে, সবটাই বেসরকারি খাত থেকেই আসে। কিন্তু আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের আলোচনায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত ছিলাম। সরকার কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে বা তারা কী অবস্থান নিয়েছে, আমরা কিছুই জানতাম না।" তিনি আরও বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, আলোচনায় কোনো বাণিজ্য বিশেষজ্ঞও ছিলেন না।
ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, "এই প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে ব্যবসায়ীদের ভুগতে হবে।"
তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় কোনো বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত না থাকা সত্যিই অবাক করার মতো। তাঁর মতে, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএ -এর নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ সরকারের এ ধরনের অনাগ্রহকে "বড় ব্যর্থতা" হিসেবে আখ্যা দেন।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের হাতে তিন মাস সময় ছিল, (যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের) জবাব দেওয়ার জন্য। কিন্তু শুল্ক কমাতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা বারবার সরকারকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেছি, কিন্তু পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রধান সংগঠন- বিজিএমইএ'কে একবারও আলোচনায় ডাকা হয়নি।"
এনিয়ে ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে স্পষ্ট হতাশা লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, তারা মনে করেন, এখন এমন এক সিদ্ধান্তের ফল তারা ভোগ করতে যাচ্ছেন, যেখানে তাদের কোনো মতামতই নেওয়া হয়নি।
অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ নিয়ে যখন দেশজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে, তখন কিছু শিল্পনেতা সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করছেন।
দেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার স্বীকার করেন, মূল্য প্রতিযোগিতায় নতুন শুল্ক একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে তিনি মনে করেন, এর প্রভাব হয়তো যতোটা ধারণা করা হচ্ছে, ততোটাও গুরুতর হবে না।
"ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক দিচ্ছে। কিন্তু, আমরা যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করি, তা অনেক ক্ষেত্রেই ভিয়েতনাম বা চীনের থেকে ভিন্ন," টিবিএস'কে বলেন জব্বার।
তিনি বলেন, "যদি ভিয়েতনাম আরও বেশি অর্ডার নিতে চায়, তাও তাৎক্ষণিকভাবে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব নয়। কিছু অর্ডার হয়তো ভারত বা পাকিস্তানে চলে যেতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি না যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।" তবে তিনি স্বীকার করেন, মূল্য ব্যবধান বা প্রাইস গ্যাপ এখনো বড় একটি বাধা।
চলমান বাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, "সরকার এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত আছে। আমাদের সামনে ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় আছে। এখনই চূড়ান্তভাবে কিছু বলার সময় আসেনি। একটু অপেক্ষা করতে হবে, পরিস্থিতি কীভাবে এগোয় তা দেখার জন্য।"
আরেকটি শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম শামসুদ্দিনও একই ধরনের আশাবাদ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, "আমি মনে করি না রপ্তানিকারকেরা এখনই বড় কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। অন্তত এই মুহূর্তে না। কারণ, ভিয়েতনাম বা ভারতের এখনো সে রকম প্রস্তুতি নেই যে তারা বাংলাদেশ থেকে সরে যাওয়া সব অর্ডারই নিতে পারবে।"
তিনি আরও বলেন, "বিশেষ করে ভিয়েতনাম ইতোমধ্যেই পোশাক উৎপাদনে তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। এটা আমাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি করছে।"
যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ১৪টি দেশকে এ নতুন শুল্ক কাঠামোর আওতায় এনেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তবে আরও কিছু দেশকে ১ আগস্ট পর্যন্ত সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি এই সংকট থেকে সফলভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বা আলোচনার মাধ্যমে মুক্ত হতে পারবে?
পরিস্থিতি যেমনটা দাঁড়িয়েছে, একটি পলো শার্টের দাম যদি ১৫.১০ ডলার হয়, তার চেয়েও অনেক বেশি মূল্য বাংলাদেশকে দিতে হতে পারে—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সহনশীলতার দিক থেকে।