লাকি আলী: কৈশোরে ঘর ছেড়েছেন, করেছেন কার্পেট পরিষ্কারের ব্যবসা, ‘অসম্মানের’ কারণে ছেড়েছেন বলিউড
অভিনেতা-চলচ্চিত্র নির্মাতা মেহমুদ আলী ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা কৌতুকশিল্পী। 'কুঁওয়ারা বাপ', 'হামজোলি', 'পড়োসান', 'দো ফুল'-এর মতো ক্লাসিক সিনেমায় দর্শককে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। তার ছেলে লাকি আলীও স্বনামে বিখ্যাত। তবে বাবা-ছেলের সম্পর্ক ছিল বেশ অম্লমধুর। বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন তারকা সন্তান।
সৎ মায়ের কাছে উপেক্ষিত ছিলেন লাকি আলী
সুপারস্টার মেহমুদ ও তার প্রথম স্ত্রী মধু কুমারীর ঘরে লাকি আলীর জন্ম। এই দম্পতির তিন সন্তান ছিল। বিয়ের কয়েক বছর পর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক পুরোনো সাক্ষাৎকারে লাকি জানিয়েছিলেন, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। কারণ তার সৎ মা, অর্থাৎ মেহমুদের দ্বিতীয় স্ত্রী ট্রেসি আলী, চাইতেন না তারা কাছাকাছি থাকুক।
লাকি বলেছিলেন, 'বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রেই বড় হয়েছি। বাবা চাইতেন না আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হই, আর আমার সৎ মা চাইতেন না আমরা তার কাছাকাছি থাকি। ছোটবেলায় নিজেকে একা লাগত। বাবাও সবসময় দূরে দূরে থাকতেন।'
মেহমুদের বাড়ি ছেড়েছিলেন, করেছেন ছোটখাটো কাজও
মেহমুদ চেয়েছিলেন লাকি অভিনেতা হবেন। কিন্তু ছেলের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। রেডিও নাশাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুরকার রাজেশ রোশন সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'লাকি আলী আমার পরিবারের মতো ছিল। বাবার সাথে ওর খুব ঝগড়া হতো। মেহমুদ ছিলেন ভীষণ বদরাগী, কারও কথা শুনতেন না। একদিন লাকি আমার কাছে এসে বলল, "আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, আর ফিরব না।" ও আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবে। ওর সাথে গিটারটা ছিল। ওকে আমার সাথে যোগ দিতে বললাম। ও আমার বন্ধু ছিল। আমার তৈরি গানে অন্য গিটারিস্টদের সাথে ও-ও গিটার বাজাত। সেই সময় ও আমার সাথে অনেক কাজ করেছে।'
বাবার দেখানো পথে চলতে না চাওয়ায় লাকি কার্পেট পরিষ্কার করার ব্যবসা শুরু করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'বাবা চেয়েছিলেন আমি অভিনয় করি, কিন্তু ততদিনে সময়টা অনেক পাল্টে গিয়েছিল।'
আরেক পুরোনো সাক্ষাৎকারে লাকি আলী জানিয়েছিলেন, বাবা তাকে পরামর্শ দিতে বা সঠিক পথ দেখাতে কখনও দ্বিধা করেননি; কিন্তু আর্থিকভাবে কখনও সাহায্য করেননি। 'আমার ক্যারিয়ার গড়তে বাবা আমাকে সরাসরি সাহায্য করেননি। তিনি আমাকে উৎসাহিত করেছেন। ...যা যা জানা দরকার, তা শিখিয়েছেন। কিন্তু আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন, আমার নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। কারণ সিদ্ধান্তগুলো আমার ছিল এবং তিনি আমাকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছেন।'
সিনেমায় অভিনয় করার সময়েও চরিত্রের ব্যাপারে কোনো আপস করতে চাইতেন না লাকি। পছন্দসই কাজ না পাওয়ায় তিনি পুদুচেরি উপকূলে একটি তেলক্ষেত্রে কাজ করতে চলে যান।
লাকি আলীর আসক্তি নিয়ে মেহমুদের সিনেমা নির্মাণ
লাকি একসময় মারিজুয়ানা আসক্ত ছিলেন। তিনি নিজেই এ আসক্তির কথা স্বীকার করেছেন। তার আসক্তি নিয়ে মেহমুদ তার 'দুশমন দুনিয়া কা' সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। সিনেমাটিতে লাকির ছোট ভাই মনজুরও অভিনয় করেন।
তবে পুরোনো এক সাক্ষাৎকারে লাকি জানান, তার অভ্যাস নিয়ে বাবার এই সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত তাকে গভীর আঘাত করেছিল। তিনি বলেন, 'খুব খারাপ লেগেছিল। আমি এখনও মাঝে মাঝে মারিজুয়ানা সেবন করি, কিন্তু আমি মাদকাসক্ত নই। বাবাকে আমার অভ্যাসের কথা বলেছিলাম, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ...আমার মনে হয় না তিনি আমাকে বুঝতে পেরেছিলেন।'
লাকি আলীর সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ার ও বলিউড ছাড়ার কারণ
সহকারী পরিচালক ও ব্যাকআপ মিউজিশিয়ান হিসেবে কাজ করার পর ১৯৯৬ সালে ৩৭ বছর বয়সে 'সুনো' অ্যালবামের মাধ্যমে সংগীতে লাকি আলীর অভিষেক হয়।
এরপর ২০০০ সালে 'কাহো না... প্যার হ্যায়' সিনেমা দিয়ে বলিউডে বড় সাফল্য পান তিনি। অবশেষে ২০০২ সালে 'কাঁটে' এবং 'সুর' সিনেমায় অভিনয় করে তিনি বাবার অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা পূরণ করেন।
বাবা মেহমুদ যেখানে সবসময় বাণিজ্যিক সিনেমার সাথে যুক্ত ছিলেন, সেখানে লাকি আলী ঝুঁকেছিলেন ভিন্নধারার বা প্যারালাল সিনেমার দিকে। তিনি শ্যাম বেনেগালের 'ত্রিকাল' সিনেমাতেও কাজ করেছেন।
পরের দশকে লাকি নিজের অ্যালবাম ও বিভিন্ন সিনেমার জন্য অনেক জনপ্রিয় ও স্মরণীয় গান গেয়েছেন।
গায়ক হিসেবে বলিউডে লাকির শেষ কাজ ছিল ২০১৫ সালের 'তামাশা' সিনেমায়। এরপর তিনি বলিউড ছেড়ে দেন।
অভিনেতা হিসেবে তাকে শেষবার দেখা গেছে ২০২১ সালের 'মার্ডার অ্যাট তিসরি মঞ্জিল ৩০২' সিনেমায়।
২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে লাকি বলিউড থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ জানান। তিনি বলেছিলেন, 'এই জায়গায় অসম্মান অনেক বেশি। বলিউড বদলে গেছে। আজকাল যে সিনেমা তৈরি হচ্ছে, তাতে অনুপ্রেরণার অভাব রয়েছে। আমার মনে হয় এমন সিনেমা থেকে শেখার কিছু নেই।'
এছাড়া বাবার মৃত্যুও তাকে মুম্বাই ছাড়তে উৎসাহিত করেছিল, কারণ এই শহরে নিজেকে তার আগন্তুক মনে হতো। টাইমস অভ ইন্ডিয়াকে তিনি বলেন, 'বাবা মারা যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, আমিও এখান থেকে চলে যেতে চাই। কারণ, মনে হয়েছিল, আমি এখানকার কেউ নই। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে আগন্তুক মনে হতো। এখানে আমি অনেককে চিনতাম, তবুও নিজেকে অচেনা লাগত।'
