সরকার পতনের আগেই ড. ইউনূসকে সরকারপ্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়: নাহিদ ইসলাম

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, গত বছরের ৪ আগস্ট সরকার পতনের পূর্বেই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সে সময় তাকে নতুন সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৪৭তম সাক্ষীর শেষ দিনে এ কথা বলেন তিনি। সকাল সোয়া ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন বিচারপতি গোলাম মোর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
নাহিদ ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেন, 'গত বছর ৫ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে আমরা সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবি জানাই এবং অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিই। আমরা আরও দাবি জানাই, কোনো ধরনের সেনাশাসন বা সেনা-সমর্থিত শাসন আমরা মেনে নেব না।'
তিনি অভিযোগ করেন, পুরো আন্দোলন জুড়ে পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালায় ও নির্যাতন চালায়।
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, 'এই হত্যাযজ্ঞের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সে সময়কার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের দায়ী করছি। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশেই এসব হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। তারা ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও নিরঙ্কুশ করতে এসব করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার ও 'লেথাল ওয়েপন' ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রার্থনা জানাই, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের যেন কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।'
জবানবন্দির একপর্যায়ে নাহিদ ইসলাম জানান, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী তারা গত বছরের ৪ আগস্ট শাহবাগে অবস্থান ও বিক্ষোভ করেন। ওই দিনই ৬ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সরকার কারফিউ ঘোষণা করে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের কাছে তথ্য আসে, সরকার মার্চ ব্যর্থ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে এবং একইসঙ্গে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়া হত্যাকাণ্ড বা গুমের আশঙ্কাও তৈরি হয়। এজন্য তারা একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট কর্মসূচি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, 'আমরা ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি সফল করার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করছিলাম। মাহফুজ আলম এই সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। নতুন সরকার গঠনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করি এবং তাঁকে সরকারপ্রধান হওয়ার প্রস্তাব দিই।'
এর আগে, ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নাহিদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তবে শেষ না হওয়ায় তা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের বৈদেশিকবিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার গিডেয়েন রাখমানের উপস্থাপনায় একটি পডকাস্টে ড. ইউনূস জানিয়েছিলেন, তিনি প্যারিসের হাসপাতালে থাকা অবস্থায় প্রথম অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে ফোনকল পেয়েছিলেন।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে সুইজারল্যান্ডের দাভোস সফর করেন প্রধান উপদেষ্টা। সে সময় এফটিকে ওই পডকাস্ট সাক্ষাৎকার দেন তিনি। পডকাস্টে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'আমি যখন প্রথম ফোনকল পাই, তখন আমি প্যারিসের হাসপাতালে ছিলাম। আমার ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তখন তারা [ছাত্রনেতারা] ফোন দিল। যদিও আমি বাংলাদেশে কী ঘটছে, সেসব খবর প্রতিদিন মুঠোফোনে দেখতাম। তখন তারা বলল, "তিনি [শেখ হাসিনা] চলে গেছেন। এখন আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। দয়া করে, আমাদের জন্য সরকার গঠন করুন।" আমি বলেছিলাম, না, আমি সেই ব্যক্তি নই। আমি এর কিছুই জানি না। আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতেও চাই না।'
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত বছরের ৮ আগস্ট ফ্রান্স থেকে দেশে ফেরেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিনই তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।