চীন যেভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ মোকাবিলা করছে

এ বছরই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়। উভয় দেশই একে অপরের পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা শুরু করে। তবে পরবর্তী মাসগুলোতে উভয় দেশই এ শুল্ক কিছুটা কমিয়ে ও বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ না করার বিষয়ে ইচ্ছা পোষণ করেছে।
তবে তাদের বাণিজ্য সংক্রান্ত এ মতপার্থক্য সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সোমবার, চতুর্থ দফার আলোচনা শেষে, মার্কিন অর্থ সচিব স্কট বেসেন্ট বলেছেন যে উভয় পক্ষ প্রায় এক মাসের মধ্যে আবার বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করবে।
ট্রাম্পের এ শুল্ক নীতিতে অন্যান্য দেশ শুল্ক কমানোর জন্য দ্রুত চুক্তি করার চেষ্টা করলেও চীন তার নিজস্ব সময়সূচি মেনেই এগুচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক শর্ত চ্যুতির ফলে আমেরিকায় চীনের রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তবে বেইজিং কীভাবে এ অচলাবস্থা সামাল দিচ্ছে ও পিছপা না হয়ে কী করছে তা-ই দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কমলেও বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে চীনের রপ্তানি বেড়েছে
এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গেছে। তবে এর ফলে চীনের রপ্তানি কার্যক্রম ধীর হয়নি। গত বছর চীনের সঙ্গে বাকি বিশ্বের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কারণ, চীনের রপ্তানি এমন মাত্রায় ছিল যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না। মার্কিন শুল্ক আরোপ সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতি আরও বড় হওয়ার পথে রয়েছে।
এই বছর আগস্ট পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতি ৭৮৫.৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের ৬১২.৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতি দ্রুত বাড়ছে। চীনের বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্র্যান্ডগুলো ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন বাজার দখল করেছে। অন্যদিকে আফ্রিকায় উচ্চ ছাড়ে চীনের সৌর প্যানেলের বিক্রি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে চীনের কিছু অতিরিক্ত রপ্তানি অন্য দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন তার উপরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছে।
চীন ট্রাম্পের সর্বাধিক শুল্ক — যা এক সময় ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারত — এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে চীনের উৎপাদিত পণ্যগুলোর উপর এখনো ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শুল্ক ছাড়াও অন্যান্য শুল্ক আরোপিত রয়েছে, যা অনেক চীনা আমদানির প্রকৃত করের হার অনেক বেশি করেছে।
চীনের কৌশল বছরের পর বছর ধরে তৈরি হচ্ছে। গত দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অবকাঠামো তৈরি করতে বিনিয়োগ করেছে। এই অর্থের মাধ্যমে চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে এমন অঞ্চলে, যা এখন ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, কারণ চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাণিজ্য অন্য দিকে স্থানান্তরের চেষ্টা করছে।
চীন বিদেশে আরও বেশি পণ্য রপ্তানি করে এর অর্থনীতি বৃদ্ধির ধারাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটি কেবল রপ্তানির কারণে নয়, বরং নতুন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বিদেশে বিক্রির জন্য পণ্য উৎপাদনের বড় ধরনের বিনিয়োগের ফলও।
চীন ঘরোয়া অর্থনীতির দুর্বলতা আড়ালের চেষ্টা করছে
চীনের রপ্তানির উত্থান অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতের দুর্বলতা ঢেকে দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মন্দার ফলে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। ভোক্তারা কম খরচ করছে, আর তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন দেশের জেদী মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। এ মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ শিল্পগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদন ও দাম বৃদ্ধি। নীতিনির্ধারকরা দেশীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন, তবে এর ফলাফল এখনও মিশ্র।
যদিও এতে চীনের ওপর মার্কিন চাহিদা মেনে নেওয়ার চাপ বাড়তে পারে, তারপরও দেশের গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায়, বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কে অবাধ আলোচনা রোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
সোমবার চীন ঘোষণা করেছে যে আগস্টে খুচরা ব্যয় এবং কারখানার উৎপাদন অর্থনীতিবিদদের প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তীব্র ধীরগতির ইঙ্গিত দেয়। এই ধীরগতি আরও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, কম সুদের হার, বাড়ি কেনার নিয়ম শিথিলকরণ এবং ভোগ্যপণ্যের উপর ভুর্তুকি দিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রচেষ্টা যথেষ্ট নাও হতে পারে।
চীন লাভের পথ খুঁজছে
যেকোনো আলোচনায়, উভয় পক্ষকেই বুঝতে হবে কী ঝুঁকিতে রয়েছে। চীনের জন্য, যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবচেয়ে বড় এবং ধনী ভোক্তা বাজার। শুল্কের কারণে চীনের কোম্পানিগুলো আমেরিকান গ্রাহক হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।
কিন্তু গত কয়েক মাসে চীন এটাও স্পষ্ট করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সঙ্গে কঠোর আচরণ করলে কী ঝুঁকি হতে পারে। এপ্রিলে, যখন ট্রাম্প চীনের ওপর অত্যাধিক শুল্ক আরোপ করেন, চীন প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বিরল অপরিশোধিত ধাতু এবং চুম্বক রপ্তানি স্থগিত করে দেয়।
এই চুম্বকগুলো গাড়ি, ড্রোন, উৎপাদনকারী রোবট এবং এমনকি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য অপরিহার্য। চীন বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ চুম্বক উৎপাদন করে এবং প্রায় ১০০ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ প্রক্রিয়াজাত করে, যা চুম্বকগুলোকে তাপের প্রতি আরও প্রতিরোধী করে।
জুনে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতু রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে সম্মত হয়। তবে কিছু মার্কিন কোম্পানি এখনও পর্যাপ্ত সরবরাহ পাচ্ছে না। ইউরোপীয় উৎপাদকরাও পর্যাপ্ত চুম্বক আমদানি নিশ্চিত করতে সমস্যায় পড়েছে। কারণ বেইজিং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর শুল্ক তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। বেইজিংয়ের বার্তা স্পষ্ট: চীনেরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে, এবং এটি ব্যবহার করতে তারা ভয় পায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে, চীন তার প্রভাব দেখিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনা বন্ধ করে দেয়। চীন বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ সয়াবিন কিনে থাকে যা মার্কিন সয়াবিন চাষীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্রয় বন্ধ করে চীন ট্রাম্পের শুল্কের প্রতি তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।