যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিতে ঝুঁকির মুখে দেশের লাখো পোশাক শ্রমিকের চাকরি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই দেশের পোশাক খাতে এক অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মূল রপ্তানি বাজারে নতুন এ শুল্কের কারণে অর্ডার কমে যাওয়ার শঙ্কায় পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এ শিল্প খাত, যার ওপর নির্ভর করে লাখো শ্রমিকের জীবিকা।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, এবং দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখে এটি।
রাজধানীর আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করা রাইমণি বালা বলেন, 'প্রতিদিনই মনে হয় চাকরি চলে যাবে। গত কয়েক মাস ধরে কারখানায় সবাই কেবল ছাঁটাই নিয়েই কথা বলছে। কেউ ভিজিটে এলে মনে হয়, বুঝি এসে বলবে—তোমার চাকরি নেই।'
চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও এপ্রিল মাসে ঘোষণা দেওয়া ৩৭ শতাংশের তুলনায় তা সামান্য কম, তবে বর্তমান গড় শুল্কের (প্রায় ১৫ শতাংশ) তুলনায় এটি দ্বিগুণেরও বেশি।
এছাড়া ভিয়েতনামের পোশাকে ২০ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে বলে জানালেও ভারত ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এখনো কিছু ঘোষণা আসেনি। প্রতিযোগী দেশগুলো যদি তুলনামূলক কম শুল্কে রপ্তানি করতে পারে, তবে বাংলাদেশি পোশাকের দাম তুলনামূলক বেশি হয়ে যাবে, যা অর্ডার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
বুধবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। তবে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই কারখানাগুলোতে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের এক ডজনের বেশি শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স, যাদের সবারই একটাই আশঙ্কা—অতিরিক্ত শুল্ক, বাতিল হওয়া অর্ডার এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে চাকরি হারানোর ঝুঁকি।
এই শিল্পের অন্যতম গ্রাহক হলো গ্যাপ ইনকর্পোরেটেড এবং ভ্যানস ব্র্যান্ডের মালিক ভিএফ করপোরেশন। তবে সরবরাহকারীরা জানাচ্ছেন, এসব কোম্পানি এখন 'অপেক্ষা করুন ও দেখুন' অবস্থানে আছে এবং খুব কম নতুন অর্ডার দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'এই শুল্ক বৃদ্ধির চাপ সরাসরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের এবং তাদের নিয়োজিত শ্রমিকদের ওপরই পড়বে। যেহেতু এই শ্রমিকদের বড় অংশই নারী, তাই এতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার ঝুঁকি, চাকরি হারানোর আশঙ্কা ও দারিদ্র্য বাড়তে পারে।'
রাইমণি বালার জীবনের গল্প অনেক শ্রমিকের মতোই। বাংলাদেশের উত্তরের এক গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন তিনি। তার স্বামী অসুস্থ থাকায় পরিবার চলতে তার আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। দুই ছেলেকে (বয়স ১৫ ও ১৩) পড়াশোনা করানোর স্বপ্নে প্রতিদিনই পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।
মহামারির সময় তার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখন সরকার ঘোষিত প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় কিছুটা কম বেতন পেলেও, পরিবারকে প্রায় অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।
নতুন করে শুল্ক কিংবা অর্ডার কমার গুজব ছড়ালেই আবার ফিরে আসে সেই ভয়ের দিনগুলো। তবু আশা ছাড়েন না রাইমণি।
তিনি বলেন, 'আমার কাজের ওপর আস্থা আছে। আমি সম্মান নিয়ে কাজ করি। যতদিন এই চাকরিটা থাকবে, ততদিন আমার ছেলেরা স্বপ্ন দেখতে পারবে। এটা না থাকলে, আমরা কীভাবে চলব জানি না।'