মার্কিন ভূখণ্ডের অজেয় দুর্গের ধারণা ভেঙে দিচ্ছে রাশিয়ার বুরেভেস্তনিক ক্ষেপণাস্ত্র
রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তিচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র 'বুরেভেস্তনিক'-এর সাম্প্রতিক পরীক্ষা যেমন একদিকে মস্কোর স্নায়ুযুদ্ধ–যুগের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নতুন জীবন দিয়েছে, অন্যদিকে পরাশক্তিগুলোর পরস্পর প্রতিযোগিতার আধুনিক রাজনীতিতে নতুন ধরনের ঝুঁকির-ও ইঙ্গিত দিয়েছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের "নিরাপদ মূল ভূখণ্ডের" ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে।
চলতি মাসে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, রাশিয়া সফলভাবে তাদের নাইনএম৭৩০ বুরেভেস্তনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে, যা মস্কোর পরবর্তী প্রজন্মের কৌশলগত অস্ত্র কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সামরিক পোশাকে শীর্ষ জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, ক্ষেপণাস্ত্রটি পারমাণবিক প্রপালশন ব্যবস্থায় ১৫ ঘণ্টা উড়ে ১৪,০০০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছে—যা এখন পর্যন্ত কোনো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের দীর্ঘতম পাল্লার রেকর্ড।
রাশিয়ার চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ নিশ্চিত করেছেন, এই পরীক্ষা দেশটির আর্কটিক অঞ্চলের নভায়া জেমলিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে অতীতে রাশিয়া বহু পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে।
ন্যাটো এই ক্ষেপণাস্ত্রকে 'স্কাইফল' নাম দিয়েছে। কার্যত সীমাহীন পাল্লা ও অননুমেয় উড্ডয়নপথ মাথায় রেখে এটির নকশা করা হয়েছে, যাতে মার্কিন ও মিত্র দেশগুলোর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে পড়ে। পুতিন একে "অজেয়" ও রাশিয়ার একান্ত উদ্ভাবন হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ২০০১ সালে অ্যান্টি–ব্যালিস্টিক মিসাইল (এবিএম) চুক্তি থেকে সরে যাওয়া ও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণের রুশ প্রতিক্রিয়া।
যদিও বুরেভেস্তনিক প্রকল্প বারবার প্রযুক্তিগত ত্রুটি ও নিরাপত্তা দুর্ঘটনায় জর্জরিত হয়েছে। যেমন ২০১৯ সালে হোয়াইট সি–তে এটির পরীক্ষা চালানোর সময় বিস্ফোরণে রোসাটমের পাঁচজন বিজ্ঞানী নিহত হন। এতে ওই অঞ্চলে তেজসক্রিয় বিকিরণের মাত্রাও বেড়েছিল।
তবুও সাম্প্রতিক এই সফল পরীক্ষা প্রমাণ করে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেও রাশিয়া তার কৌশলগত দৃঢ়তা ও পারমাণবিক প্রতিরোধক্ষমতা প্রদর্শনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে স্যামুয়েল বেনডেট ও অন্যান্য বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, বুরেভেস্তনিক রাশিয়ার সেই প্রচেষ্টার প্রতিফলন, যেখানে তারা মার্কিন ও ন্যাটো–এর প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বিরুদ্ধে পাল্টা ভারসাম্য আনতে চায়। তারা এই ক্ষেপণাস্ত্রকে "অসামান্য উদ্ভাবন" হিসেবে উল্লেখ করে আরও বলেন, এতে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু উচ্চপ্রভাবসম্পন্ন পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে বুরেভেস্তনিকের ধারণা যতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সেইসব প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ ততটাই কঠিন। বুরেভেস্তনিক সম্ভবত ১৯৫০–এর দশকের যুক্তরাষ্ট্রের প্রজেক্ট প্লুটো থেকে অনুপ্রাণিত—যা ছিল সুপারসনিক লো–অ্যালটিটিউড মিসাইল (স্ল্যাম) তৈরির প্রকল্প।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই পারমাণবিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রটি-ও দীর্ঘসময়ের জন্য নিম্ন উচ্চতায় উড়ে একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনের জন্য পরিকল্পিত ছিল। এটি আনশিল্ডেড রিয়্যাক্টর নিউক্লিয়ার ফিশনের মাধ্যমে বাতাস গরম করে ম্যাক–৩ গতিতে পৌঁছাত, কিন্তু এতে তেজস্ক্রিয় গ্যাস নির্গমন হতো, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি ছিল।
যদিও ক্ষেপণাস্ত্রের রিয়্যাক্টর পরীক্ষাগুলো সফল হয়েছিল, কিন্তু এর উপাদান বিজ্ঞান, কাঠামোগত স্থায়িত্বের পাশপাশি পারমাণবিক সুরক্ষা লঙ্ঘন ঘিরে নৈতিক বিতর্ক দেখা দেয়। ফলস্বরূপ পারমাণবিক দূষণ নিয়ে জনমতের চাপে—প্রকল্পটি ১৯৬৪ সালে বাতিল করা হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্পেডিং উল্লেখ করেন, বুরেভেস্তনিকের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতির রিয়্যাক্টরকে দীর্ঘমেয়াদি উড়ানের উপযোগী করা, তীব্র তাপ সহনীয়তা বজায় রাখা এবং আন্তঃমহাদেশীয় দূরত্বে নির্ভরযোগ্য গাইডেন্স নিশ্চিত করা এখনও বিশাল প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ।
এরপরও রাশিয়ার কাছে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর সম্ভাব্য সুবিধাগুলো প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের অক্টোবরে মডার্ন ডিপ্লোমেসি–তে আলেক্সেই লেওনকভ লিখেছেন, বুরেভেস্তনিককে প্রথমে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) দিয়ে হামলার পর শত্রুর কমান্ড পোস্ট নিশ্চিহ্ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কি এই অস্ত্র মোকাবিলায় সক্ষম? এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন–এর অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় ক্রিস্টোফার স্টোন লেখেন, মার্কিন মহাকাশভিত্তিক স্যাটেলাইট ব্যবস্থা (এসবিআইআরএস) মূলত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের সময় ইনফ্রারেড সিগনেচার শনাক্ত করার জন্য তৈরি। কিন্তু এই সেন্সরগুলো ক্ষেপণাস্ত্র বুস্টার থেকে আলাদা হওয়ার পর নন-ব্যালিস্টিক, নিম্ন উচ্চতার ম্যানুভারিং হাইপারসনিক ওয়ারহেডগুলোকে অনুসরণ করতে পারে না।
মিলিটারি টাইমস–এর অক্টোবর সংখ্যায় বিশেষজ্ঞ মাইকেল বোহনার্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল ভূখণ্ডকে বুরেভেস্তনিকের মতো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করতে হলে লক্ষাধিক এয়ার–ডিফেন্স সিস্টেম লাগবে, যার খরচ "গোল্ডেন ডোম" প্রকল্পের মতো ২৫৬ বিলিয়ন থেকে ৩.৬ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে আগামী ৩০ বছরে।
হিউস্টন ক্যান্টওয়েল এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন–এর ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় সতর্ক করে বলেন, নিম্নমূল্যের ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে অনির্দিষ্টকাল ধরে প্রতি ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের পেছনে লাখ লাখ ডলার ব্যয় কোনো দেশই চালিয়ে যেতে পারবে না।
ফলে কৌশলগতভাবে, বুরেভেস্তনিকের অস্তিত্বই—তা বাস্তবে কার্যকর হোক বা না হোক—মার্কিন প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় বিশাল ব্যয় চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে অনিশ্চিত প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে, যা অন্যত্র বেশি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেত।
এই অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতিতে নিয়েও প্রশ্ন তোলে। যদি মার্কিন মূল ভূখণ্ডই পারমাণবিক হামলার ঝুঁকিতে পড়ে, তবে মিত্রদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র নিজের জনগণ ও শহরগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলবে কিনা, সেই আস্থাও ফিকে হয়ে উঠবে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বুরেভেস্তনিক উত্তর কোরিয়া ও চীনের মতো দেশগুলোকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে একই রকম অস্ত্র তৈরিতে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া ইতিমধ্যে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রপালশন প্রযুক্তি দিয়েছে; বুরেভেস্তনিকের প্রযুক্তিও হয়তো পরবর্তী ধাপে পিয়ংইয়ংয়ের হাতে পৌঁছাতে পারে; যদি রাশিয়া এই প্রযুক্তি হস্তান্তরকে যথেষ্ট সংবেদনশীল না মনে করে।
এতে উত্তর কোরিয়া বাস্তবিক অর্থে বহুমুখী পারমাণবিক আক্রমণ সক্ষমতার রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, যা কিম জং উনের শাসনের টিকে থাকার নিশ্চয়তাকেই বাড়িয়ে দেবে, এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকেও নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে উৎসাহিত করবে।
অন্যদিকে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার তুলনায় অনেক বেশি সম্পদশালী চীন অনুরূপ অস্ত্রসজ্জা তৈরি করতে পারে, যা তাদের আগের হাইপারসনিক "ফ্র্যাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম (এফওবিএস)"–এর মতোই যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের জন্য নতুন হুমকি সৃষ্টি করবে।
তাই বুরেভেস্তনিকের মতো অস্ত্র চীনের পারমাণবিক কৌশলে ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করতে পারে—যদি তাইওয়ান আক্রমণে তাদের প্রচলিত বাহিনী ব্যর্থ হয়– তাহলে ব্যবহারের জন্য, অথবা যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে।
মহাশক্তিগুলোর এই প্রতিযোগিতার যুগে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের মাতৃভূমির নিরাপত্তা আর নিশ্চিত নয়, তখন বুরেভেস্তনিক–এর মতো হুমকি মোকাবিলায় বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়াটাই দরকার, অস্বীকার নয়।
এটি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কাঠামো ও পারমাণবিক নীতির পুনর্বিবেচনাও দাবি করে। ৬৫ বছরের গবেষণা ও বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্র কোনো আইসিবিএম আক্রমণ ঠেকাতে বাস্তবসম্মত সক্ষম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখাতে পারেনি, আর গোল্ডেন ডোম–এর আকাশচুম্বী ব্যয়ও এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
গোল্ডেন ডোমের মতো মহাকাশভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর প্রকল্পে বিলিয়ন ডলার ঢালার বদলে—সেই অর্থ দিয়ে স্থল ও আকাশভিত্তিক লেজার প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যেতে পারে—যা বুরেভেস্তনিকের মতো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে অধিক কার্যকর হতে পারে।
তবুও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সেরা প্রতিরক্ষা হচ্ছে একটি শক্তিশালী আক্রমণ সক্ষমতা। এইক্ষেত্রে জল, স্থল ও আকাশপথে পারমাণবিক হামলা চালানোর যে সামর্থ্য বা নিউক্লিয়ার ট্রায়াড তার আধুনিকীকরণকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন বি–২১ বোমারু বিমান, কলাম্বিয়া–শ্রেণির ব্যালিস্টিক সাবমেরিন ও সেনটিনেল আইসিবিএম উৎপাদন দ্রুততর করা। এই ধরনের সামর্থ্য বুরেভেস্তনিকের মতো অস্ত্র ব্যবহারের আগেই মার্কিন আক্রমণের ভয় তৈরির মাধ্যমে শত্রুকে বিরত রেখে কার্যকর প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।
অবশ্য এমন পদক্ষেপ আবার রাশিয়া ও চীনের "এস্কেলেট টু ডি–এস্কেলেট" (ইটুডিই) কৌশলের পক্ষে কাজ করতে পারে, যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উদ্যোগকে কৌশলগত ভারসাম্য ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করবে এবং পারমাণবিক সংঘাতের আরও হুমকি তৈরি করে প্রতিপক্ষকে ভীত করার চেষ্টা করবে।
এই ঝুঁকি দেখায়, প্রচলিত প্রতিরোধ নীতির নতুন রূপ ও সংকট ব্যবস্থাপনার সীমিত কাঠামো। ফলে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা প্রোটোকল ফের সচল করা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির পুনর্জাগরণ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি।
লেখক: লিওন হাদার একজন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও স্যান্ডস্টর্ম: পলিসি ফেইলিওর ইন দ্য মিডল ইস্ট গ্রন্থের লেখক। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল নিবন্ধ থেকে পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত আকারে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকের জন্য এটি অনূদিত করা হলো।
