মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এন্ড্রু কিশোরের নামে ৭২ হাজার টাকা বকেয়া কর পরিশোধের নোটিশ

বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর তার নামে ৭২ হাজার টাকার কর বকেয়া নোটিশ পাঠিয়েছে কর অঞ্চল–১২।
দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে মারা যান এন্ড্রু কিশোর। তবে সম্প্রতি সহকারী কর কমিশনার কাজী রেহমান সাজিদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হয়, ২০০৫–০৬ অর্থবছরে তার কাছে ২২ হাজার ৪২৩ টাকা এবং ২০১২–১৩ অর্থবছরে ৫০ হাজার ৩৮০ টাকা বকেয়া রয়েছে। সব মিলিয়ে তার মোট ৭২ হাজার ৮০৩ টাকা কর বকেয়া আছে।
টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে কর কমিশনার সাজিদ বলেন, 'এটা তো আসলে আমাদের নিয়মিত কাজ। যাদের কাছে আমাদের বকেয়া আছে, সবাই তো আর সময়মতো পরিশোধ করেন না। উনার [এন্ড্রু কিশোর] এই বকেয়াটা মারা যাওয়ার আগে থেকেই ছিল।'
তিনি জানান, উত্তরাধিকারীদের নিয়মিত ফলো-আপ দেওয়া হয়। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
তবে পরিবার থেকে এখনো কেউ কর অফিসে যোগাযোগ করেননি বা বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত উনারা আসলে তো আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি। উনারা আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানও নি যে, উনার বকেয়াটা কারা পরিশোধ করবেন বা কী, এ ধরনের কোনো কিছু। কারণ আমরা তো উনাদেরকে এর আগেও নোটিশ করেছি, কোনো উত্তর তো উনারা দেননি।'
কর পরিশোধ করা না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে বলে জানিয়ে কর কমিশনার আরও বলেন, 'উনার যারা উত্তরাধিকার আছেন, এটা তো আসলে উনাদের ওপরই বর্তাবে। এটাতো মওকুফের সুযোগ নেই।'
এ বিষয়ে এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু জানান, চিঠিটি মৃত এন্ড্রু কিশোরের বাসার ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে, তার কাছে কোনো নোটিশ আসেনি। তিনি বলেন, 'চিঠিটা কি আমার নামে আসছে? না তো। তাহলে আমি কেন এই চিঠির উত্তর করব?'
তিনি আরও জানান, এন্ড্রু কিশোরের ট্যাক্সের বিষয়গুলো দেখাশোনার জন্য একজন নির্দিষ্ট ট্যাক্স এজেন্ট ছিলেন। বিষয়টি তিনি সেই এজেন্টকে জানিয়েছেন এবং তারাই কর বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
শিল্পীর জন্য অসম্মানজনক?
প্রয়াত সংগীতশিল্পীর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর আয়কর বকেয়ার নোটিশ পাঠানোর ঘটনাটি একজন শিল্পীর প্রতি অসম্মানজনক কিনা তা জানতে চাইলে শিরোনামহীন ব্যান্ডের গীতিকার, সুরকার ও বেজিস্ট জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, 'এন্ড্রু কিশোর একজন অত্যন্ত গুণী শিল্পী এবং তার প্রতি সকলেরই শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু আয়করের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এটি সবার জন্য প্রযোজ্য। সেটা গুণী হোক, নির্গুণী হোক, যেই হোক।'
'যেমন লিওনেল মেসি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ফুটবল প্লেয়ার। তার জন্য কি ট্যাক্স প্রযোজ্য নয়? অবশ্যই প্রযোজ্য। তো এন্ড্রু কিশোরের জন্যও সেটা প্রযোজ্য। তবে সেটার ডকুমেন্টস আসলে সঠিক আছে কিনা বা তাকে আদৌ হ্যারাস করা হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে', যোগ করেন তিনি।
পরিবার থেকে অভিযোগ জানানো হলে, শিল্পীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিরিসিস্ট, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মার্স সোসাইটিও (বিএলসিপিএস) এক্ষেত্রে চাইলে সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে বলে জানান জিয়া।
তবে আইনি ব্যাপার হওয়ায় এর যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, সব তথ্যপ্রমাণ যাচাই না করে এটিকে সাদামাটা বা অনুমাননির্ভর মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, 'এটি মারাত্মক আইনি অভিযোগ, এটার তদন্ত হওয়া উচিত। উনি তো মারা গেছেন। মৃত একজন শিল্পীকে এত বছর পরে এসে যে এটা করা হচ্ছে, কেন করা হচ্ছে? আমাদের যার যার কর অঞ্চলে আমরা সবাই কর দিচ্ছি না? সেটার কি ট্যাক্স রিটার্ন সার্টিফিকেট আমাদের নাই? অবশ্যই আছে। তো উনারও থাকতে পারে। যদি না দিয়ে থাকেন, তাহলে উনার উপরে সেটা প্রযোজ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।'
'আমি নিশ্চিত, যদি কোনো অন্যায় এখানে থাকে, অন্যায়ভাবে তাকে এখানে অপদস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা কোনো শিল্পী, কেউই মেনে নেবে না, অসম্ভব। আমিও তো মেনে নেব না', বলেন জিয়া।
আইন কী বলছে?
বাংলাদেশের আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির বকেয়া কর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে আদায় করার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। দায়িত্ব বর্তায় আইনগত প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারীদের ওপর। তবে দায় তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর বর্তায় না; মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির সম্পদ যতক্ষণ পর্যন্ত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আইনগতভাবে বণ্টিত না হয়, ততক্ষণ একজন আইনগত প্রতিনিধিকে সেই অবিভক্ত সম্পত্তির বিপরীতে কর পরিশোধ করে যেতে হয়। তবে এই প্রতিনিধি যদি রাষ্ট্রের পাওনা পরিশোধ না করে সম্পদ হস্তান্তর বা বণ্টন করেন, তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও দায়ী হতে পারেন এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
'প্লেব্যাক সম্রাট' খ্যাত এন্ড্রু কিশোর ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে 'মেইল ট্রেন' চলচ্চিত্রে গান গেয়ে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে 'জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প', 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস', 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে', 'আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি', 'আমার বুকের মধ্যেখানে', 'ওগো বিদেশিনী', 'তুমি মোর জীবনের ভাবনা', 'আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল', সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দেন শ্রোতাদের।
'বড় ভালো লোক ছিল' (১৯৮২), 'সারেন্ডার' (১৯৮৭), 'ক্ষতিপূরণ' (১৯৮৯), 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' (১৯৯১), 'কবুল' (১৯৯৬), 'আজ গায়ে হলুদ' (২০০০), 'সাজঘর' (২০০৭) ও 'কি জাদু করিলা' (২০০৮) চলচ্চিত্রে গান গেয়ে তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।