সেরা প্রার্থী বাছাইয়ের চ্যালেঞ্জে বিএনপি, মনোনয়ন পেতে চলছে দৌড়ঝাঁপ

সরকার ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংশয় থাকলেও নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ নিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও দলীয় মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৩০০ আসনের মধ্যে প্রায় ১২০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এদের মধ্যে রয়েছেন বহু অভিজ্ঞ নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী।
তবে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যেই দুই শতাধিক আসনে প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি। এখনো প্রায় ৫০টি আসন নিয়ে মূল্যায়ন চলছে। একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক জানিয়েছে, অবশিষ্ট আসনগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতার পর।
এছাড়া বিএনপি নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজও শুরু করেছে। বিভিন্ন খাতভিত্তিক নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট নেতাদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বাকি আসনগুলোতে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা বিএনপির জন্য এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। কিছু আসনে বাদ পড়া প্রার্থীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে পারেন, এতে দলের ভেতরে টানাপোড়েনও সৃষ্টি হতে পারে।
তবে দলীয় সূত্রের দাবি, প্রতিটি আসনেই একাধিক যোগ্য, নিবেদিতপ্রাণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী রয়েছেন, যারা মাঠের আন্দোলনে নিজেদের প্রমাণ করেছেন এবং ভোটারদের গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করেছেন। এসব আসনে এখনো যাচাই-বাছাই চলছে। ধাপে ধাপে জরিপ পরিচালনা করে সর্বোত্তম প্রার্থী বাছাই করা হবে।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিশ্বাস, চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা হলে সব প্রার্থীই নির্বাচিত প্রার্থীর পক্ষে একজোট হবেন এবং বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু টিবিএসকে বলেন, "চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে। গত ১৬-১৭ বছরে অনেক নেতা আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, রাজপথে থেকেছেন। একই আসনে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতে পারে। তবে যে প্রার্থী ভোটার টানতে পারবে, মানুষের কাছে যার গ্রহণযোগ্যতা বেশি, কর্মী-সমর্থক বেশি এবং যোগ্য তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।"
তিনি আরও বলেন, "অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আছেন যারা দলের ভালো নেতা বা কর্মী। কিন্তু ভোটের মাঠে ভোটার টানতে পারবেন না, জিততেও পারবেন না। এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। তবে তাদের দলীয় অন্য পদে রাখা হবে।"
সূত্র জানায়, যাদের দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে মূল্যায়ন সম্ভব হবে না, দল যদি জয়ী হয় তবে তাদের দেশ পরিচালনায় যুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে জেলা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের মূল্যায়ন করা হবে।
ওই সূত্র আরও জানায়, যেসব নেতার অতীতে নির্বাচনী অভিজ্ঞতা রয়েছে, কেউ কেউ সংসদ সদস্য ছিলেন ও সরকার পরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন—তাদের আসনে দলের অবস্থান বরাবরই শক্তিশালী। অন্যদিকে, বাকি আসনগুলোতে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে ধাপে ধাপে জরিপ চালানো হয়েছে, যা এখনো শেষ হয়নি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী টিবিএসকে বলেন, "বড় দলে প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। অতীতেও প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। যাচাই-বাছাই করে তাদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তখন সবাই মিলে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন, কাজ করেছেন। এবারও তাই হবে। প্রার্থী বাছাই তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে না।"
তারেক রহমানের মনিটরিং টিম
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় দলের ভেতরে ব্যাপক কাজ চলছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ব্যক্তিগত তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর এরজন্য আলাদা টিম সার্বক্ষণিকভাবে নেতাদের ওপর নজরদারি করে প্রতিবেদন তৈরি করছে।
এসব প্রতিবেদন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই প্রতিবেদনগুলোর ওপর ভিত্তি করেই নেওয়া হবে।
প্রতিটি আসনভিত্তিক ৫-৬ জনের একটি তালিকা তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই তালিকায় ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের এমপি প্রার্থীদের পাশাপাশি তরুণ, মেধাবী, জনপ্রিয় ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতারাও স্থান পেয়েছেন। জানা গেছে, এদের মধ্য থেকেই চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনীত হবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, "যাচাই-বাছাই চলছে। তারেক রহমানের লোকজন সারাদেশে মাঠ-ঘাট ঘুরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন।"
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, জাতীয় সংসদ বা অন্য যেকোনো নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নে একটি পার্লামেন্টারি বোর্ড থাকবে। জাতীয় স্থায়ী কমিটিই হবে দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড। দলের চেয়ারম্যান হবেন পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভাপতি। তবে যে জেলার প্রার্থী মনোনয়ন হবে, সেখানকার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও বোর্ডের সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন। পার্লামেন্টারি বোর্ডই প্রার্থী মনোনয়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক সব কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু টিবিএসকে বলেন, "বিএনপিতে দক্ষ মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক। এর মধ্য থেকে সেরা প্রার্থীকে বেছে আনার চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই।"
তিনি বলেন, "তবে এই চ্যালেঞ্জকে বড় করে দেখার কিছু নেই। অনেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকবেন, কিন্তু দল একজনকেই মনোনয়ন দেবে। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আশা করি সবাই মিলে তাকে বিজয়ী করতে কাজ করবেন। অতীতেও তারা একসঙ্গে আন্দোলন করেছেন, সুতরাং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সবার মধ্যেই আছে।"
দলীয় অন্তঃকোন্দল ভাবাচ্ছে বিএনপিকে
তৃণমূল পর্যায়ে অন্তঃকোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। আগামী নির্বাচনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে এই কোন্দল আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক জরিপে উঠে এসেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিএনপির ভেতরে আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, মূল সংগঠন ও অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা এবং স্বার্থের সংঘাতে নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন।
গত ১৩ মাসে এসব ঘটনায় দলের ৮৯ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এ সময়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৫৪৬টি, যেখানে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, "অন্তঃকোন্দলের কিছু ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে এখন বিশৃঙ্খলা অনেকটাই কমে এসেছে, দল এখন সুশৃঙ্খল। মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে সবাই কোন্দল ভুলে এক কাতারে চলে আসবেন বলে আমরা আশাবাদী।"