নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়ার নির্বাচন: ট্রাম্প যুগের প্রভাবের প্রাথমিক পরীক্ষা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত নয় মাসের শাসনকাল শেষে, আগামীকাল বুধবার (যুক্তরাষ্ট্রে মঙ্গলবার) নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের গভর্নর নির্বাচন, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক ইঙ্গিত দেবে।
অন্যদিকে, নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট জোহরান মামদানি এবং ৬৭ বছর বয়সী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো, যিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে। এই প্রচারণা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রজন্মগত ও আদর্শগত বিভাজনকে স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে। জাতীয় নির্বাচনে হারের পর থেকেই দলটি এখনো নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।
এদিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেবেন, রাজ্যের কংগ্রেশনাল মানচিত্র পুনর্গঠনের ক্ষমতা ডেমোক্রেটিক আইনপ্রণেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে কি না—যা ভবিষ্যতে মার্কিন পার্লামেন্টের প্রতিনিধি পরিষদ বা কংগ্রস কোন দলের নিয়ন্ত্রণে যাবে, তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ভোটগ্রহণ ভার্জিনিয়ায় সন্ধ্যা ৭টায় (যুক্তরাষ্ট্র সময়) শেষ হবে, এরপর নিউজার্সি, নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার ফলাফল আসতে শুরু করবে রাত জুড়ে।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য বড় পরীক্ষা
ওয়াশিংটনে ক্ষমতা হারিয়ে বিভক্ত ডেমোক্র্যাট পার্টি আগামীকালের ভোটকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। দলটির জন্য এর গুরুত্ব এতটাই যে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেষ মুহূর্তে নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়ায় প্রচারণায় অংশ নেন। তিনি ভোটারদের আহ্বান জানান রিপাবলিকান ট্রাম্পের "আইনবহির্ভূত আচরণ" মোকাবিলায় ডেমোক্র্যাটদের জয়ী করতে।
ওবামার এই প্রচার সম্পর্কে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক ল্যারি সাবাটো বলেন, "ডেমোক্র্যাট পার্টির বর্তমান অবস্থা খুবই দুর্বল। তাদের এখন যতটা সম্ভব প্রেরণা দরকার।"
ভোটারদের উৎসাহ অবশ্য আশাব্যঞ্জক।
ভার্জিনিয়া, নিউজার্সি ও নিউইয়র্কে ৩০ লাখের বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন, যা চার বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি। নিউইয়র্ক সিটিতে প্রায় ৭ লাখ ৩৫ হাজার ভোট পড়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় চারগুণ বেশি।
নিউজার্সিতে সবচেয়ে উত্তপ্ত লড়াই
নিউজার্সির গভর্নর নির্বাচন বর্তমানে সবচেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হিসেবে দেখা হচ্ছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী মাইকি শেরিল, যিনি সাবেক নৌবাহিনীর পাইলট ও কংগ্রেসওমেন, সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক সিয়াটারেল্লির চেয়ে, যিনি সাবেক আইনপ্রণেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
এ নির্বাচনে ব্যয় নতুন রেকর্ড গড়েছে—উভয় জাতীয় দলই বিপুল অর্থ ঢালছে।
অন্যদিকে ভার্জিনিয়ায়, সাবেক ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওমেন অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার জনমত জরিপে স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে আছেন রিপাবলিকান লেফটেন্যান্ট গভর্নর উইনসম আর্ল-সিয়ার্সের চেয়ে।
নির্বাচন পূর্ব জরিপগুলোতেও নিউইয়র্কে মামদানি বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন, যেখানে কুওমো দ্বিতীয় এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া (৭১) দূরবর্তী তৃতীয় স্থানে।
ক্যালিফোর্নিয়ার "প্রস্তাবনা ৫০"—একটি নতুন ডেমোক্র্যাট-সমর্থিত কংগ্রেশনাল মানচিত্র তৈরির উদ্যোগ, যা টেক্সাসের রিপাবলিকান পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় পাঁচটি আসন উল্টে দিতে পারে—পাস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
ট্রাম্পের ছায়া, জীবনযাত্রার ব্যয় ও ভোটের মনোভাব
যদিও এই নির্বাচনের ফলাফল কিছুটা ইঙ্গিত দেবে আমেরিকান ভোটারদের মনোভাব সম্পর্কে, তবুও মধ্যবর্তী নির্বাচন এখনো এক বছর দূরে—ট্রাম্প যুগের দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায় যা এক দীর্ঘসময়।
ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদ জেসি ফার্গুসন বলেন, "আজকের নির্বাচনে যে বার্তা শোনা যাচ্ছে, আগামী বছরও সেটাই প্রতিধ্বনিত হতে পারে। তাই এ ফলাফল হয়তো এখনই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, কিন্তু রাজনীতির দিকনির্দেশনা বোঝা যাবে।"
রিপাবলিকান কৌশলবিদ ডগলাস হাই বলেন, "ভার্জিনিয়া বা নিউ জার্সির ফলাফল থেকে বোঝা যাবে না, মিসৌরির কোনো কংগ্রেস আসন বা মেইনের সিনেট নির্বাচনে কী হবে।"
@ডেমোক্র্যাটদের কৌশল: মধ্যপন্থা বনাম প্রগতিশীলতা
ডেমোক্র্যাটদের জন্য এই নির্বাচন বিভিন্ন কৌশলের কার্যকারিতা পরিমাপের সুযোগ।
স্প্যানবার্গার ও শেরিল—উভয়েই জাতীয় নিরাপত্তা পটভূমির মধ্যপন্থী প্রার্থী—তাদের প্রচারণায় ট্রাম্পকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন। তারা প্রেসিডেন্টের বিতর্কিত নীতি ও চলমান সরকারি কার্যক্রম স্থগিত রাখার ঘটনাকে ভোটার ক্ষোভে পরিণত করার চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে, মামদানি নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক বামপন্থী বিপ্লবী প্রচারণার—যেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে শহরে প্রায় ১০ লাখ ফ্ল্যাটে ভাড়াবৃদ্ধি স্থগিত রাখা, ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধি, এবং গণপরিবহন বাস ফ্রি করে দেওয়ার।
সোমবার রাতে ট্রাম্প হঠাৎ করে কুওমোর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন এবং হুমকি দেন যে, মামদানি জিতলে নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল তহবিল কাটছাঁট করা হবে।
জীবনযাত্রার ব্যয় ও অর্থনীতি মূল আলোচ্য
তাদের আদর্শিক পার্থক্য সত্ত্বেও তিন প্রার্থীরই প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয় ও অর্থনৈতিক চাপ।
ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান কেন মার্টিন রয়টার্সকে বলেন, "নিউইয়র্ক হোক বা ভার্জিনিয়া বা নিউ জার্সি—পুরো দেশজুড়েই ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ নিয়ে কথা বলছেন। এই বিষয়গুলোই এখন আমেরিকান ভোটারদের উদ্বেগের মূল কারণ।"
রিপাবলিকানদের জন্য ট্রাম্প-পরবর্তী পরীক্ষা
রিপাবলিকানদের জন্য এই নির্বাচন একটি বড় পরীক্ষা—২০২৪ সালে ট্রাম্পের জয়ে যেসব ভোটার ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা কি এবারও ভোটকেন্দ্রে ফিরবেন?
নিউজার্সিতে সিয়াটারেল্লি প্রচারণা চালাচ্ছেন ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাট-প্রভাবিত এলাকাগুলোতে, একইসঙ্গে তিনি ট্রাম্পের মতোই কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো ভোটারদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।
তবে চ্যালেঞ্জও বড়: ট্রাম্পকে আক্রমণ করলে সমর্থন হারানোর আশঙ্কা, আবার অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা দেখালে মধ্যপন্থী ও স্বাধীন ভোটারদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়ার ঝুঁকি।
সর্বশেষ রয়টার্স/ইপসোস জরিপ অনুযায়ী, ৫৭% আমেরিকান ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট। কিন্তু একই সঙ্গে ডেমোক্র্যাটরাও তেমনভাবে লাভবান হচ্ছেন না—ফলে ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কোন দলকে সমর্থন করবেন, সে বিষয়ে ভোটাররা প্রায় সমানভাবে বিভক্ত।
