‘শুধু গত ১৫ বছরে নয়, আমাদের ডিএনএ দূষিত হয়ে গেছে’: প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষয়প্রাপ্ত। সমস্যাটি শুধু গত ১৫ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
তিনি বলেন, 'আমাদের ডিএনএ দূষিত হয়ে গেছে। এটি শুধু গত ১৫ বছরে হয়নি, বরং বছরের পর বছর ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
আজ সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) ডিএসই টাওয়ারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) আয়োজিত 'আনলকিং বাংলাদেশস বন্ড অ্যান্ড সুকুক মার্কেটস: ফিসকাল স্পেস, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেলিভারি অ্যান্ড ইসলামিক মানি মার্কেট ডেভেলপমেন্ট'- শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশ বারবার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা শক্তিশালী করা ও সংস্কার জরুরি।'
তিনি বলেন, 'দেশের মধ্যে তহবিল ধরে রাখার জন্য যে বিনিয়োগ সরঞ্জাম তৈরি করা উচিত ছিল, আমরা তা করিনি। আমরা বারবার একই ভুল করেছি।'
তিনি সুকুক ও প্রচলিত বন্ডের মধ্যে পার্থক্য জনগণকে বোঝানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, 'সুকুক মুনাফা দেয়, আর বন্ড সুদ দেয়। জনগণকে এই পার্থক্য বুঝতে হবে।'
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক সৈয়দা জাকেরিন বখত নাসির। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, এফআইডি সচিব নাজমা মোবারেক এবং ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবির হাসান ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের মতো কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক খাতকে দুর্বল করেছে।
তার অভিযোগ, ইসলামী ব্যাংক এবং বৃহত্তর ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষতির জন্য মূলত এস আলম গ্রুপ দায়ী।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশে কর্পোরেট বন্ড খাত বেশ অনুন্নত।
তিনি এ সমস্যা সমাধানে আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি, শক্তিশালী আইনি কাঠামো এবং বন্ড ও সুকুকের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
একই ধরনের উদ্বেগ তুলে ধরে এফআইডি সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, বাংলাদেশ এখন আর্থিক সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে সরকারি খাতের ইসলামিক ব্যাংক চালুর কথা বিবেচনা করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বন্ড বাজার উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির যৌথ টাস্কফোর্স কাজ করছে এবং সরকারকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিচ্ছে।
তিনি জানান, বিশ্বব্যাপী ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বন্ড ইস্যু হয়েছে, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক বাজারে পরিণত করেছে।
তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংক সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় বছরের জন্য ঋণ দিতে পারে, ১০ বছরের বেশি নয়। দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ বন্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন করা উচিত। এমনকি সঞ্চয়পত্রকেও সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেনযোগ্য করতে হবে।'
গভর্নর বলেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পেনশন ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ অতিরিক্ত ঋণনির্ভরতার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, এটি দেশে বাড়তে থাকা খেলাপি সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, 'বন্ডে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ খুবই কম। আমাদের আর্থিক চাহিদা মেটাতে ঋণ বা করের ওপর নির্ভর না করে মূলধন বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।'
উপদেষ্টা বলেন, মূলধন বাজারকে শুধুমাত্র অল্প সময়ে মুনাফা করার জায়গা হিসেবে দেখা ঠিক নয়। তিনি বৃহত্তর আর্থিক সাক্ষরতা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন।
সুকুক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এ ধরনের উপকরণকে অবশ্যই প্রকৃত ও আর্থিকভাবে টেকসই সম্পদের ওপর ভিত্তি করে ইস্যু করতে হবে—ডেরিভেটিভের মতো ভঙ্গুর সম্পদের ওপর নয়।'
সালেহউদ্দিন আহমেদ পেনশন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'যদি পুরো তহবিল বিনিয়োগ করা হয়, তবে জনগণের অর্থের প্রয়োজন হলে সরকার কীভাবে দায়বদ্ধতা পূরণ করবে?'
