যুক্তরাষ্ট্র-ভারত 'তেলযুদ্ধে' জড়ালে চীনের লাভ যেভাবে

২০২২ সালে পশ্চিমা দেশগুলো যখন রুশ তেলের বয়কট ঘোষণা করল, তখন ভারত সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত তার কাঁচা তেলের আমদানি উৎস বদলাতে শুরু করে। ইউরোপের জন্য বরাদ্দ ছিল দৈনিক প্রায় ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ব্যারেল রুশ তেল, যা বাজারে ছাড়ে আসা শুরু করলে ভারত তা গ্রহণে এগিয়ে আসে।
২০২১ সালে রাশিয়া থেকে বলতে গেলে কোনো তেল আমদানি না করা ভারত এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমানে দেশটি রাশিয়া থেকে দৈনিক প্রায় ২ মিলিয়ন ব্যারেল কাঁচা তেল আমদানি করে, যা তার মোট তেল আমদানি প্রবাহের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি।
এই কৌশল ভারতের তেল আমদানি খরচ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যেহেতু দেশটির অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে এবং সেই সাথে বাড়ছে তেলের চাহিদাও। দেশীয় পরিশোধনাগারগুলো এই তেল থেকে জ্বালানি তৈরি করে পূর্ণমূল্যে রপ্তানি করে ভালো মুনাফা অর্জন করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এতদিন ভারতের এই কৌশলের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলো কোনো আপত্তি না জানালেও, এখন সেটিই নতুন সংকটে ফেলছে দেশটিকে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে কোনও সমাধানের চেষ্টা না করায়, ৬ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, যুদ্ধে ভারত রাশিয়াকে অর্থায়নে ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া, রুশ তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ওপর সর্বোচ্চ ৫০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের একটি বিল মার্কিন কংগ্রেসে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৮তম নিষেধাজ্ঞার আওতায়, আগামী জানুয়ারি থেকে রুশ তেল থেকে উৎপাদিত পরিশোধিত পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করা হবে।
তবে পশ্চিমাদের এমন চাপ তেমন কার্যকারিতা দেখাচ্ছে না। রুশ তেল প্রতিষ্ঠান রোসনেফট ছাড়া অধিকাংশ ভারতীয় তেল পরিশোধনাগার রাশিয়ার বাইরের উৎস থেকে তেল সংগ্রহ করে। ফলে তারা যুক্তি দেখাতে পারে, তাদের উৎপাদিত পণ্য পুরোপুরি রুশ তেল থেকে নয়—বরং মিশ্রণে কিছু রুশ তেল ব্যবহার হয়েছে। এই অবস্থায় ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের লক্ষ্য রাশিয়ার তেল আয়ে ধাক্কা দিয়ে পুতিনকে যুদ্ধ থামাতে বাধ্য করা। তবে রুশ তেল বিদেশি বাজারে পৌঁছানো বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে—যা ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এই কারণেই বাজারে আপাতত স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবুও ঝুঁকি পুরোপুরি কাটেনি। চীনের মতো ভারতও রাশিয়া থেকে দৈনিক প্রায় ২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে আগে কখনো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ইরানি তেল কেনায় নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে ভারত দ্রুত তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এবারও 'ভারতকে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞায় বাধ্য করতে' ওয়াশিংটন সক্রিয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা।
বাজারের এই শান্ত পরিস্থিতিই ট্রাম্পকে আরও কঠোর হতে উৎসাহিত করতে পারে। তিনি শুধু শুল্ক নয়, বরং রুশ তেলের বাণিজ্যে যুক্ত যেকোনো ব্যাংক, বন্দর বা কোম্পানিকে মার্কিন আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত করার হুঁশিয়ারিও দিতে পারেন।
যদি ট্রাম্প তার হুঁশিয়ারি অনুযায়ী আরও কঠোর হন, তাহলে ভারত দ্রুত বিকল্প তেল সরবরাহকারী খুঁজতে তৎপর হবে। । এক ব্যবসায়ীর ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতীয় পরিশোধনাগারগুলো ইতিমধ্যে রুশ তেলের অর্ডার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে।
তাত্ত্বিকভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো—যাদের হাতে দৈনিক প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে—ভারতের এই সংকটে তারা সহায়তা করতে পারে। পাশাপাশি আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের তেল উৎপাদকদের কাছ থেকেও সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ উপসাগরীয় দেশগুলোর তেল পূর্ব এশিয়ার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বরাদ্দ থাকে। সেই তেল তুলনামূলক হালকা ধরনের, যা ভারতীয় পরিশোধনাগারগুলোর জন্য উপযুক্ত নয়—কারণ তারা রাশিয়ার 'ইউরালস'-জাতীয় ভারী কাঁচা তেলে বেশি অভ্যস্ত।
অন্যদিকে, রাশিয়ার পক্ষে নতুন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। চীনের কিছু পরিশোধনাগার নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়ার মতো সম্পূর্ণ লজিস্টিক ও আর্থিক কাঠামো তৈরি করেছে, ফলে তারা রুশ তেলের আরও কিছু অংশ নিতে পারে। তবে দেশটির নেতারা একক কোনো জ্বালানি সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীল হতে আগ্রহী নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যদি হঠাৎ করে রাশিয়ার তেলবাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে, তবে বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার বা তার বেশি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ট্রাম্প নিজেই হয়তো দীর্ঘ সময় এ ধরনের দাম মেনে নিতে পারবেন না। ফলে, খুব শিগগিরই তিনি ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার পথ বেছে নিতে পারেন—যেমনটি করেছিলেন ২০১৮-১৯ সালে ইরানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। তখনও হুট করে তেলের দাম বেড়ে গেলে তিনি কিছুটা নমনীয় হন।
২০২৫ সালের শুরুর দিকে বৈশ্বিক বাজারে তেলের জোগান অতিরিক্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ধাপে ধাপে রুশ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সহায়ক হতে পারে।
যদি সময় দেওয়া হয়, ভারত হয়তো তার রুশ তেলের বর্তমান সরবরাহের বড় অংশ অন্য উৎস থেকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে—তবে তা বেশ ব্যয়বহুল হবে। বর্তমানে 'ইউরালস' কাঁচা তেল অন্যান্য অনুরূপ মানের তেলের তুলনায় ব্যারেলপ্রতি ৫ থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত ছাড়ে পাওয়া যায়। এই সুবিধা উঠে গেলে ভারতীয় পরিশোধনাগারগুলোর মুনাফা সংকুচিত হবে ।
এ অবস্থায় ভারতের বাজার থেকে সরে যাওয়া চীনা পরিশোধনাগারগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা রুশ তেলের মজুদ বাড়িয়েছে এবং তুলনামূলকভাবে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় তাদের ওপর চাপ কম থাকায়, তারা রুশ তেল কেনা চালিয়ে যেতে পারবে—আরও বড় ছাড়ে।