দুর্নীতি বন্ধ না হলে এনবিআর বিভাজন ব্যর্থ হবে: বিশেষজ্ঞরা

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুই বিভাগে ভাগ করার উদ্দেশ্য সফল করতে হলে সংস্থাটিকে অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
তাদের মতে, এজন্য সব ক্ষেত্রে অটোমেশন নিশ্চিত করা এবং কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি নবগঠিত দুই বিভাগের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না হলে ভবিষ্যতে করদাতা ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি বহুগুণে বাড়তে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে 'ইফেকটিভ গভর্নেন্স অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন অব ট্যাক্স রিফর্ম অ্যান্ড ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে।
এমসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনায় এনবিআর সংস্কারবিষয়ক সরকারি পরামর্শক কমিটির সদস্য, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন।
প্রধান আলোচক এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও সংস্কার পরামর্শক কমিটির সদস্য মো. আব্দুল মজিদ বলেন, "রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এনবিআরকে দুই ভাগ করার উদ্যোগ সফল হবে না। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এনবিআরকে 'স্টেট অফিস' হিসেবে কাজ করতে হবে, কেবল সরকারি অফিস হিসেবে নয়। কারণ মন্ত্রী, এমপি, সচিব—সবারই পরিচয় করদাতা হিসেবে।"
তিনি আরও বলেন, "এনবিআরের অটোমেশন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে। বিদেশি কনসালট্যান্ট বা ভেন্ডরের ওপর নির্ভর করলে কার্যক্রম হালনাগাদ রাখা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি অন্তত পাঁচ বছরের জন্য একটি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। হঠাৎ এসআরও দিয়ে নীতি পরিবর্তন করা যাবে না।"
পরামর্শক কমিটির আরেক সদস্য, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, "এনবিআরকে যে দুটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে, তা সবাইকে মেনে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না। ইন্টিগ্রেটেড অ্যাপ্রোচে সিস্টেম উন্নয়ন ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, নতুবা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো পরিণতি হবে। এছাড়া রাজস্ব বাড়াতে ইনফরমাল অর্থনীতিকে ফরমাল খাতে আনতে হবে।"
একই কমিটির সদস্য ও এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, "এনবিআর সংস্কারে সরকার পরামর্শক কমিটি গঠন করলেও সংস্থাটিকে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে সব সুপারিশ রাখা হয়নি। ভবিষ্যতে দুই বিভাগের মধ্যে সুসমন্বয় জরুরি। সমন্বয় না হলে করদাতা ও ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন।"
পদ্ধতিগত ব্যর্থতা ও 'সিম্পল চাঁদাবাজি'
ফরিদ উদ্দিন বলেন, "অ্যাসাইকুডা বাংলাদেশে এখনও ক্যালকুলেটর হিসেবে কাজ করছে, পূর্ণাঙ্গ সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়নি। কাস্টমস যেভাবে কাজ করছে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গত অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ১২ হাজার এলসিতে ঘোষিত মূল্যের চেয়ে বাড়তি মূল্যে শুল্কায়ন করে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছে। এটি কোনো নীতি নয়, আমি একে সিম্পল চাঁদাবাজি মনে করি।"
তিনি আরও বলেন, "রাজস্ব আদায় বাড়াতে ও গ্রাহক হয়রানি কমাতে হলে অটোমেশনের বিকল্প নেই। এজন্য ব্যাংক, নিবন্ধন অফিস, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে।"
তিনি আক্ষেপ করে জানান, পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন দেশের শীর্ষ ৭৫টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলেও ফরেন চেম্বার, এমসিসিআই ও ডিসিসিআই ছাড়া কেউ কোনো মতামত দেয়নি।
বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, "বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জ্বালানি খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু সরকারের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। রাজস্ব আয়ের ঘাটতি মেটানো ছাড়া এ বিনিয়োগ সম্ভব নয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯২ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "নিরাপত্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ জরুরি। এজন্য আইসিটিভিত্তিক অটোমেশন চালু করতে হবে এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে হবে।"
বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম বলেন, "অটোমেশন ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ এখনও হার্ডকপির বাইরে কাজ করতে পারে না।"
বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইনামুল হক খান বলেন, "এনবিআরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে অটোমেশনের পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।"
এমসিসিআই চট্টগ্রামের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, "চট্টগ্রাম কাস্টমস সিংহভাগ রাজস্ব সংগ্রহ করলেও প্রতিষ্ঠানটি আধা-অটোমেশন ও আধা-ম্যানুয়ালি চলছে। এতে সেবাগ্রহীতাদের সময় নষ্ট হচ্ছে। কম্পিউটার ও জনবল সংকটের পাশাপাশি বিদ্যমান জনবলের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এনবিআরকে দুইভাগে ভাগ করার সুফল মিলবে না।"
ইউনিলিভার বাংলাদেশের হেড অব ট্যাক্স সাঈদ আহমেদ খান বলেন, "কর খাতের সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকার সবার আগে। সরকার আন্তরিক হলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর হবে। আধুনিকীকরণ মানে শুধু অবকাঠামো নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নও জরুরি। দক্ষ জনবল ছাড়া অটোমেশন সফল হবে না।"
স্কয়ার গ্রুপের সিএফও ও ফাইন্যান্স ডিরেক্টর (ফাইন্যান্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "স্কয়ার গ্রুপ বাংলাদেশের বাইরে কেনিয়া ও ফিলিপাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। কেনিয়ার জিডিপি বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ হলেও করদাতা ও কর আদায়কারীর দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। একটি সিঙ্গেল আইডিতেই সব কর পরিশোধ সম্ভব। ফলে অটোমেশন ছাড়া রাজস্ব খাতের দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।"
স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোং-এর পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, "একজন করদাতাকে একই কাজের জন্য একাধিক দপ্তরে যেতে হয়, এটি সিস্টেমের দুর্বলতা। এ দুর্বলতা দূর করতে অটোমেশন দরকার। পাশাপাশি এনবিআরের জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে। সবার আগে ভ্যাট ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে, তাহলেই আয়কর ঠিক করা সহজ হবে। ইনফরমাল অর্থনীতিকে ফরমাল খাতে আনতে হলে প্রয়োজনে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।"
এমসিসিআই প্রেসিডেন্ট কামরান টি রহমান বলেন, "মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ আয়কর দিচ্ছে। অন্যদিকে কর সংগ্রহ ব্যবস্থা জটিল, যেখানে দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। কর হারের পূর্বাভাস পাওয়া যায় না, ফলে বিনিয়োগকারীরা পরিকল্পনা করতে পারেন না। সংস্কার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানে, বাস্তবসম্মতভাবে। সেখানে সরকার ও বেসরকারি খাতের জন্য রোডম্যাপ থাকতে হবে।"
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এমসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির। তিনি বলেন, "অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা রয়েছে। শুধু এনবিআরকে দুই ভাগ করলেই এসব দূর হবে না। এক্সট্রা রেগুলেটরি ব্যারিয়ার দূর করতে হবে। অটোমেশন ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলাই প্রধান সমাধান।"
আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমসে বিড়ম্বনা
ব্যবসায়ীরা জানান, এনবিআরের বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে তাদের নানাভাবে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এর অন্যতম কারণ দুর্নীতি।
এমসিসিআই চট্টগ্রামের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, "চট্টগ্রাম কাস্টমসে পণ্য খালাসে দেরি হয়। এতে পোর্ট ডেমারেজ ও জাহাজের লেট ফি বাবদ বাড়তি ব্যয় হয়। এনবিআরের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, সেখানে সিস্টেমের চেয়ে অপারেশনে সমস্যা বেশি।"
নিহাদ কবির বলেন, "আমার অফিসের একজন কর্মী কর দিতে গিয়ে কর অফিসের নিচে গাড়ি রেখেছিল। পুলিশ মামলা দিয়েছে। তাহলে করদাতাদের কর অফিসে যাওয়ার ব্যবস্থা কেন রাখা হচ্ছে?"
বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম বলেন, "আমাদের একজন সদস্যের পণ্য সামান্য কারণে ২১ দিন বন্দরে আটকে রাখা হয়। নৌ পরিবহন সচিব আদেশ দিলেও হার্ডকপি না পৌঁছানোয় ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি, অথচ সচিব হোয়াটসঅ্যাপে কপি পাঠিয়েছিলেন।"
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, "একই পণ্য আমদানিতে একেক বন্দরে একেক নিয়ম চলে। বেনাপোল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা কাস্টমসে আলাদা নিয়ম কার্যকর। এগুলো দূর করতে এনবিআরের একটি সর্বজনীন গাইডলাইন থাকা উচিত।"